-জাকারিয়া মাহমুদ
জানালা দিয়ে ফিরফির করে বাতাস আসছে। বাতাসে ঘাড়ের রুমাল পাখির মতো ডানা ঝাপটাচ্ছে। মুখভরা দাড়ি বৈশাখী ঝড়ের তাণ্ডবে গাছ গাছালি হেলে পড়ার মতো একদিকে হেলে পড়ছে। দু পাঁচটা দাড়ি কপোল ছুঁয়ে সুড়সুড়ি দেওয়ার চেষ্টা করছে। জানালার ফাঁক গলে পড়ন্ত বিকালের কোমল হলদে কিরণ মুখে এসে পড়ছে। ফর্সা চেহারা হলদে কিরণের ছোঁয়া পেয়ে আলো ঝিলমিল রূপ নিয়েছে। রাস্তার চড়াই উৎরাইয়ে অখন্ড ভাবনা মাঝে মাঝে খানখান হয়ে যাচ্ছে। একরাশ বিরক্তি এসে জড়ো হচ্ছে কপালে। ক্রমান্বয়ে তিন চারটা ভাঁজের মাঝে মেলে দিচ্ছে নিজেকে। পরক্ষণে আবারো সব ভুলে ভাবনায় ডুবে যাচ্ছে অজান্তে। স্মৃতির ঝাঁপি তছনছ করে খুঁজে ফিরছে সদ্য হারিয়ে যাওয়া জীবনের সুখভরা দিনগুলো। মাঝে মাঝে ভবিষ্যতের অযাচিত ভাবনায় দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে হৃদয়জগত। ক ফোটো ঘাম জমা হয়েছে কপালে। কোমল হলদে কিরনে ঝিকমিক করছে কাঁচা স্বর্ণের মতো।
তাহসিন ঢাকার নামকরা জামেয়া থেকে ইফতা শেষ করে বাড়ির পথে। সুদীর্ঘ সফর। মাঝে অশান্ত পদ্মার বুকচিরে চলতে হবে ফেরিতে। কাটাতে হবে ঘন্টাধীক সময়। সুদীর্ঘ সফরে দীঘল ভাবনারা পিছু নিয়েছে তার। যেন অতীতের প্রাপ্তি অপ্রাপ্তির হিসেবে নিকেশ করতে বসেছে। খুলনার এক নামকরা জামেয়ায় খেদমত ঠিক হয়েছে সেই কবে। বছরের প্রভাতকালে। তবু তার ভাবনার অভাব নেই।
নতুন এক জীবন। যার দেহ জুড়ে শুধু রহস্য। তার মাঝ দিয়ে বয়ে যাবে আরেক জীবন। দাম্পত্য জীবন। কল্পনা ও ভাবনার সিন্দুকে সযত্নে সাজিয়ে রাখা এক প্রেমময় জীবন। তবে আশঙ্কাময়। দুর্ভাবনার। দুশ্চিন্তার। আসলে সমাজ তাকে বাধ্য করেছে এমন আশঙ্কা, দুর্ভাবনা ও ভয়কে লালন করতে। ঘর সংসারের ভাবনা পেখম মেললেই বুকের বা পাশটার উপর কে যেন পা তুলে দেয়। শ্বাস-প্রশ্বাস আপন ছন্দ হারায়। দুরুদুরু কম্পন শুরু হয় হৃদয়ে। অস্ফুটে মুখ থেকে বেরিয়ে আসে রাব্বানা হাবলানা মিন আজওয়াজিনা ওয়া জুররিয়্যাতিনা…
কাল পরিক্রমায় কেটে গেল কয়েক মাস। নতুন জীবন বেশ কাটছে তাহসিনের। ক’মাসেই সুনাম সুখ্যাতি আকাশ ছুঁয়েছে। ওদিকে মা নতুন মেহমান আনতে উতালা। বাড়িতে একটু টু মারলেই কান ঝালাপালা করে দেয় সাত পাঁচ বলে। তালে তালে দুষ্টু মনটাও ইন্ধন যোগাচ্ছে। যদিও গোপনে। চুপিসারে। অগোচরে। একাকী জীবন এখন পানসে আর ম্যাড়মেড়ে লাগছে।
পাড়া মহল্লায় তাহসিনের যথেষ্ট সুনাম সুখ্যাতি। আঁজলাভরা জনপ্রিয়তা। পিপড়ার মত দল বেঁধে আসছে “সম্বন্ধ”। কিন্তু কোথায় যেন অপূর্ণতা সামনে এগোতে বাঁধ সাধছে।
হঠাৎ একদিন বন্ধু আমানের সাথে দেখা। বুকে বুক মিলিয়ে শুরু হল সুখ-দুঃখের কথা। রঙিন মখমল শৈশবের স্মৃতিগাঁথা। বন্ধুর বিয়ের কথা শুনতেই পুলকে চনমনিয়ে উঠল আমানের মন। যেন খুশিতে বাগবাকুম। রস গল্পের টানটান উত্তেজনার মাঝে খোঁজ দিল ভালো এক “সম্বন্ধে”-র। খুলনার ঐতিহ্যবাহী জামিয়া ইসলামিয়ার নামকরা মুফতি ও বিত্তশালী খতিবের রূপবতী বিদুষী কন্যা।
শুরু হলো যোগাযোগ। খোঁজখবর। জানাজানি। মুফতি সাহেবও বেজায় খুশি এমন পূন্যবান ছেলের সন্ধান পেয়ে। কিন্তু তাহসিনের মন খচখচ করছে। দ্বিধা দ্বন্দ্বে কাটছে সময়। অদৃশ্য কথা চালাচালি হয় মনের সাথে। কিন্তু সে দিশেহারা। দিকভ্রান্ত পথিকের ন্যায় ঘুরছে এসিক সেদিক। হঠাৎ কি মনে করে ফোন করল তালিমী মুরুব্বির কাছে। তিনি পাত্রীর কথা শুনতেই তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন।
-গাধা, তোর ওই বাড়ির পথ মাপতে কে বলেছে? পারবি বউ সামলাতে? সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্ম নেওয়া মেয়ে। যে পরিবারের রান্নাবান্নার কাজ পর্যন্ত করে গ্লাভস পরে। আর তুই কিনা অজপাড়াগায়ের মৌলবী। আরো ব্যাপার স্যাপার আছে।
-তাহসিনের মুখ থেকে কথা সরছে না। হুজুরের অগ্নিকন্ঠের সাথে সে বেশ পরিচিত। তবুও আজ যেন নতুন ঠেকছে। ভয়ে সমস্ত শরীর কাঁটা দিয়েছে। ক ফোটা ঘামও জমা হয়েছে কপালে।
-এখানে বিয়ে হবে না। অন্য জায়গায় দেখ। আমিও খোঁজ খবর নিচ্ছি। তুইও নে।
-তাহসিন জি শব্দটা কোন মতে মুখ থেকে বের করে শেষ করল কল। মন ছেড়ে বড় একটা নিশ্বাস নিয়ে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা ।
কয়েকদিন পর দূর সম্পর্কের চাচার সাথে দেখা। চাচা হলে কি হবে আপন সন্তানের চেয়ে কম জানে না তাহসিনকে। জোয়ান ভাইপোকে কাছে পেয়ে চাচার দুষ্টুমি বাঁধ মানে না।
-আঙ্গ মতো বুড়া তো হই গেলা। বিয়ে-শাদী কি আর করবা না?
-হ্যাঁ চাচা, দেখাদেখি চলছে। কিন্তু ভালো ‘সম্বন্ধ’ পাচ্ছি না।
-কি বলতিছ!! এত এত মাইয়া। আরে, আমার বিয়ান বাড়ির পাশে মাহবুব মাওলানার একখান মাইয়া আছে। শুনেছি বড় ভালা। মাদ্রাসায় পড়ে। দেখতে পারো।
এক সপ্তাহ পর। জানাশোনা শেষ পর্যায়ে। তাহসিন এর মনটাও বেশ টানছে। হৃদয়ের অলিন্দে একটা অবমূর্তি ছায়া-বিস্তার করছে ধীরে ধীরে। সাথে মনটা বিনি সুতোই বেঁধে আলতো করে টানছে। তাহসিন ইস্তেখারা করল। টান যেন আরো গভীর হলো। বুকের বা পাঁশটায় এক অদৃশ্য সত্তা যেন চিরতরে দখল নিয়ে নিল।
তালিমী মুরুব্বী শুনলেন। হাসিমুখে সম্মতি দিলেন। সাথে বুক ভরা দোয়া এবং দিক নির্দেশনা। পিতা-মাতার না বলতে পারা কথাগুলো বলে দিলেন অকপটে। রুহানি পিতা বলে কথা।
অনাড়ম্বরভাবে বিয়ে হয়ে গেল। নিত্যদিন বউয়ের আচরণে মুগ্ধ হয় তাহসিন। কাশফুলের মতো নিখাদ পবিত্র ভালবাসা হৃদয় ছুঁয়ে যায়। শত চিন্তা নিয়ে বাড়ি ফেরে। প্রিয়তমা চিন্তাগুলো লুকিয়ে কোথায় যেন রেখে দেয়। এক মুহূর্তের জন্যও মাথায় আসেনা। এক সপ্তাহের ভিতরে বাড়ির মধ্যমনি হয়ে রানীর সিংহাসনে আসীন। সেই যুগপৎ উক্তিটি বুঝি তার মাঝে বিমুর্ত।
“নারী তুমি স্বামী ও পরিবারের দাসী হয়ে যাও। স্বামী ও পরিবার তোমার দাস বনে যাবে।”
তাহসিনের মনে আনন্দ খুশি ধরে না। আনন্দে হুটোপুটি খায় বাচ্চাদের মতো। বউয়ের দিকে তাকালেই বসন্তের সকালে শিশির ধোয়া শিউলির মতো নির্মল ও পবিত্র হয়ে যায়। তাহসিনের সারাক্ষণ শুধু মন চায় তার গীতিকথা শোনাতে অপরকে।
বেশ কিছুদিন পর। মাসিক ছুটিতে তাহসিন। দুইটা দিন কাটাবে প্রিয়তমার সাথে। যদিও অনেক অল্প। হৃদয়ের বারান্দায় টানিয়ে রাখা লেখাটা বারবার আওড়াতে মন চায়।
“ইয়া ওয়াকতু তুল।ইয়া মাসগালাতু ঝুল।হয়া হিয়নু কিফ। ফালা তাকজি।”
কিন্তু জীবন কি থেমে থাকে? ঘড়ির কাঁটা কি বাঁধ মানে? নদীর স্রোতের মতো বয়ে চলে নিরবধি।
নাস্তা সেরে বিছানায় পিঠ লাগিয়েছে মাত্র। ঘুমে চোখটা ঢুলুঢুলু করছে। অমনি ডাক পাড়ল মা।
-আব্বা তোর বাপ তো শহরে গেছে। বাজার সদাই করবে কে? তুই জা-না একটু!!
