Wednesday, October 9, 2024
spot_imgspot_img
Homeসাহিত্যগল্পকোথাও কেউ নেই

কোথাও কেউ নেই

১.

সকাল নয়টার সময় একটা মেসেজ আসে ফোনে। রশিদ আধ আধ ঘুমের মধ্যে ফোনটি ধরতে গিয়ে টেবিল থেকে পড়ে যায় ফ্লোরে। খাট থেকে টেবিলের দূরত্ব বেশ কম,মাথা বরাবর সোজা উত্তর দিকে। হাতটি হালকা সোজা করলেই ফোনটি ধরা যায় তবুও সে ঠিক মতো নাগাল পাইনি।

 অনেক দিন পর সালেহ সাথে দেখা। ইউনিভার্সিটি লাইফের সময় তাদের সম্পর্ক ছিল বেশ দহরমমহরম। কতো স্মৃতি জড়িয়ে আছে তাদের অন্তরায়।আজ কিছুটা স্মৃতি ভাগাভাগির সময় এসেছে। কিরে রশিদ এখনো কি সেই কবিতা আর গল্প নিয়েই আছিস, জীবন নিয়ে তুই একটু সিরিয়াস হইলি না।আর কতো কবিতা, কবিতা নিয়ে পড়ে থাকবি, এখন কবিতার যুগ না। কবিতা এখন কেউ পড়ে নাকি, মানুষ ব্যস্ত নেট দুনিয়া নিয়ে।

 চল তোরে একটা ভালো যায়গায় নিয়ে যাই, অনেক দিন পর দেখা। একটু চিল করে আসি। 

রশিদ আর সালেহ দুজনে একটা রিক্সা করে যাচ্ছে।কিরে রশিদ কথা বলছিস না যে,কি বলবো বন্ধু? 

জীবনের কথা এখন শুধু কবিতায় লেখি, মুখে বলার কোন ভাষা নেই।মুখের কথা বন্ধ করে দিছি, মুখ তো সর্বদা ভালো কথা বলে না।

যদি তুই মুখে বলিস লোকে শোনে না, যদি তুই কবিতাই লেখিস কিছু তো পড়ে বা জানে। তাই মুখ কে আপাতত বন্ধ করে দিছি।

সালেহ হাহ হাহ তুই তো সেই আগের মতোই রইলি। অনেক চেষ্টা করেছি পরিবর্তন হতে, কি করবো বল? 

কবিতার নেশা এক অদ্ভুত নেশা, নারীর যৌনতার ,মাদকের নেশার চেয়েও বড়।

 তোর কবিতা মাঝেমাঝে পড়ি, ভালোই লেখিস এখন। চালিয়ে যা, কবি হতে অনেক দূর পথ অতিক্রম করতে হয়।তুই পারবি। 

চল নেমে যাই চলে আসছি,রিক্সা ভাড়া দিয়ে, একটা সরু গলির দিয়ে হাটতে হাটতে  কদমতলী বার সেন্টারে দুজনে ডুকে পড়লো। রশিদ কোনটা হবে বল,অনেক দিন পর, হুইস্কি। ওকে। তোর খবর কী? এইতো চলছে বউ ছেলেপুলে নিয়ে। আর ভালো লাগে না সংসার জীবন, আগের জীবনই ভালো ছিলো।দুজনে পান করছে আর কথা বলছে, জীবন আর সংসার নিয়ে।

রশিদ আজ আর খাবো না চল,একটু বেশি বেশি মনে হচ্ছে, আগের মত আর হয় না বন্ধু। দুজনে বার থেকে বের হয়ে, সালেহ একটা সিএনজি নিয়ে চলে গেলো। রশিদ রিকশা নিয়ে বাসায় দিকে আসতেছে, মাঝেমাঝে রিকশা ঝাঁকুনিতে রশিদের পেটে যা আছে সব বের হওয়ার উপক্রম হচ্ছে। অনেক দিন পর, নেশা একটু বেশি ধরেছে। আকাশ বাতাসের মধ্যে মনে হচ্ছে বাসর রাতে মিলন হচ্ছে।

 এই দিকে রাস্তার ড্রেনে ভেসে যাওয়া মলমূত্রাদি দুর্গন্ধ আর মুখের দুর্গন্ধ একই রূপ ধারণ করছে। কোন রকম ঢলতে ঢলতে বাসায় এসেই চিৎ হয়ে শুয়ে পড়লো রশিদ। 

২.

শূন্য ঘরে একবার মনে হলো রশিদের রুমির কথা।রুমি এখন কি করছে?এখন যে তারে খুব বেশি প্রয়োজন। সে কি বুঝতে পারছে তার কথা,নাকি শুনছে না তার অব্যক্ত বাসনা।

শোবার সঙ্গে সঙ্গে ঘুরতে লাগলো শ্যাওলা পড়া ছাদ,শেড দেওয়া বাতি থেকে উর্ধমুখে বেরুনো আলোর চক্র, পর্দা টানা জানালাগুলো। 

কানের ভেতরে অতি উচ্চ গ্রামের কিছু শব্দ,তোলপাড় করতে লাগলো অবিরাম। এ শব্দ কিসের?  এইবার মনে হলো তার সে নৌকায় করে কোথাও যাচ্ছে,যেমন গতবার রাজিবপুর থেকে চিলমারী গিয়েছিল। আরেকবার ভাবলো সে ঢাকায় তার নিজের ঘরেই আছে। কোনটি সত্যি ভালো করে স্থির করার আগেই সে ঘুমিয়ে পড়লো।ঘুমিয়ে পড়লো না চৈতন্য হারালো সেটাও বির্তকের বিষয়। 

ফ্লোর থেকে ফোনটি তুলে দেখলো রুমির মেসেজ, সে নাকি আসছে বাসায়। রশিদ আহ্লাদে আটখানা হয়ে পড়ল,কতদিন পর দেখা হবে। কতো রাত ছিলো একই খাটে অথচ আজ সে অন্যের ঘরে। সবই ঈশ্বরের নিলা খেলা।ভাবতে ভাবতে নেশার ঘোর কেটে গেলো।

রশিদ পরিপাটি হয়ে অপেক্ষার প্রহর গুনছে, আর ভাবছে সেই সোনালি দিনের সূর্য ওঠা ভোরের কথা। সেই টসটসে রুমির গালে চুমুর কথা, জড়িয়ে ধরে নির্জনে কামনা বাসনা তৃপ্তির কথা।পুরনো দিন, পুরনো স্মৃতি সবই সূর্যের মতো আলোকিত।

কবিতা আমাকে কি দিলো? শুধু ভেঙে ভেঙে নিজেকে ছোটই করে যাচ্ছি। জ্বলতে জ্বলতে এখন সূর্যের আলোকে ফ্রিজে থাকা জলের মতো মনে হচ্ছে। 

রুমি এখনো আসছে না কেন? আমার তো দেরি সইছে না,দেরি শব্দটা বিরক্ত নেশার মতো

,শুনলে রক্ত টগবগ করে।

সর্বচ্চ সময় লাগে তার ত্রিশ মিনিট লাগবে অথচ প্রায় দুই ঘন্টা চলে গেলো। সে তো দেরি করার কথা না,সব সময় তো দ্রুত চলে আসে।

এই সব ভাবতে ভাবতে প্যান্ট, শার্ট পড়ে সে রেডি হলো, রাস্তার মোড় পর্যন্ত যাবে।

যাচ্ছে আর ভাবছে আজ তারে একটু অন্যরকম ফিলিংস দিবো, অনেক দিন পর, সময় একটু বেশি নিবো।কবিতার ছন্দের কথা এখন আর মনে পড়ছে না অথচ রাস্তার বের হলে মানুষের বহুরূপী ভাব দেখে আগে কত ছন্দ তৈরি হতো। তৃপ্তি বাসনার কাছে ছন্দ আত্মহত্যা করেছে।

রাস্তার মোড় পার হয়ে দেখে অনেক মানুষের ভিড়, আজকাল শহরে কিছু হলেই আন্দোলন মিছিল মিটিং। শহরের পরিবেশ এদের হাতেই দূষিত হচ্ছে, সাথে বেড়ে যাচ্ছে জনসাধারণের বিরক্তিকর ভোগান্তি, জ্যামে দীর্ঘ সময় বসে সরকারকে নিয়ে বির্তক প্রতিযোগিতা, কেউ হাত তালি, কেউ সুশাসনের গল্প বলেই যাচ্ছে। কেউ বিদ্রোহী বিপ্লবী ডাকের আহ্বানে বলে যাচ্ছে, এই শহর আন্দোলনের শহর, এই শহর শিক্ষার শহর। 

কবিতার ছন্দ খুঁজতে রশিদ সমাগম মানুষের দিকে যাচ্ছে, বেশ কিছু মানুষ চতুর্দিকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে, ভেতরে কি হচ্ছে সেটা দেখতে একটু উঁকি দিলো রশিদ।

সে দেখে বিস্মিত হয়ে গেছে, সে কি দেখছে! এটা তো হওয়ার কথা না,কিভাবে হলো, এতো দেখছি রুমি।

 হাতে আঙুর আর মিষ্টির বক্স, সে তো আমার জন্যই কিনেছে, আমাকে আদর করে খাওয়াবে। মস্তক থেকে বির বির করে রক্ত বের হচ্ছে, জামা আর রাস্তা যেন লাল রঙ দারণ করছে। কাছে গিয়ে কতো ডাকছি, কানে গিয়ে বলছি রুমি আমি আসছি, এই দেখো। কোন উত্তর পাচ্ছি না,তাহলে আমার রুমি কি চলে গেছে, না এটা তো হবার কথা না,সেতো যেতে পারে না, তাহলে আমার কবিতার ছন্দ কে দিবে, আমার ঘরে অসমাপ্ত আলো কে জ্বালাবে।

এই শহর মৃত্যুর শহর, এই শহরে কেউ সুস্থ্য মানুষ বাস করে না, অসুস্থ আর নোংরা এই শহরের আভিজাত্য। আমার রুমি এ ভাবে মরতে পারে না, দূর্ঘটনার বিচার এই শহরে নেই।এখানে মরতে আসো আর মারতে আসো এই শাসন চলে, যেটা অসভ্য জাতির উদাহরণ।

 প্রতিনিয়ত এই দুর্বিষহে,মানুষের জীবনের কোন নিরাপত্তা এই শহরে নেই।

রুমির মতো হাজারো মানুষ এই শহরে দূর্ঘটনায় মৃত্যু বরণ করে তবুও মানুষের মধ্যে কোন পরিবর্তন আসে না, আসে না কোন পরিবর্তিত কোন বিচার নামক কার্যবিধি।

এখনো আমি হাজার রুমিকে দেখতে পাই, রাস্তায় রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে নিথর দেহ,কোথাও কেউ নেই।

Facebook Comments Box
RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments