Thursday, November 21, 2024

আড়াইশো টাকা 

মিজানুর রহমান

১.

মনে মনে হিসেব কষছি— বড় আপুকে জামা দুটো দিয়ে কতটা টাকা নেব। হাজার? না, হাজার টাকা কম হয়ে যায়। ও দামে দিলে আমার লোকসান গুণতে হবে। তবে কি আঠারো শ টাকায় দেব? নয় শ করে দুটো আঠারো শ। মার্কেটে স্বাভাবিক যে দামে বিকি-কিনি হয় সে দামেই।

রিয়াদকে জিজ্ঞেস করলাম— তোমার জামা দুটো কাকে দেবে? ওর কপালে তিনটে ভাঁজ পড়ে গেল। ভ্রু কুঞ্চিত করে ঈষৎ ভেবে বলল— আমার তো বোন নেই! ভাবছি, জামা দুটো ভাবিকে দেব।

২.

দীর্ঘ এক সপ্তাহ পর সবে আজ ক্যাম্পাসে এসেছি। আমি যে বিল্ডিংটায় থাকি সে বিল্ডিং, তার সামনের নারকেল গাছগুলো, আমার পড়ার টেবিল, সবকিছুই কেমন জানি বিষাদ লাগছে। গত এক সপ্তাহের কাটানো মুহূর্তগুলো ক্ষণে ক্ষণে মনে পড়ছে। সেই সকালে বাড়ি থেকে এসেছি, দুপুর গড়িয়ে এখন বিকেল ; তবু মনের বিষণ্নতা কাটছে না। ইত্যবসরে রিয়াদ বলল— চলো, শহরে যাই ; কিছু কেনাকাটা করতে হবে। ওজরখাহি করলাম— মনটা ভাল নেই। তুমিই যাও, আমি যাব না। পরগাছা যেমন মূল কাণ্ডের দেহাবয়ব পেঁচে ধরে থাকে, ঠিক সেভাবে ও আমাকে চেপে ধরল শহরে যেতে। আমি আর না করতে পারলাম না।

৩.

পুরো মার্কেট চষে বেড়ালাম। মনের মত একটা লুঙ্গিও খুঁজে পেলাম না। কোথাও রঙ মেলে তো ডিজাইন মেলে না, আবার কোথাও ডিজাইন মেলে তো রঙ মেলে না। সে কী যে এক বিরক্তিকর অবস্থা! রিয়াদ ছেলেটা একটু খুঁতখুঁতে স্বভাবের। যেনতেন কাপড় ও কিনবেই না। দরকার হলে হাজারটা দোকান ঘুরবে ; তবু ওর স্ট্যান্ডার্ড কালার, আকর্ষণীয় ডিজাইনটাই চাই। এই যেমন আজকের কথাই বলি। অ্যাঁশ কালারের স্টাইপের লুঙ্গি খুঁজছে, কিন্তু পাচ্ছে না। রাজ্যের বিরক্তি নিয়ে শেষবারের মত গলির মাথায় এক দোকানে গেলাম। দোকানী হাসিহাসি মুখ করে লুঙ্গির গাঁট বের করে দিলেন। উল্টেপাল্টে সব দেখতে লাগলাম। ডিজাইন ঠিক আছে তবে কালার মিলছে না। মন চাইছে না আর কয়টা দোকান ঘুরে দেখি। বাধ্য হয়ে রিয়াদকে শুকনো মুখে বললাম— “যে কয়টা আছে এর মধ্যে থেকেই একটা নিয়ে নাও। আমি ভাই মাফ চাই, আর কোনো দোকান ঘুরে দেখতে পারব না।” রিয়াদ সাধারণত ওর পছন্দসই না হলে কাপড় কিনতে চায় না। কোনো এক বিচিত্র কারণে আজ রাজি হল।

থানা মোড়ের সামনে লম্বালম্বি যে ফুটপাত রয়েছে আমরা সেখানটায় দাঁড়িয়ে আছি। এতক্ষণের এই চরকি পাকে দেহ-মন একরকম তেতো হয়ে গেছে। শহরের কোলাহল, অবিরাম গাড়ির হর্ন, মানুষের গাদাগাদি, অসহনীয় গরম— সবকিছু মিলে এক বিতিকিচ্ছিরি অবস্থা। পাশেই ছোটখাটো একটা খাবারের দোকান। শুনেছি আহার কার্য না-কি মানুষের কাজের উদ্যমতা ফিরিয়ে দেয়। আমরা দুজন কাজের উদ্যমতা ফেরাতে সেই দোকানে ঢুকে পড়লাম।

৪.