মায়ের আদেশ। যদিও সুরে আবদার ঝরে পড়ছে উপচে। কিছুক্ষণ কি যেন ভাবল, তারপর উত্তর পাঠাল “আম্মা, লিস্ট দেন। যাচ্ছি।”
গরীবের সংসার। তবুও সন্তানদের কষ্ট বুঝতে দেয় না রফিক দম্পত্যি। শত বেদনা, অভাব অনটন সব লুকিয়ে রাখে আকাশের মতো বিশাল বুকটার ভেতর। ছোটবেলায় আব্বার ব্যাগ ধরে যাওয়া। অতটুকুই। নিজে বাজার করার অভিজ্ঞতা শূন্যের কোটায়। তবুও মা বলেছে এবং প্রথমবারের মতো। যেতে হবেই।
এক পশলা বিরাগ চোখে মুখে মেখে খাট ছেড়ে উঠল। মনে মনে আওড়াতে লাগল “আব্বার শহরে যাওয়ার সময় বুঝি আজই হল।” ভাবলাম জব্বর একটা ঘুম দেব।” খাট ছেড়ে উঠতেই চোখ আটকে গেল। বিষ্ময়মাথা চোখে অপলক নেত্রে তাকিয়ে আছে, প্রথম হাতি দেখে বাচ্চারা যেমন ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। শঙ্কা, ভয় ও আনন্দ খুশি তার চোখের তারায়। যেন ভূত দেখে বিভ্রম হয়েছে।
খাট ছেড়ে নামতেই দেখল মুচকি (প্রিয়তমা স্ত্রীর নামের বাংলা অর্থ মুচকি হাসি। তাই তাহসিন ভালোবেসে মুচকি বলে ডাকে মাঝে মাঝে পুচকি বলেও দুষ্টুমি করে) পাঞ্জাবিটা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। ঠিক মাদ্রাসায় খাদেম যেভাবে পাঞ্জাবী ধরে দাঁড়িয়ে থাকে।
-মুচকি তুমি,, আমি ভূত টুত দেখছি নাতো?
