নূরজাহান নীরা
সমবয়সী সহকর্মীদের ডাকতে ডাকতে নিজেই অনেকটা খড়কুটো একত্রিত করেছে সুরুজ।আশপাশে পড়ে থাকা কাগজ,কাপড়, পলিথিন সব এক জায়গায় এনে তাতে আগুন জ্বালিয়ে দেয়।সারাদিন গোসলের সুযোগ থাকে না।সেই সকালে দুটো খেয়ে কাজে বের হয়। আর কাজ শেষে সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে গোসল করতে হয়।অনেক সময় গোসল করতে ইচ্ছে করে না।কিন্তু গ্যারেজের কাজ গায়ে ময়লা থাকে প্রচুর।এই শীতে গোসলের পর কাঁপুনি উঠে যায়।আগুন না পোহালে আর উপায় থাকে না। তারউপর ক’দিন ধরে শীতটা একটু বেশিই পড়ছে।গোসল সেরে খেয়ে আগুন পোহাতে বসে তারা। সহকর্মীরা একসাথেই এক বস্তীতে থাকে।এক সাথেই কাজ করে। আগুন জ্বালাতে জ্বালাতে সবাই এসে হাজির হয়।আগুনে হাত ছেঁকে সে হাত মুখে লাগিয়ে তাপ নেয় সবাই।পলিথিনের আগুন কুন্ডলী পাকিয়ে বাড়তে থাকে। আগুনের ছটা সুরুজের চোখে এসে পড়ে।জ্বলজ্বল করতে থাকে অশ্রুর ফোটা।চোখের টলটলে জলের সাথে আগুন যেনো আরো বাড়তে থাকে। বাবার মুখটা বারবার ভেসে ওঠে সে জলের মাঝে।সুরুজের বাবা মারা গেছে এখনো মাস কাটেনি।ধনী লোক মারা গেলে তাদের দিন তারিখ সবাই মনে রাখে।চল্লিশা হয়।মিলাদ পড়ায়।খরচা করে আত্মীয় স্বজন খাওয়ায়।আত্মীয় স্বজন এসে পাশে দাঁড়ায়। শান্তনা দেয়।কিন্তু সুরুজের মাথায় হাত রেখে কেউ শান্তনা দেয়নি।জানতেও চায়নি কেউ তাদের কথা।শুধু সুরুজ মনে রেখেছে বাবার সব কথা।মৃত্যুর দিন তারিখ সব। প্রতিদিন ঘুমাতে গেলে মা ছেলে হিসাব করে আজ এতদিন হলো কাল ওতোদিন হবে।চোখের জল অঝর ধারায় পড়তে থাকে সুরুজের।সুরুজের সহকর্মীরা শান্তনা দেয়।কান্দিস না সুরুজ। আমার বাপে মরছে না আছে জানি না।মায় কয়, কই জানি চইলা গেছে।বিটটুর কথা শুনে ছলিম বলে,আমার বাপেও এক বেডির লগে চইলা গেছে আমি মায়ের প্যাডে থাকতে।আর ফিইরা আহে নায়।মন্টা উঠে সুরুজের চোখের পানি মুছে দেয়।ওরা শিশু। নয় বা দশ বছরের ওরা।ওদের জগতে ওরা বড়।ছোটকালের গল্প করে ওরা।মনে হয় এখন কত বড় হয়েছে।মানুষ যত বাস্তবতার মুখোমুখি হয়,তত শিখে জ্ঞানী হয়।যত সংগ্রাম করে তত সমৃদ্ধ হয়।তাইতো বস্তির এই ছিন্নমূল শিশুদের মাঝেও সে পরিবর্তন অনেকটা এসে যায় বড়দের মত অল্প বয়সেই।কোনো কথাতেই সুরুজের মন শান্ত হয় না।বাবা খুব ভালোবাসতো তাকে।যত রাতেই বাড়ি ফিরুক সুরুজকে সাথে নিয়ে খেতে বসত।মুখে তুলে খাইয়ে দিত।সুরুজ ঘুম চোখে খেতে খেতে বাবার কোলে ঢলে পড়ত।সুরুজের সব আবদার পূরণ করত তার বাবা।গত বছরই বলেছিল একটা লাল জ্যাকেট কিনে দিবে।আগের জ্যাকেট ছোট হয়ে গেছে। তখন বাবাই তাকে বলেছিল, একটু ধৈর্য ধরতে।ক’দিন পরেই কিনে দিবে।তখন টাকায় কুলিয়ে উঠতে পারেনি।যখনই টাকা জমানো শুরু করেছে তখনই কোনো না কোনো সমস্যা তৈরি হয়েছে। হয় রিকসা নষ্ট হবে,না হয় মা অসুস্থ, অথবা সুরুজের বাবা।বাবা শান্তনা দিয়ে বলেছিল,একটু ছোড তাতে কি? দ্যাখতে সুন্দর লাগে।এই বছর পর্।সামনের বছর কিইনা দিমু। এবার শীত শুরুর আগেই কেনার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। বর্তমান বাজারের যা অবস্থা তাতে সংসারের খরচ চালিয়ে টাকা জমানো কষ্টই ছিলো।তবুও ছেলের জন্য এটা দরকার। প্রতিদিন রাতে এসে টাকা দিত সুরুজের হাতে মাটির ব্যাংকে জমানোর জন্য। সুরুজের মনে সেকি আনন্দ!এবার নতুন জ্যাকেট পাবে।শেষবারের মত যেদিন রিকসা নিয়ে বের হয় সেদিন সুরুজের বাবা চুপিচুপি বলেছিল, দুপুরে পনরো ট্যাহার ভাত খাইতাম।কয়দিন ধইরা একটা কেক খাই।না অইলে ট্যাহা জমাইতে পারমু না।বাবা মায়ের এই কথা সুরুজ শুনেছিল আড়াল থেকে। সেই মুখটা সুরুজের খুব মনে পড়ে। আর কথা শোনা হয়নি বাবার মুখে।সারাদিন সারারাত কেটে যায়। পরের দিন হাসপাতাল থেকে আসে বাবার লাশ।কোনো বড় গাড়ি ধাক্কা দিয়েছিল। সুরুজ মনে মনে অভিশাপ দিতে থাকে যারা তার বাবাকে গাড়ি চাপা দিয়ে মেরেছে। বাবার সাথে দাফন করে দেয় সব শখ ও স্বপ্ন। আগুনের শিখা আরো বেড়েছে এতক্ষণে। সুরুজ পলকহীন তাকিয়ে থাকে সেদিকে। আগুনের শিখায় কুন্ডলী পাকিয়ে উঠতে থাকে লাল জ্যাকেট ও বাবার মুখ।