বেশ ফুরফুরে লাগছে। বলতে গেলে কাজের উদ্যমতা একদম ফিরে এসেছে। ইতিউতি না করে সোজা সাত মাথার দিকে পা বাড়ালাম। অনেকদিন ধরে ভাবছি একটা আংটি কিনব। আজ কিনব কাল কিনব করে করে আজও কেনা হয়নি। আজ যখন সুযোগ পেয়েছি কিনে তবেই যাব। বাটার শো-রুমের সামনে চলে এসেছি ইতোমধ্যে। কে জানি পেছন থেকে কানের কাছে এসে বলল— “থ্রি-পিছ নেবেন? আমার কাছে চারটে থ্রি-পিছ আছে। বনানীতে এক হোন্ডার পেছন থেকে মেরে দিছি। বারো শ টেকা করে চারটে আটচল্লিশ শ টেকা। সেখান থেকে আড়াই হাজার টেকা দিলেই দিমু।” চেয়ে দেখি কালো বর্ণের বেঁটেখাটো একটা মানুষ। গাল ভাঙা চেহারা। চোখ দুটো কোটরের মধ্যে ঢুকে গেছে। পরনে লুঙ্গি আর হাফ হাতা শার্ট। ডান হাতে একটা নতুন ব্যাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মনে মনে ভাবলাম, চেহারা সুরতের যে অবস্থা ; নির্ঘাত গঞ্জিকাসেবী হবে। নেওয়ার ইচ্ছে নেই, তবু বাজিয়ে দেখার জন্য বললাম— দুই শ টাকা দেব, দেবেন? কী কন মামা, দুই শ টেকা দিয়ে কেউ কী চারটে জামা দেয়! ‘থাক, তাহলে নেব না’ বলে উল্টো পথে হাঁটা দিলাম।

আমি আর রিয়াদ আবার থানা মোড় যাচ্ছি। ওখান থেকে ডানে মোড় ঘুরে কিছুক্ষণ হাঁটলেই চুড়িপট্টি। প্রথমে ভেবেছিলাম, সাত মাথা খোলা বাজার থেকে আংটি কিনব। পাছে কী জানি মনে করে সিদ্ধান্ত পাল্টে এখন আবার চুড়িপট্টি যাচ্ছি। ইত্যবসরে রিয়াদ বলল— “ওসব জামা-কাপড় কেনা ঠিক হবে না। আমাদের ধর্মে চুরির মাল কেনা-বেচার অনুমতি নাই। কিনলে গুনাহ হবে।” মামা, যত গুনাহ হয় সব আমি দেখে নেব। আপনাদের কোনো টেনশন নাই— কথার আকস্মিকতায় পেছনে তাকালাম। দেখি, সেই লোকটা আমাদের পেছন পেছন আসছে। আড়ি পেতে এতক্ষণ ধরে আমাদের কথোপকথন শুনছিল। ‘আপনি যা-ই বলেন না কেন আমরা থ্রি-পিছ নেব না’ বলে হাঁটা ধরলাম। লোকটাও আমাদের পেছন পেছন আসতে লাগল। কিছুদূর যাওয়ার পর হঠাৎ কী জানি মনে হল। বাহ্যিকভাবে ধর্মের নিষেধাজ্ঞার কথা মনে থাকলেও হয়তোবা অবচেতন মনে লোভ জেগে উঠল। পেছন ফিরে লোকটাকে বললাম— এক দাম পাঁচ শ টাকা দেব। দিলে দেন, না দিলে যান গা। ‘আচ্ছা নেন’ বলে লোকটা এমনভাবে ব্যাগ এগিয়ে দিল যেন পাঁচ শ টাকায় তার বিরাট লোকসান হয়ে যাচ্ছে। ব্যাগ খুলে চেক করতেই দেখি চারটে নতুন প্যাকেট একসাথে বাঁধা। খুশিতে আমাদের লোলুপ দৃষ্টি চকচক করতে লাগল।

৫.