-হ্যাঁ আমি তবে আপনি ভুতও ভাবতে পারেন।স্বেচ্ছায় খাট থেকে না নামলে সত্যিই ভূত হয়ে যেতাম।
- ও খোদা,এই ভূতের সাথে বাকিটা জীবন কাটাতে হবে! ইয়া নাফসি! ইয়া নাফসি! আমি ভাগতাছি।
-কি বললেন! আমার থেকে পালাতে চান? একদম মেরে ফেলবো। আলতো একটা কিল বসিয়ে দিল তাহসিনের বুকে। তাহসিন তো হেসে খুন।
-দ্রুত পরে নেন। সূর্য মাথার উপর উঠে গেছে। কত কাজ।
-হুম আমি বাড়ি আসলেই তো কাজ বেড়ে যায়। (একটু মুখ গোমরা করে )
-দেখেন এবার কিন্তু সত্যিই ভূত হয়ে যাবো। দ্রুত যান। রোদ্দুরে পুড়ে তো কয়লা হয়ে যাবেন। ছাতা নিয়ে যাইয়েন।
-ছোট্ট করে দোয়াটা পড়ে নিয়ে ঘর থেকে বের হল। বাহিরে পা রাখতেই গ্রীষ্মের রোদ্দুরের তীব্রতা গায়ে এসে পড়ল। যেন আকাশে চলছে আগুনের দাপাদাপি। দিনমণি মারমুখী হয়ে আছে। জ্বলছে তার তাপ। অধিগন্ত বিছিয়ে থাকা সবুজ প্রকৃতিকে পুড়িয়ে তামাটে করে যেন উপরেই তুলে দিচ্ছে পাক খাওয়া শিখা গুলোকে।
ব্যাগটা হাতে নিয়ে হনহন করে হাটা দিল বাজারের দিকে। চারপাশে সবুজের সমারোহ। কচি ধান হেলে দুলে আপন মনে যেন গান গাইছে। বিয়ের পর থেকেই কেমন যেন প্রকৃতিরা বদলে গেছে। সবখানেই প্রফুল্লতারা উঁকি দেয়।
লিস্টের এক নম্বরে আছে লাউ। নামটা দেখতেই বুকটা ছ্যাঁত করে উঠল। সারা জীবন মাদ্রাসার বোডিংয়ে সবচেয়ে বেশি এই বস্তুটা খেতে হয়েছে। যদিও মাঝে মাঝে আক্ষরিক অর্থে খাওয়া হয়নি। পেটে চালান করতে হয়েছে।বস্তুটা লাউ কদু অভিধায় অভিহিত ছিল সকলের মাঝে। কিন্তু কেন জানি মনে হতো ফারাক তো আছেই। আমরা হলাম হুজুগে বাঙালি। সব জায়গায় খিচুড়ি পাকাতে ওস্তাদ। তবে ফারাকটা বড় দাগে বিবেচনায় আনা হয়নি কখনো। গাফিলতির গালে থাপড়াতে ইচ্ছা করছে এখন। হুজুর মানুষ বলে কথা, বেশি জানলেও সমস্যা। না জানলেও সমস্যা। পরিশেষ লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে জিজ্ঞাসা করল, - চাচা লাউ কত?
-চশমার ওপর দিয়ে দৃষ্টিবান নিক্ষেপ করল তাহসিনের দিকে। তারপর ঘাড় উঁচু করে এক চিলতে হাসি মুখের কোনে ঝুলিয়ে কোমলভাবে তাকাল সবজিওয়ালা চাচা।
বাজার সদাই করে বাড়ির পথে। ভারী ব্যাগের কারণে হেঁটে বাড়ি যাওয়ার চিরায়ত শখ তুলে দিতে হলো ভ্যানের উপর। ভ্যানের মচর ম্যাচর শব্দের ছন্দে ছন্দে তারে তাল মিলিয়ে চলতে লাগলো বাড়ির পথে। পথে রাজুর “পুষ্পনগর” থেকে একটা তরতাজা টুকটুকে লাল গোলাপ পকেটে গুঁজে নিল। ফুল নাকি ভালোবাসার প্রতীক! কিন্তু তার স্বরূপ চোখে দেখা হয়নি কখনো। আজ না হয়,,, থাক। আমার মত শুকনো মোল্লারা কি ওসব বুঝবে!
মনে মনে এসব সাত পাঁচ ভাবনায় হাবুডুবু খেতে খেতে ঠেলে উঠল নিতাই কাকার ভ্যানে। লোকটা হিন্দু হলেও তাহাসিনকে সাক্ষাৎ ভগবান মনে করে।
কাকার গিন্নি বিছানায় পড়ে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। কাকা দিন আনে দিন খায়। বউয়ের অ্যাপেইন্টুসাইট অপারেশন করার মতো এত্তগুলো টাকা একবারে চোখে দেখেছে কিনা মনে পড়ে না। জোগাড় করা তো দূর কি বাত।
এ মুখ ও মুখ হয়ে “নিতাই বউ” তখন গ্রামে আলোচনার বিষয়বস্তু। কেউ কেউ দোচালা কুঁড়েঘরটায় উঁকি দিয়ে দু পাঁচটা সান্ত্বনাবাণী আর ব্যাগ ভর্তি উপদেশ বালিশের পাশে রেখে আসে। এবং এতোটুকুই।
নিতাই কাকার মনটা বেজায় খারাপ। সুদে টাকা উঠাতে গিয়েছিল, কিন্তু মাহবুব মোল্লার ছেলে মুজিবার বলেছে, কাগজপত্র কমপ্লিট হতে আরো দু’একদিন লাগবে। আকাশ ভেঙ্গে পড়ল কাকার মাথায়। হিতাহীত জ্ঞান শূন্য হয়ে বাড়ির পথ ধরল। মাথাটা ভারভার লাগছে। কচি কোকিলের শিরিন সুর তাকে আকর্ষণ করছে না। সূর্যমুখীর ফাঁক গলে সূর্যটা তেতে উঠছে ধীরে ধীরে। রেলিং ঠেলে বাড়িতে পা রাখতেই, গিন্নি করুন দৃষ্টি মেলে তাকাল। নিতাই কাকা অধমুখী নারীর মতো মাথাটা নামিয়ে নিল। মাদুর বিছিয়ে শুয়ে কাতারাচ্ছে গিন্নি। নিতাই কাকার মনের পাথুরে ভূমিটা ভিজে উঠল। চোখের কোণে দু’ফোঁটা অশ্রু জমা হলো। কাকা লুকানোর ব্যর্থ চেষ্টা করে, চোখ চুলকানোর বাহানা মুছে ফেলল।
রমজান আসতে কয়েকদিন বাকি। আজ নিতাই বউ-এর শরীর ছিল বড্ড বেশি খারাপ। অসহ্য যন্ত্রণা থাকে তাড়া করে ফিরছে। কাতরাণোর করুন কণ্ঠস্বর বেরিয়ে আসছে গলা চিরে। অনিচ্ছায়। হঠাৎ কয়েকজন হুজুর টাইট (বাঁশের চটা দিয়ে তৈরি প্রবেশদ্বার) ঠেলে ভিতরে ঢুকল। নিতাই কাকা অবাক। এতগুলো হুজুর। তাও একযোগে। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। বিস্ময়ে বোবা হয়ে যাওয়ার জোগাড়। ভয়ও পেলো কিছুটা।
-নিতাই কাকা, কেমন আছো! নমস্কার।
-আছি কোনমতে বাবা। তো এই সাত সকালে!! আমি আজ ভ্যান চালাবো না। মন ভালো নেই। - কি বলো এসব? ওঠো কাকা। বসে থাকলে তো না খেয়ে মারা পড়বে।
-না বাবা। আপনারা অন্য কোথাও দেখেন।
-ওঠো না!! ভ্যান বের করো। তোমার গিন্নিকে হাসপাতালে নিতে হবে।
-আমার গিন্নিকে!? চোখের তারায় অবিশ্বাসের দ্যুতি ঝকমক করছে। তাল গাছে ভূত দেখার মতো চোখ ডাগর ডাগর করে শব্দ দুটো ছুঁড়ে দিল হুজুরদের দিকে।
-উফ অত কথা বলার কি সময় আছে? তোমার গিন্নি মরতে বসেছে আর তুমি আছো আজাইরা প্যাচাল নিয়ে।
-কিন্তু বাবা, টাকা পাবো কোথায়?
-ওসব নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। সুস্থ হওয়া পর্যন্ত সব খরচের দায়ভার আমাদের।
-সত্যি বলছেন বাবা?? আপনারা তো মানুষ না। ভগবান। কন্ঠটা ধরে এল। খুশিতে চোখের দু’কোনা ভিজে উঠল। যন্ত্রনার মেঘমালার কালো উত্তরীয় সরিয়ে চতুর্দশী হেসে ওঠার মত স্মিত হাস্যে ঘর থেকে নামলেন। ভ্যান বের করলেন অশ্রু ভেজা নয়নে। গিন্নিকে পাজাকোলা করে শোয়ায়ে দিলেন ভ্যানের উপর। এখনো কাতরানোর করুন আর্তনাদ প্রকৃতির অখণ্ড নীরবতাকে খানখান করে দিচ্ছে।
তাহসিনদের ‘হিলফুল ফুজুল যুব কাফেলা’ থেকে অর্থায়ন করা হলো। চল্লিশ হাজার মতো খরচ হল।ম্যানেজ করতে খুব বেশি ভোগান্তি পোহাতে হয়নি। নিজেদের সবটুকু ঢেলে দিয়ে আর ফেসবুকে কয়েকটা পোস্ট। সবশেষে বেঁচে যাওয়া অতিরিক্ত পাঁচ হাজার টাকা যখন হাতে তুলে দিয়ে সংগঠনের সভাপতি মুফতি তাহসিন বলল, - ধরো কাকা। এটাও তোমাদের জন্য। অনেকদিন তো হলো ভালো কিছু খাও না। এটা দিয়ে যা মন চায় কিনে খেও। আর তোমার গিন্নিকে একটা শাড়ি কিনে দিও। এবং রাহুলের একজোড়া শার্ট প্যান্ট।
নিতাই কাকা আবেগে নারীদের মতো ফুঁপিয়ে কেঁদে ফেলল। তাহসিন বুকে জড়িয়ে নিয়ে পিঠে হাত বুলিয়ে সান্তনা দিল।
সেদিন থেকে নিতাই কাকা হুজুরদের অসীম সমীহ করেন। হিলফুল ফুজুলের সেদিনের কোন সদস্য ভ্যানে উঠলে ভাড়া নেন না। শতচেষ্টা করেও না।
তাহসিন নিতাই কাকার সাথে খোস গল্প করতে করতে গ্রামের মেঠো পথ ঠেলে এগুচ্ছে। প্যাটেল মারছে নিতাই কাকা খুশি মনে। মেঠোপথে ফালি ফালি কাচা রোদ ঝরাপাতার ধূসর রঙে অদ্ভুত মাখামাখি।
কিছুক্ষণের নিরাবতায় তাহসিন হারিয়ে গেছে অজানা ভাবনার অতল গহ্বরে।”বাবা নামেন, এসে পড়েছি” শব্দে ঘোর ভাঙল। দু’হাতে ব্যাগ ভর্তি বাজার নিয়ে বাড়ির দিকে পা বাড়ালো। তাবাসসুম এগিয়ে এল ব্যাগ নিতে।
-আমার কাছে দেন।
-অনেক ভারী যে, পারবে না।
-কে বলেছে পারবো না! অবশ্যই পারবো। জানেন না! আপনার কষ্ট দেখতে পারি না।
-তাহলে আমি কিভাবে তোমার কষ্ট সহ্য করব?
কথা বলতে বলতে রান্নাঘর পর্যন্ত পৌঁছে গেল। কল চেপে হাত মুখ ধুয়ে, হাত মুখ মুছতে আঁচল ধরতেই, কেঁপে উঠলো তাবাসসুম। শরীরে খুশির ঢেউ বয়ে গেল। অসীম আনন্দে লাফিয়ে উঠল। ভিন্ন এক আমিতে রূপান্তর হল। তার মনের কোমল জমিনটা ভালোবাসার আবে জম জমে সিক্ত হল। একটি ছোট স্পর্শেই ভালোবাসার যে এমন অবাধ উষ্ণতা তা এই প্রথম উপলব্ধি করল। স্বামীর জ্যোতির্ময় মুখের দিকে তাকিয়ে ভেতরটা ওলট পালট হয়ে গেল। ক্রমেই পরিবর্তিত আর বিগলিত হতে থাকল। তারপর তাহসিন ঘরের দিকে পা বাড়াল। তাবাসসুমও পিছু নিল।
-মা কোথায়? ঘরে ঢুকতে ঢুকতে প্রশ্নটা ছুড়ে দিল।
-পাশের বাড়িতে গেছেন। আনিস চাচি নাকি অসুস্থ।
-তুমি যাওনি কেন?
-আপনি এখন ফিরবেন বলে । এই কাঠফাটা রোদে বাজার থেকে ফিরেছেন। ঘেমে টেয়ে তো একাকার হয়ে গেছেন। যদি কাউকে না পাইতেন?
-না পাইলে আবার কি! মাদরাসায় চলে যেতাম।
-আবার দুষ্টুমি শুরু করেছেন? রাগ করবো কিন্তু! আবেগের সাগরে ডুব দিয়ে কথাটা বলল।
-তুমি কি রাগ করতে পারো? জানা ছিল না। জামা খুলতে খুলতে কথাটা বলল। বাকিটা তাবাসসুম নিজ হাতে খুলে নিল। দেয়ালে ঝুলানো ওয়াল হ্যাংগারে সুন্দর করে রেখে দিচ্ছে। হঠাৎ আহ!! শব্দ তুলে চিৎকার করে উঠল।
-কি হয়েছে? কি হয়েছে?
-কি যেন হাতে ফুটে গেছে। আপনার পকেটে কি?
-ওটা প্রেমের কাটা। দেখো কেমন মজা। হাতটা নিয়ে আলতো ছুঁয়ে দিতে শান্ত হলো।
-কি আছে পকেটে?
-ভালোবাসা।
-তামাশা করছেন?
-সত্যি বলছি। -দেখান না কি আছে পকেটে। টোল তোলা হাসি ছড়িয়ে পড়লো মুখে।
-না, না দেখানো যাবে না।
-না আমি দেখব। করুণ সুরে অনুযোগ তাবাসসুমের।
-ঠিক আছে দেখো। তবে আমি চোখ বুঁজে নেই। ভারী লজ্জাজনক একটা ব্যাপার।
পকেট থেকে উদ্ধার হল টুকটুকে লাল গোলাপ। দেখেই খুশিতে গোলাপের মতো লাল হয়ে গেল তার মুখ। তাহসিন ততক্ষণে খাটে শরীরটা মেলে দিয়ে চোখ মুদে আছে।
-গোলাপ কেউ এভাবে দেয়? বাম পাশে বসে কনুই দিয়ে মৃদ্যু আঘাত করে কথাটা ছুড়ে দিল।
তাহসিন চোখ খুলে তাকাল। ঠোঁটের কোণে লেগে আছে এক চিলতে হাসি। মুখে কোন কথা নেই। অপলক তাকিয়ে থাকল প্রিমতমার মুখ পানে। তাবাসসুম তো লজ্জায় লাল । খুশিতে মন বাগবাকুম। এক আকাশ শ্রদ্ধায় আপ্লুত হল। সেও মুখ তুলে তাকালো প্রিয়তমের দিকে। শিশুর নিষ্পাপ চোখে অসীম নীলের রাজ্যে প্রথম চন্দ্রোদয় প্রত্যক্ষ করার মতো ভালোলাগা বিস্ময় স্বপ্ন মোহে একাকার। মানুষের আদলে এত রূপ! দূরপাল্লার চাহনি মেলে ঘুরতে থাকলো অতীতে গলি পথে। অতীত স্বপ্ন আর কল্পনার ঝাঁপি খুলে বর্তমানের সাথে পরখ করে দেখল। এমন জ্যোতির্ময় মুখ সে কখনো কল্পনা করেনি। এমন পবিত্র চাহনি কোনদিন দেখিনি। কিছুক্ষণ শব্দহীন কথা চালাচালি চলল নিজেদের মাঝে। এবং চোখের ভাষায়।
-বৌমা কই গেলা সব? শাশুড়ির ডাকে ঘোর ভাংলো দু’জনের। তাবাসসুম তড়িঘড়ি করে উঠে যেতে লাগল, ওমনি তাহসিন আঁচল টেনে ধরে,
-চলে যাচ্ছ? থাকো না আর কিছুক্ষণ।
-চলে যাচ্ছি না। আম্মু ডাকছেন। তার আগে আপনাকে এক গ্লাস শরবত করে দেই। তারপর লক্ষ্মী ছেলের মত ঘুমিয়ে পড়বেন। এবং একেবারে নামাজ পর্যন্ত।
-জো হুকুম মহারানী।
রহস্যময় এক হাসি দিয়ে বেরিয়ে গেল তাবাসসুম। হাসিটা দেখে শরতের শিউলির মতো ভিজে উটলো তাহসিনের মন। অস্ফুট স্বরে বলল, নারী তুমি মায়াবিনী। আনন্দদায়িনী। সুন্দরী ললনা। হৃদয়হরণকারিনী।
-জ্বী আম্মু। উনি বাজার থেকে আসতে আসতে একেবারে ঘেমে-টেমে চাপুরচুপুর। তাই একটু শরবত করে দিচ্ছিলাম।
-বেলা পড়ে গেল। রান্নাবান্না কখন করবে? আসো। আসো।
কিছুক্ষণ পর,,
-তাহসিন, ওই তাহসিন, তুই কি কান্ডরাই না ঘটিয়েছিস! বাহিরে আয়। কি এনেছিস এটা? লাউটা হাতে ঝুলিয়ে ঘরের দিকে আসতে আসতে কথাগুলো বলল তাহসিনের আম্মা। মায়ের অগ্নিকন্ঠ শোনা মাত্র ভূত দেখার মতো চমকে উঠল তাহসিন। দ্রুত বাহিরে পা রেখে,
-কি হয়েছে আম্মা?
-কি এনেছিস এটা?
-কেন লাউ!!
-উফ,, সেটা তো বাহির থেকে দেখাই যাচ্ছে। কিন্তু আদতে কি এটা লাউ?!
-তো কি? চোখ দুটো ফুটবলের মত করে তাকাল।
-হাত দিয়ে দেখ আস্ত একটা পাথর।
-বলেন কি? হালকাই তো মনে হল। পাথর হলে তো বেশ ভারী হতো।
-আরে বুদ্ধু, আমি কি তাই বলেছি।
-তাই তো শুনলাম। একটু করুন চাহনি মেলে তাকাল।
-পড়ালেখা শিখালাম এমন ‘গাধা’ থাকার জন্য? একটা লাউ চিনিস না!
-কি হয়েছে বলবেন তো?
-এমন পাকা লাউ কে দিয়েছে? ফেলে দেওয়া ছাড়া যার কোন গতি নেই।
তাবাসসুম বারান্দার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে শুনছিল মা ছেলের কথা । মায়ের মুখে ‘গাধা’ শব্দটা শুনতেই বুকটা মোচড় দিয়ে উঠল। মা তো যা ইচ্ছা বলতে পারেন সন্তানকে। কোন নিষেধ নেই। তবে স্বামী বলে কথা। ভালোবাসার অলিন্দে যিনি সম্রাট, তার নামে কালিমা লেপন! তার আত্মমর্যাদার গায়ে ধুলো পড়ল।
-থাক, যা হবার তো হয়েই গেছে। খেয়াল করেননি হয়তো।
-না মা, এ যাবৎ না শিখলে আর কবে শিখবে? আমাদের এক পা তো কবরে চলে গেছে সেই কবে। আর কয়দিন বা বাঁচবো!
তাহসিনের মুখে কালো মেঘ ছেয়ে গেল। নিরবে রুমে ঢুকে গেল। মলিন মুখটা দেখে তাবাসসুমের লাগলো কষ্টের প্রবল ঝটকা ।
লাউটা হাতে নিয়ে সে বলল,
-আম্মু এটা আজ আমার দায়িত্বে। দেখি কি করতে পারি? আজকের জন্য আপনার ছুটি। আজকে শুধু আমি কাজ করবো।
-না না। তা কি করে হয়?
