10 C
New York
Friday, April 19, 2024
spot_img

হরলিকস খেয়েছি বুদ্ধি বাড়েনি

যখন ছোট ছিলাম, টিভি চ্যানেল ছিলো একটাই- বিটিভি৷ সেই একই জিনিস দিনভর দেখতে দেখতে মুখস্ত হয়ে গিয়েছিল বিজ্ঞাপনের নানা জিঙ্গেলও৷ এখন মনে পড়ে, পড়াশোনা শুরু করার পর বাবা বিশাল একটা হরলিকসের বয়াম নিয়ে এলেন, বুদ্ধি বাড়াতে৷

আমার আশেপাশের অনেক মানুষকেই দেখেছি জীবনে কখনও হরলিকস না খাওয়ার পরও আমার চেয়ে টলার, স্ট্রংগ্রার এবং শার্পার হয়েছেন৷ আমার বুদ্ধি যে খুব একটা বাড়েনি, সেটা জীবনের নানা অভিজ্ঞতা থেকে ভালোই উপলব্ধি করতে পেরেছি৷ হরলিকস না খেলেও যে এর চেয়ে কম বুদ্ধি হতে পারতো, তা মনে হয় না৷

মায়ের মুখে শুনেছি, আমার সবচেয়ে পছন্দ ছিল চান্দা ব্যাটারির বিজ্ঞাপন৷ অনেক ছোট ছিলাম, বোঝার বয়স ছিল না৷ তাই যখনই ব্যাটারির বিজ্ঞাপন দেখাতো, টিভির সামনে গিয়ে নাচতে শুরু করতাম, ‘‘তান্দা তান্দা’ বলে৷ এরপর বাসায় ব্যাটারির কোনো প্রয়োজন না থাকলেও নাকি রীতিমতো শিশুসুলভ চাপ প্রয়োগ করে, কান্নাকাটির ভয় দেখিয়ে সেই ‘তান্দা’ ব্যাটারি বাবাকে দিয়ে কিনে আনিয়েছিলাম৷

এ তো গেলো শিশুদের কথা৷ বড়দের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা কেমন হয়? কোন পণ্যটা ভালো, কোনটা খারাপ, আমরা কীভাবে নির্ধারণ করি? বিজ্ঞাপন আমাদের কী শেখায়, এর কতোটুকু আমরা বিশ্বাস করি?

এ প্রসঙ্গে একটা গল্পের কথা মনে পড়ছে৷ সত্যি মিথ্যে জানি না৷ কিন্তু আমার ধারণা, এটা গল্প হলেও বাস্তবেই ঠিক এমনটাই ঘটে থাকে৷ গল্পটা এমন:

মার্কেটিং ক্লাসে শিক্ষক একবার ছাত্রদের অ্যাসাইনমেন্ট দিলেন, টুথপেস্টের দাম না কমিয়ে, পরিমাণ একই রেখে, বিজ্ঞাপনে খরচ না করে টুথপেস্টের বিক্রি বাড়াতে হবে৷

কয়েকদিন পর, অনেক গবেষণা করে নানা ধরনের পদ্ধতি কাগজে লিখে জমা দিলেন শিক্ষার্থীরা৷ তবে কেউই বাড়তি খরচ ছাড়া বিক্রি বাড়ানোর কোনো উপায় বাতলাতে পারলেন না৷

শিক্ষক দেখালেন, কিছু না করে, শুধু টুথপেস্টের টিউব তৈরির সময় যদি মুখটা একটু বড় করে দেয়া যায়, তাহলেই বিক্রি বেড়ে যায় প্রায় ২০ শতাংশ৷ যুক্তি হিসেবে তিনি দেখিয়েছিলেন, বিজ্ঞাপন দেখে দেখে মানুষের অভ্যস্ততা হলো টুথব্রাশের পুরোটা জুড়ে পেস্ট নেয়া৷ কিন্তু বিজ্ঞাপনে যে পরিমাণ পুরু করে পেস্ট নেয়া দেখানো হয়, চালাকি করে ভোক্তারা তারচেয়ে কম পুরুত্বের পেস্ট ব্যবহার করেন৷ কিন্তু যদি টিউবের মুখের ব্যাস অল্প বাড়িয়ে দেয়া যায়, তাহলে টিউবে সমান চাপ দিলে পেস্ট বের হবে বেশি৷ ফলে খরচও হবে বেশি৷ আগে যে পেস্ট চলতো এক মাস, নতুন টিউব চলবে ২৫ দিন৷ ফলে বাড়বে টুথপেস্টের বিক্রি৷

বিজ্ঞাপন ছাড়া আমরা জানতে পারি না, কোন পণ্য ভালো, কোনটা খারাপ৷ কিন্তু সেই বিজ্ঞাপনই আবার আমাদের নিজেদের পণ্য গছিয়ে দেয়ার জন্য গালভরা মিথ্যা প্রলোভনও দেখিয়ে থাকে৷ আমরা বিশ্বাস করতে না চাইলেও, মনস্তত্ত্বের কারণে শেষ পর্যন্ত তাতে প্রাভাবিত হয়ে যাই৷

আমাদের কাছে তখন মনে হয় কালো মেয়েদের যেহেতু ভালো বর পাওয়া যাবে না, ফেয়ার অ্যান্ড লাভলি দিয়ে তাকে ফরসা বানিয়ে বিয়ে দিতে হবে৷ সেই কালো মেয়ে সাত দিনে ফর্সা হওয়ার আশায় এই ফেয়ারনেস ক্রিম মেখে, প্রতিদিন একবার আয়নার দিকে তাকিয়ে পরে হাল ছেড়ে দেয়৷ এরপর একসময় গরীবের মেয়ে ভালো কোম্পানির ট্যালকম পাউডার, আর বড় লোকের মেয়ে ম্যাক কোম্পানির মেকআপ মেখে মুখ চুনকাম করে বিয়ে করে ফেলে৷

ছেলেরাও গন্ধ যাই হোক, ব্যবহার করা চাই সবচেয়ে ভালো ব্র্যান্ডের পারফিউম৷ শেভ করার জন্য ক্রিম যথেষ্ট হলেও ‘ম্যানলি এবং মাচো’ ভাব আনার জন্য জিলেটের ‘কুল’ জেল, ‘ম্যাক থ্রি’ রেজর আর ব্লেড ব্যবহার করতে হয়৷

অনুপম দেব কানুনজ্ঞ, ডয়চে ভেলে

বিজ্ঞাপনের কারণেই আমরা এখনও বিশ্বাস করি কোকাকোলা ‘জিরো’তে আসলে কোনো চিনি নেই৷ অথবা, বাজারের বিভিন্ন ফ্রুট জুসে আসলেই ফ্রুট আছে, কোনো কৃত্রিম খাদ্যদ্রব্য নেই৷

২০০৯ সালে ভারতে ঘটেছিল মজার এক ঘটনা৷ বৈভব বেদী নামের ২৬ বছরের এক যুবক আদালতে মামলা করে দেন বিখ্যাত ডিওডরেন্ট ব্র্যান্ড ‘এইক্স’-এর বিরুদ্ধে৷ তাঁর অভিযোগ ছিল, এইক্স-এর বিজ্ঞাপনে দেখা হয়, কোনো এক পুরুষ গায়ে এই ব্র্যান্ডের বডি স্প্রে দেয়ার পর অর্ধনগ্ন নারীরা ছুটে আসেন৷

কিন্তু বৈভবের অভিযোগ, সাত বছর ধরে তিনি এইক্স ব্যবহার করছেন, কিন্তু তার কোনো বান্ধবীই নেই৷

শেষ পর্যন্ত সে মামলার ফল কী হয়েছে, জানি না৷ কিন্তু দিনের পর দিন হরলিকস খাওয়ার পরও আমার যে বুদ্ধি অন্যদের চেয়ে তেমন একটা বাড়েনি, এজন্য কি একটা মামলা করা উচিত?

অনুপম দেব কানুনজ্ঞ, ডয়চে ভেলে

Facebook Comments Box

বিষয় ভিত্তিক পোস্ট

শহীদুল ইসলামspot_img

সাম্প্রতিক পোস্ট