দুজনে মহাখুশি। বিনা পরিশ্রমে রত্ন ভাণ্ডার হস্তগত হলে কেউ যেরকম খুশি হয় ঠিক সেরকম খুশি হয়েছি। লোকটির কথা আলোচনা করছি আর খিলখিল করে হেসে উঠছি। আমাদের হাসি শহরের যান্ত্রিকতার আওয়াজ ছাপিয়ে কারো কানে গিয়ে পৌঁছাচ্ছে না। কীসের আংটি কেনা কীসের কী। আনন্দের আতিশয্যে সোজা অটোতে চেপে বসলাম ক্যাম্পাসে যাব বলে। সর্পিল পথ ধরে অটো আমাদের নিয়ে এগুতে থাকল। কতদূর চলে এসেছি সেদিকে কোনোই খেয়াল নেই। অপলক নেত্রে রাতের শহর দেখছি আর ঠোঁট টিপে দুষ্টু হাসি দিচ্ছি। মনে মনে ভাবছি এই তো মোক্ষম সুযোগ বড় আপুকে জামা দুটো দিয়ে মোটা অংকের টাকা খসানোর।

ক্যাম্পাসে চলে এসেছি। চটজলদি হলরুমে গিয়ে ফ্যান ছেড়ে দিলাম। যা গরম পড়েছে! আর তর সইছে না। ব্যাগ থেকে কাপড়ের গাঁট বের করে দড়ি খুলতে লাগলাম। একটা একটা করে সব উল্টেপাল্টে দেখলাম। কাপড়ের স্টিকারগুলো কী সুন্দর চকচক করছে! ভাবলাম, কে কোনটা নেব সেটার ভাগ পরে হবে। আগে কাপড়গুলো হাত দিয়ে নেড়েচেড়ে দেখি। প্যাকেট খুলতেই চোখ কপালে উঠে এল। দেখি, সবগুলোই পুরাতন ছেঁড়া-ফাঁটা কাপড়। নতুন প্যাকেটে সেগুলো এমনভাবে মোড়ানো হয়েছে দেখে বোঝার জো নেই। আমাদের মুখ দিয়ে আর কোনো কথা বেরুল না। মুহূর্তেই দুজন হাসিখুশি মানুষ কেমন নীরব-নিথর হয়ে গেলাম। শিরদাঁড়া বেয়ে ঘামের স্রোত বইতে লাগল। এমন রাম ধরা জীবনে খাইনি। ধাতস্থ হতে খানিকক্ষণ সময় লাগল। কান ধরে চিমটি কাটলাম আর জীবনে চুরির মাল কিনব না। শরিয়তের বিধিনিষেধ উপেক্ষা করে প্রবৃত্তির অনুসরণ করব না।

৬.

ঠিক এক সপ্তাহ পর। আমি আর রিয়াদ রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে আছি। হাতে সেই কাপড়ের ব্যাগ। পাশ দিয়ে বয়ে গেছে পৌরসভার ড্রেন। ড্রেন থেকে পঁচা দুর্গন্ধ আসছে। বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা কষ্টসাধ্য ব্যাপার। চটজলদি নিজেদের কাজ সারতে হবে। আশেপাশে কেউ দেখছি কি-না একবার ভাল করে পরখ করে নিলাম। সুযোগ বুঝে ড্রেনের কালো কুটকুটে পানিতে ব্যাগটা ফেলে দিলাম। সঙ্গে সঙ্গে বুদবুদ উঠে পঁচা কাদার ভেতর তলিয়ে গেল ব্যাগটা। আমি তাকিয়ে আছি আমার তলিয়ে যাওয়া ব্যাগটির দিকে আর মনে মনে যোগ-বিয়োগ করছি— এ মাসের হাত খরচ থেকে আড়াইশো টাকা বাদ দিলে আর কত টাকা থাকে।

Facebook Comments Box
RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments