Saturday, November 23, 2024
Homeসাহিত্যগল্পমানিক জেনারেল স্টোর

মানিক জেনারেল স্টোর

–জাজাফী

মধুমিতা রোড দিয়ে ঢুকে একটু সামনে এগোতেই হাতের ডানে মোড় নিয়েছে একটি সরু গলি।গলির এই রাস্তাটি আরিচপুরের মধ্য দিয়ে সোজা গিয়ে মিশেছে টঙ্গী বাজারে।আইসক্রিম ফ্যাক্টরী পেরিয়ে মোড় নিয়ে এগোতেই তিনতলা মসজিদ।মসজিদটি সুন্দর এবং পাঁচওয়াক্তই মুসল্লীতে ভরপুর থাকে।যদিও এটির আকার তিনতলা ছাড়িয়ে গেছে অনেক আগেই কিন্তু কি কারণে যেন এখনো এটিকে তিনতলা মসজিদ বলেই সবাই ডাকে।ঠিক যেমনটি কল্যাণপুরে দোতলা মসজিদ নামে একটি মসজিদ রয়েছে যেটি দোতলাতো নয়ই বরং পাঁচ তলারও বেশি।মধ্যআরিচপুর তিনতলা মসজিদের বিপরীতে লাগোয়া বেশ কটি দোকানের একটির নাম মানিক জেনারেল স্টোর।মাঝে মাঝে সময় পেলেই স্টোরের সামনে গিয়ে দাড়ায় হাসান।কিছু কিনুক বা না কিনুক দাড়িয়ে থাকে।পোশাকে দুবর্লতা থাকলে মনে হতো যেনবা সাহায্যের আশায় দাড়িয়ে আছে।এই স্টোরে তার খুব যাতায়াত।ওখানে আরো ক’জন পরিচিত মুখের দেখা পাওয়া যায়।মানিক জেনারেল স্টোরের মালিকের নাম মানিক।

ছাত্র জীবন থেকেই হাসান টঙ্গীতে থাকলেও মানিক স্টোরে সে কখনো যেতো না কিংবা তার পরিচয়ও ছিলনা।সে থাকতো মধুমিতা রোডের নুরজাহান কটেজের চিলেকোঠায়।এলাকায় কতশত ছেলে মেয়ে থাকতো কিন্তু সে তেমন কাউকে চিনতো না আবার তেমন কারো সাথে মিশতোও না।মেসে থাকতে হতো তাই সাধ্যমত চেষ্টা করতো সঙ্গ এড়িয়ে চলতে।অবাক হয়ে দেখতো সেই মেসের অন্যান্য সদস্যদের কাছে নিয়মিত নানা ধরনের লোক আসাযাওয়া করে।কেউ আত্মীয় কেউ বন্ধু কেউবা নিছক পরিচিত।হাসানের বয়সীরাও আসতো।তবে সে কারো সাথে যচে কথা বলতো না। একদিন বেশ কজন যুবক আসলো দলবেধে।তাদের মধ্যে পরিচয় হলো ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজ থেকে পাশ করে সদ্য ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি হওয়া এক তুখোড় মেধাবীর সাথে।ছেলেটির সাথে কথা বলে ওর খুবই ভালো লাগলো।ও অবাক হয়ে দেখলো ছেলেটিকে না চিনলেও ছেলেটির ছোটবোনটাকে সে আগে থেকেই চিনতো কারণ ওদের ক্লাসের অনেককেই হাসান প্রাইভেট পড়াতো।যেহেতু দলের একজনের সাথে পরিচয় ঘটেছে তাই বাকিদের সাথেও সৌজন্য সাক্ষাতটা জরুরী।সেদিন পরিচয় হলো মশিউর নামে আরো একজনের সাথে।দিন যেত আর ওদের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা তৈরি হতো।এভাবে একটু একটু করে বেশ ভালোবন্ধুত্ব হয়ে গেল বিশেষ করে মশিউরের সাথে।

হাসান অবাক হয়ে দেখলো মশিউর নামের ছেলেটি অনেক বিষয়ে সূক্ষ্ম জ্ঞান রাখে যা তাকে দেখলে বোঝা যায়না।এমনকি হাসান এতো বই পড়ার পরও যেসব বিষয়ে কোন ধারণাই ছিলনা সেসব বিষয়েও মশিউর নামের ছেলেটির বেশ ভালো জানাশোনা ছিল।ফলশ্রুতিতে অন্যদের সাথে পরিচিতিতেই থেমে থাকলেও মশিউরের সাথে হাসানের বন্ধুত্ব হলো নিগুঢ়।আড্ডা হতো,গল্প হতো এবং নানা বিষয়ে জ্ঞানবিতরণ চলতো।এর মাঝেই হাসান পড়াশোনা শেষ করে চাকরিতে ঢুকে গেল।তবে বন্ধুত্ব ছুটলো না।মশিউরের মাধ্যমেই প্রথম মানিক জেনারেল স্টোরের মালিক মানিক ভাইয়ের সাথে হাসানের পরিচয় হলো।মানুষটিকে দেখলে কেউ বলতেই পারবেনা তিনি পড়াশোনা জানা লোক এবং এখনো পড়ছেন।দেখলে তাকে ঢের বয়স্ক মনে হলেও তিনি মনে মনে চিরতরুণ।প্রথম প্রথম মানিক ভাইকে হাসানের মনে হতো শুধুই দোকানদার কিন্তু এক সময় মনে হতে লাগলো তিনি শুধুই দোকানদার নন বরং পড়াশোনা জানা ভ্রমনপিয়াসী একজন মানুষ।

ফেসবুকে দেখা যায় তারা সবাই দলবেধে রাঙামাটি,বান্দরবন,কক্সবাজার আরো কত জায়গা ঘুরে বেড়াচ্ছে।যেন পঞ্চপযর্টকদল।এক বিকেলে মশিউর ফোন করে হাসানকে জানালো মানিক ভাইয়ের স্ত্রীর সিজারিয়ান বেবী হবে রক্ত দরকার।আগে থেকেই হাসানের রক্তের গ্রুপ জানা থাকায় মশিউরের বলতে সুবিধা হয়েছিল।হাসানও রেডি ছিল রক্ত দেওয়ার জন্য।যেহেতু অপারেশান হবে হাসানের অফিসের কাছাকাছি একটি হাসপাতালে তাই সে নির্ভয় দিয়ে বললো দশমিনিট আগে ফোন দিলেই সে চলে আসতে পারবে।ওর কেন যেন মনে হচ্ছিল এবারও বোধহয় রক্ত দিতে হবে না।এর আগে যতবার ও রক্তদিতে গিয়েছে কোন বারই রক্ত লাগেনি।কিন্তু সেবার সত্যি সত্যিই রক্ত লাগলো।মানিক ভাইয়ের ফুটফুটে একটি মেয়ে হলো।প্রথমে সবাই খুব ভয়ে ছিল তবে আল্লাহর অশেষ কৃপায় মেয়েটি একটু একটু করে সুস্থ্য হয়ে উঠলো।সেই থেকে মানিক ভাইয়ের সাথে হাসানেরও বেশ মধুর সম্পর্ক।

মানিক জেনারেল স্টোরে এর পর থেকেই ওর আসাযাওয়া।ওখানে সবাই মিলে দাড়িয়ে বসে আড্ডা দিতে দিতে শিল্প সাহিত্য রাজনীতি অর্থনীতি,চলচ্চিত্র সহ নানা বিষয়ে আলোচনা চলতো।হাসান মুগ্ধ হয়ে দেখতো ছোট্ট একটি দোকান অথচ ক্রেতারা যা চাইছে মানিক ভাই প্রায় সবই দিতে পারছেন।হাসান একবার জানতে চাইলো মানিক ভাই আপনার দোকানে কি কোন ম্যাজিক আছে যে ক্রেতারা যা চাইছে সেটাই বের করেদিচ্ছেন। আপনার দোকানে পাওয়া যায় না এমন কি কিছু আছে?মানিক ভাই হাসলেন।তিনি বললেন ক্রেতাদের চাহিদার কথাতো মাথায় রাখতে হবে।তবে কেউ এসে মদ চাইবে সেটাও দিতে হবে এমনতো কোন কথা নেই।তার পর তিনি সাথে যোগ করলেন হয়তো কোন একদিন দেখবেন কোন এক ক্রেতা এমন কিছু চাইছে যা আশেপাশের দোকানে পাওয়া যাচ্ছে অথচ আমার দোকানে নেই।হতে পারে সেটা নিষিদ্ধ কোন বস্তু নয় তারপরও আমার দোকানে নেই।হাসান আর কথা বাড়ায় না।ওর বরং অপেক্ষায় থাকতে ভালো লাগে।কবে সেই দিন আসবে যেদিন দেখবে মানিক জেনারেল স্টোরে এসে কোন একজন কাষ্টমার ফিরে যাচ্ছে তার কাঙ্খিত দ্রব্যটি না পেয়ে।এর পর তিন বছর কেটে গেছে।মানিক জেনারেল স্টোরের সামনে দাড়িয়ে কতদিন যে আড্ডা হয়েছে তার হিসেব নেই।কিন্তু হাসান কোন দিন কোন কাষ্টমারকে দোকানে কোন একটি দ্রব্য নেই এমন কথা শুনে ফিরে যেতে দেখেনি।সে মনে মনে ভেবেই নিয়েছে এই ছোট্ট দোকানটি হলো সার্চ ইঞ্জিন গুগলের মত যেখানে সার্চ দিলে সবই পাওয়া যায়।সে আশা ছেড়েই দিয়েছে যে কোন কাষ্টমার তার কাঙ্ক্ষিত দ্রব্যটি না পেয়ে ফিরে যাচ্ছে এমনটি দেখা যাবে না।

এর মাঝে হাসানের বড় আপা বাসা নিলো মধ্য আরিচপুরে।ফলে তখন মাঝে মাঝেই সে ওই এলাকায় যেত।এক শুক্রবারে সে আপার বাসায় গিয়ে আপাদের সাথে গল্প করে খেয়ে ফিরে যাওয়ার জন্য বের হলো।ভাবলো এতো কাছে এসে মানিক ভাইদের সাথে দেখা না করে যাওয়া ঠিক হবেনা তাছাড়া আবার কবে আসা হবে তারতো কোন ঠিক নেই।ধীর পায়ে সে দাড়ালো মানিক জেনারেল স্টোরের সামনে।সেখানে তখন মানিক ভাই ছিলেন আর তপু ভাই ছিলেন।অনেক দিন পর হাসানকে দেখে দুজনই হাত বাড়িয়ে দিলেন,কুশল জানতে চাইলেন।বেশ কিছুক্ষণ গল্প হলো।মশিউর তখন অন্য কোথাও কাজে ব্যস্ত থাকায় তার সাথে দেখা হলোনা।গল্প করে হাসান যখন মানিক জেনারেল স্টোর থেকে বেরিয়ে যাবে ঠিক তখন একজন ক্রেতা এসে তার কাঙ্ক্ষিত দ্রব্য চাইলেন।মানিক ভাই দুঃখ প্রকাশ করে বললেন দুঃখিত আমার দোকানে আপনার কাঙ্ক্ষিত দ্রব্যটি বিক্রি হয়না।

হাসান ভীষণ ভাবে চমকে উঠলো।দেশের অলিতে গলিতে বিক্রি হয়,রাস্তায় ফুটপাতে বিক্রি হয় এবং ভাতের চেয়েও যেটিকে সবাই বেশি প্রয়োজনীয় মনে করে সেই দ্রব্যটি মানিক জেনারেল স্টোরে বিক্রি করা হয়না!হাসান থমকে দাড়িয়ে অবাক হয়ে মানিক ভাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে মানিক ভাই এটাতো নিষিদ্ধ কোন বস্তু নয় তাহলে আপনি কেন বিক্রি করেন না?মানিক ভাই মুখে তার চিরাচরিত হাসি টেনে বললেন একদিন বলেছিলাম নিশ্চই দেখবেন কোন না কোন ক্রেতা মানিক জেনারেল স্টোরে এসে তার কাঙ্ক্ষিত দ্রব্যটি না পেয়ে ফিরে যাবে আজ সেটা চাক্ষুস করলেন।আমি নিজে যেহেতু সিগারেট খাই না এবং মনে করি সিগারেট শরীরের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর তাই আমি দোকানে সিগারেট বিক্রি করিনা।একটি সিগারেট বিক্রি করলে আমার হয়তো সামান্য লাভ হবে কিন্তু যার কাছে বিক্রি করছি তারতো চরম ক্ষতি হবে।আমি একজন সুনাগরিক হয়ে নিশ্চই কারো সামান্যতম ক্ষতি হোক এটা চাইতে পারি না।

মানিক ভাইয়ের কথা শুনে হাসান অবাক হয়ে তার মূখের দিকে তাকিয়ে থাকলো।তিনতলা মসজিদের মাইক থেকে তখন মুয়াজ্জিনের কন্ঠে ভেসে আসলো এশার আজানের ধ্বনি।মানিক জেনারেল স্টোরের মালিক মানিক ভাই দোকান থেকে বেরিয়ে মসজিদের দিকে রওনা দিলেন।হাসান দেখলো মানিক ভাইয়ের দোকানের ঝাপিটা খোলাই আছে এবং দোকানে পাহারা দেওয়ার মত কেউ নেই,এমনকি সিসিক্যামেরাও লাগানো নেই।রাত হয়ে গেছে আর অপেক্ষা করা যাবেনা ভেবে হাসান বেরিয়ে পড়লো।রিকশায় উঠে পিছন ফিরে একবার বিক্রেতা বিহীন ঝাপখোলা দোকানটির দিকে তাকালো।চোখে পড়লো ছোট্ট একটি বিলবোর্ড যেখানে গোটাগোটা করে লেখা মানিক জেনারেল স্টোর।যে স্টোরে সিগারেট বিক্রি করা হয়না।

৩ মার্চ ২০১৮

Facebook Comments Box
RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments