দেশে নতুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচন কাজ চলছে। মোটামুটি সবাই নিশ্চিত যে, দেশের ২২ তম রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হচ্ছেন মো. সাহাবুদ্দিন। তিনি এর আগে দুদকে কর্মরত ছিলেন। যেহেতু তিনি সরকার দলের মনোনয়ন প্রাপ্ত প্রার্থী এবং অন্য কোনো দল কাউকে মনোনয়ন দেয়নি তাই নিশ্চিত ভাবেই বলা যায় তিনি ২২ তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করবেন। তবে কিছু কিন্তু অথবা রয়েগেছে যা এখন আলোচনার টেবিল সরগরম করে রেখেছে। নির্বাচন কমিশনে দেওয়া মনোনয়নপত্র যাচাই বাছাইয়ে যদি কোনো অসংগতি ধরা না পড়ে তাহলে তিনি বিনা প্রতিদ্বন্দিতায় নির্বাচিত বলে ঘোষিত হবেন। এখন বিভিন্ন মহলে একটি পুরোনো প্রশ্ন ফিরে এসে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। প্রশ্নটি হলো রাষ্ট্রপতি পদ লাভজনক নাকি লাভজনক নয়? প্রশ্নটি এভাবে সামনে আসার প্রধান কারণ দুদক আইন। তিনি যেহেতু দুদকের কমিশনার ছিলেন এবং দুদকের একটি নির্দিষ্ট আইন আছে তাই ঘুরে ফিরে এই আলোচনা চলছে। কী আছে দুদক আইনে? আমরা দেখতে পাই দুদক আইনে বলা আছে, দুদকের কোনো কমিশনার অবসর নেওয়ার পর প্রজাতন্ত্রের কোনো লাভজনক পদে নিয়োগের যোগ্য হবেন না। মো. সাহাবুদ্দিন রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার পর দুদক আইনের সূত্র ধরে রাষ্ট্রপতি পদ লাভজনক কি না, এই প্রশ্ন তুলেছেন কেউ কেউ।সংবিধান বিশেষজ্ঞরাও এই প্রশ্নে সবাই একমত হতে পারছেন না। তাঁদের কেউ কেউ মনে করেন, রাষ্ট্রপতি পদ অলাভজনক। তাঁদের বক্তব্য হচ্ছে, রাষ্ট্রপতি একটি সাংবিধানিক পদ এবং এটি লাভজনক পদ নয়। তবে ভিন্নমতও রয়েছে কারও কারও।
সংবিধান বিশেষজ্ঞ শাহদীন মালিক মনে করেন, রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রীসহ অন্য যে পদগুলোকে লাভজনক নয় বলা হয়েছে, তা শুধু সংসদ নির্বাচনের জন্য প্রযোজ্য হয়। তিনি মনে করেন, রাষ্ট্রপতি পদে মেয়াদ শেষ হওয়ার পর অতীতে অনেকে সংসদ নির্বাচন করেছেন। সে কারণে সংসদ নির্বাচিত হওয়ার যোগ্যতার শর্তের ক্ষেত্রে সংবিধানে এই বিধান আনা হয়েছে। অর্থাৎ রাষ্ট্রপতি পদ শুধুমাত্র সংসদ নির্বাচনের ক্ষেত্রে অলাভজনক হিসেবে বিবেচিত হবে বাকি সব ক্ষেত্রে অবশ্যই লাভ জনক বলে ধরে নিতে হবে। অনেকে প্রশ্ন তুলতে পারে একই পদ দুই ক্ষেত্রে দুইরকম হয় কিভাবে। এটি একটি আলোচনার বিষয়। আমরা সাধারণ ভাবে বলতে পারি দুদকের একজন কমিশনারের পদের চেয়ে রাষ্ট্রপতি অবশ্যই একটি অধিক লাভজনক পদ। কেননা ক্ষমতার দিক থেকে দুদকের কমিশনার কোনোভাবেই রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার কাছাকাছিও নয়। দেশে সরকারি নানা পদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেতন নির্ধারণ করা আছে রাষ্ট্রপতির নামে। তিনি যে সুবিধা ভোগ করেন তা আর কেউ করে না। এমনকি একজন রাষ্ট্রপতি অবসরে যাওয়ার পর যে সুবিধা ভোগ করেন সেটা অন্যান্য অনেক ক্ষেত্রে কর্মরত অবস্থায়ও ভোগ করার সুযোগ পান না। তুলনা করলে অবশ্যই একজন দুদক কমিশনার কর্মরত অবস্থায় যতটা ক্ষমতা,সুবিধা লাভ করে থাকেন তার চেয়েও অধিক লাভ করেন একজন অবসরপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি। যেখানে একজন অবসরপ্রা্প্ত রাষ্ট্রপতির সুযোগ সুবিধা একজন কর্মরত দুদক কমিশনারের চেয়ে বেশি সেখানে অবশ্যই রাষ্ট্রপতি পদ একটি লাভজনক পদ বলে আমি মনে করি। যদিও সংবিধানে ৬০ অনুচ্ছেদ অনুসারে রাষ্ট্রপতির পদ লাভজনক নয় বলেই বিবেচনা করা হয়ে থাকে। কিন্তু একটু গভীর ভাবে দেখলে আমরা দেখতে পাই ৬০ নং অনুচ্ছেদে স্পষ্ট করে সেভাবে কিছু বলা নেই।
আমরা এখন খতিয়ে দেখবো সংবিধান এবং অন্যান্য আইনে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও সুবিধাসমূহ কী কী। সে ক্ষেত্রে প্রথমেই আমার নজর কেড়েছে সংসদীয় পদ্ধতিতে রাষ্ট্রপতির নামেই রাষ্ট্রের সব কর্মকাণ্ড চলে। তিনি কতটুকু ক্ষমতাবান বা প্রধানমন্ত্রীই সব ক্ষমতার প্রধান কি না সেটা পরের বিষয়। তবে সংবিধানে বলা আছে, রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রের অন্য সব ব্যক্তির ঊর্ধ্বে স্থান লাভ করবেন। রাষ্ট্রপতি হচ্ছেন রাষ্ট্রপ্রধান, কিন্তু তিনি সরকারপ্রধান নন। সরকার প্রধান আর রাষ্ট্রের প্রধান দুটি আলাদা বিষয়। এ ক্ষেত্রেও খুব সাধারণ ভাবেই রাষ্ট্রপতি পদকে আমি সুবিধাজনক পদই মনে করি। আবার দেখুন রাষ্ট্রপতি সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ করতে পারেন। এটি কিন্তু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি পয়েন্ট। প্রধান বিচারপতি কে হবেন, তা নির্ধারণ করা এবং তাঁকে নিয়োগ করার ক্ষমতা সংবিধান রাষ্ট্রপতিকে দিয়েছে। যে ক্ষমতা দেশের আর কারো নেই সেই বিশেষ ক্ষমতাধারী পদ বা ব্যক্তিকে কেন এবং কোন যুক্তিতে লাভজনক পদ বিবেচনা করা হবে না সেটা একটু ভাবার বিষয়। আলোচনা এখানেই শেষ নয়। আমরা সংবিধানে ফিরে গেলে দেখতে পাই সংবিধান অনুযায়ী, রাষ্ট্রপতি স্বাধীনভাবে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করতে পারেন। যদিও আমরা জানি সংসদ নির্বাচনে যে দল সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পাবে, সেই দলের নেতাকেই প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করতে হয়।তবে কোনো দলই একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলে, তখন কোন দলের জোট থেকে কে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সুযোগ পাবেন, তা রাষ্ট্রপতিই নির্ধারণ করবেন।এ ধরনের পরিস্থিতি হয়েছিল ১৯৯১ সালের নির্বাচনের পর। তখন রাষ্ট্রপতি নিজের বিবেচনা বোধ থেকে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। রাষ্ট্রপতি অনুরোধ করলে যেকোনো বিষয় মন্ত্রিসভায় বিবেচনার জন্য প্রধানমন্ত্রী পেশ করবেন। এই পরোক্ষ ক্ষমতার কথা বলা আছে সংবিধানের ৪৮ অনুচ্ছেদের ৫ নম্বর পরিচ্ছেদে।
আমার মনে হয় অন্যদের তুলনায় যদি কোনো একটি পদে আসীন ব্যক্তি বিশেষ সুবিধা লাভ করে থাকেন তবে ওই পদ অবশ্যই লাভজনক পদ হিসেবে বিবেচিত হবে। যেমন রাষ্ট্রপতি পদের আরো কিছু বিষয় আমরা তুলে ধরতে পারি। বলা হয়েছে কোনো আদালত, ট্রাইব্যুনাল বা অন্য কোনো কর্তৃপক্ষের দেওয়া যেকোনো দণ্ডের মার্জনা বা ক্ষমা করতে পারবেন রাষ্ট্রপতি। রাষ্ট্রপতিকে সংবিধানে এই ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।রাষ্ট্রপতিকে তাঁর দায়িত্বের ব্যাপারে কোনো আদালতে জবাবদিহিও করতে হবে না। রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময় তাঁর বিরুদ্ধে কোনো আদালতে কোনো প্রকার ফৌজদারি মামলা করা যাবে না। তাঁকে গ্রেপ্তারের বা কারাগারে নেওয়ার জন্য কোনো আদালত থেকে পরোয়ানা জারি করা যাবে না। যিনি এতো সব সুযোগ সুবিধা ভোগ করেন সেই পদকে কোন যুক্তিতে শুধুমাত্র সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদকে উদাহরণ হিসেবে টেনে এনে রাষ্ট্রপতি পদকে অলাভজনক হিসেবে আখ্যায়িত করা হচ্ছে তা ভাবার বিষয়। কী আছে সেই ৬৬ নং অনুচ্ছেদে? আইন বিশেষজ্ঞ না হয়েও আমি যতটা বুঝেছি তা হলো ৬৬ অনুচ্ছেদে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার যোগ্যতা ও অযোগ্যতা সম্পর্কে বলা রয়েছে। সেই অনুচ্ছেদ অনুসারে, ‘কোনো ব্যক্তি কেবল রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার, মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী হইবার কারণে প্রজাতন্ত্রের কর্মে কোনো লাভজনক পদে অধিষ্ঠিত বলিয়া গণ্য হইবেন না।’ যদি রাষ্ট্রপতি পদ লাভজনক না হয় তাহলে লাভজনক পদ বলেতো কোথাও কিছু থাকারই কথা না।
প্রাসঙ্গিক নয় তবুও কিছু কথা এখানে উল্লেখ করতে চাই। প্রায় নিশ্চিত ভাবে যিনি দেশের ২২ তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচিত হতে চলেছেন তাঁর নাম মো. সাহাবুদ্দিন। আপনারা অনেকে জানেন এবং কেউ কেউ জানেন না আর তা হলো, চট্টগ্রামের জেএমসি বিল্ডার্সের পক্ষে ২০১৭ সালের জুনে মো. সাহাবুদ্দিন ইসলামী ব্যাংকের পরিচালক নিযুক্ত হন এবং এরপর তিনি ভাইস চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পান। এত দিন একই পদে বহাল ছিলেন। রাষ্ট্রপতি পদে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাওয়ার পর তিনি ব্যাংকটি থেকে পদত্যাগ করেন। একদিকে ইসলামী ব্যাংক এবং সমগোত্রীয় ব্যাংকের যে বিরাট আর্থিক কেলেঙ্কারি জাতির সামনে উন্মোচিত হয়েছে সেটা কখনো ভুলে যাবার কথা নয়। আবার সেই প্রতিষ্ঠানের ভাইস চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করা একজনকে ক্ষমতাসীন সরকার রাষ্ট্রপতি পদে মনোনয়ন দিয়েছে। উল্লেখ্য, জনাব ওবায়দুল কাদের আবার এক ধাপ এগিয়ে বলেছেন “ আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রপতি পদে কোনো ইয়েস উদ্দীনকে মনোনয়ন দেয়নি। এমন ব্যক্তিকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে, যার গোটা জীবনটাই বর্ণাঢ্য”।
মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিনকে রাষ্ট্রপতি পদে মনোনয়ন দেওয়ার পর প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে সাংবাদিকদের সামনে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, আওয়ামী লীগ জোর করে ক্ষমতায় রয়েছে। এ কারণে তারা (আওয়ামী লীগ) কাকে রাষ্ট্রপতি বানাচ্ছে, তাতে বিএনপির আগ্রহ দেখানোর কিছু নেই। এর জবাবেও কথা বলতে দেরি করেননি জনাব কাদের। তিনি বলেছেন ‘এখানে তাদের আগ্রহ থাকবে না। দেশের সংবিধানে, গণতন্ত্রে তাদের কোনো আগ্রহ নেই। গণতন্ত্র ও সংবিধানে আগ্রহ না থাকে তাহলে রাষ্ট্রপতি কে হলো না হলো, তা নিয়ে তাদের আগ্রহ না থাকারই কথা। এ নিয়ে আমরা অবাক হইনি ’। জনাব কাদেরের এই কথার প্রেক্ষিতে স্বাধীন দেশের একজন সাধারণ চিন্তাশীল নাগরিক হিসেবে আমি বলতে চাই বিএনপি এসব নিয়ে চিন্তা না করলেও,খোঁজ না রাখলেও আমরা রাখি। আর তাই প্রশ্ন তুলতে চাই বিশাল আর্থিক কেলেঙ্কারি ঘটেছে এমন প্রতিষ্ঠানে যিনি ভাইস চেয়ারম্যান পদে দায়িত্ব পালন করেছেন তাকে কেন আওয়ামীলীগ মনোনয়ন দিল? এর পেছনে যুক্তি কী? তিনি বঙ্গবন্ধুর প্রিয় পাত্র, ছাত্রলীগ করতেন, আওয়ামীলীগের হয়ে কাজ করেছেন,মুক্তিযোদ্ধা এটুকু তথ্যতো আমরা জানি। যা জানি না সেসব জানতে চাই। কারণ উপরের তথ্য বিবেচনায় রাষ্ট্রপতি নিয়োগে তিনি প্রাধান্য পেলে আমি বলতে চাই তার চেয়েও বেশি প্রিয় পাত্র ছিলেন জনাব তোফায়েল আহমেদ। তারচেয়েও বেশি আওয়ামীলীগের জন্য কাজ করেছেন তোফায়েল আহমেদ। তারচেয়েও বেশি জনপ্রিয় এবং দল অন্তপ্রাণ ছিলেন মতিয়া চৌধুরী। তারচেয়েও জনপ্রিয় রাজনীতিবিদ এবং পরিচিত মুখ অনেকেই আছে। এতো কিছুর পরও তারা কেউ নয় বরং দলীয় বিবেচনা গিয়ে পড়লো ইসলামী ব্যাংকের অর্থ কেলেঙ্কারির সময়ে ভাইস চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করা মো. সাহাবুদ্দিনের উপর। এই বিষয়টি আমার সবচেয়ে বিস্ময়কর লেগেছে। আর এ কারণেই আমি জনাব কাদেরের বক্তব্যের সাথে একমত নই। যে বক্তব্যে তিনি বলেছেন “ আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রপতি পদে কোনো ইয়েস উদ্দীনকে মনোনয়ন দেয়নি। এমন ব্যক্তিকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে, যার গোটা জীবনটাই বর্ণাঢ্য”।
-ইবনে মোশাররফ
১৪ ফেব্রুয়ারী ২০২৩