-এটা আপনার মেয়ে হিসেবে আবদার করলাম।
-ঠিক আছে বলছোই যখন। যা ইচ্ছা কর।
-আচ্ছা। অনেক অনেক শুকরিয়া।
মনে মনে চলল বিষ্ময়কর আয়োজনের তৎপরতা। আমার জামাইয়ের নামে কালিমা লেপন!! দেখাচ্ছি মজা। এমন কাজ করব সবাই বোবা বনে যাবে। আমার ‘উনিকে’ বাহবা দিতে বাধ্য হবে। আর প্রশংসা,, ও তো জরুর কারেগা।
বিসমিল্লাহ বলে লাউটা কাটতে শুরু করল। বহু কষ্টে দাও বঁটি মিলিয়ে ছয় ফালি। এখন ছোবলা ফেলার পালা। সহজেই সে পর্ব পূর্ণতায়। চামচ দিয়ে বীচিগুলো আলাদা করল। তারপর লাউয়ের মূল অংশ কেটে রান্নার উপযোগী সাইজ করাও শেষ। নীলচে সাদা রঙে প্লেটে সেজেগুজে আছে যেন। এবার ছোবলাকে কুপোকাত করার পালা। মেশিন দিয়ে করে ফেলল কুচি কুচি। ওদিকে চুলোয় পানি গরম হচ্ছে। টগবগ টগবগ শব্দ খল বলিয়ে ভেসে আসছে কানে। মৃদু কম্পন ধরিয়ে দিচ্ছে অন্তরে। কিছু পেলেই যেন বাঘের মতো খুবলে খুবলে খাবে। পিস করে কাটা লাউগুলো ছেড়ে দিল গরম পানিতে। থবধক থকবক করতে লাগলো। গরম পানির গম্ভীর ভরাট আওয়াজ মনের দরজা ধরে ধাক্কাধাক্কি করতে লাগলো। ছোবলা ও বীচি দু’টি পলিতে আশ্রয় নিয়েছে ইতিমধ্যে। সেগুলো ভাবছিল চিরায়ত নিয়ম অনুযায়ী তাদের জায়গা হবে ডাস্টবিনে। সিঁড়ির বাম পাশে ফেলে রাখা ঝুড়িতে। তাদের অবাক করে দিয়ে ছেড়ে দিল টগবগ টগবগ করতে থাকা পানিতে। তারাও গরম পানির কাছে কুপোকাত। নেতিয়ে গেল কিছুক্ষণের মধ্যে।
তাবাসসুম তিনটা পাত্র দেখে পানি ঝরিয়ে নিল। তারপর আলু চিকেন আর লাউ দিয়ে তৈরি হলো বিখ্যাত ‘চিকেন লাউ’ তারপর ছোবলার পালা। আলু কুচি আর ছোট চিংড়ি দিয়ে তৈরি হল ঘ্রানে ম ম করা ‘লাউ চিংড়ি ভাজি’ পরিশেষ বীচির পালা। মুখের কোনে রহস্যময় হাসি ঝুলিয়ে বলল, অবহেলিত বন্ধু! তুমিই হবে আজকের সবচে মজাদার সেরা রেসিপি। হামানদিস্তায় ফেলে তার দফারফা করা হলো। শুটকি, পেঁয়াজ মরিচ আর তেল মিলে তৈরি হল ‘লাউয়ের বীচি ও শুটকি ভর্তা’ দুপুরের ভোজের জন্য এতোটুকুই আয়োজন। অন্যসব এড়িয়ে গেল তাবাসসুম ইচ্ছে করে। কারণ! খাওয়ার অযোগ্যকে খাওয়াযোগ্য করা হয়েছে। এতটুকুতেই শেষ না। অবাক করা তিন পদে তৈরি হয়েছে মজাদার সব রেসিপি। যদিও মজা স্বাদ আপেক্ষিক। গালে না তুললে তার তাত্বিকতা উন্মোচিত হচ্ছে না।
-দুপুরের ভাত খেতে বসেছে সবাই। লাউ দেখে শাশুড়ির মুখে এক করুন আর্তনাদের ছাপ। শশুর তো ঘটনার কিছুই জানেন না। সবার শেষে আসলো তাহসিন। বুকটা তার দুরু দুরু করছে অজানা আশঙ্কায়। মায়ের রোষাণলে তো পড়েছে। এখন আবার আব্বা লঙ্কাকান্ড না ঘটায়।দুরুদ শরীফ আওড়ে নেল কয়েকবার। দুরুদ শরীফ মুক্তির এক অনন্য হাতিয়ার। বসতেই চোখ পড়ল লাউয়ের উপর। মনটা আনচান করে উঠল। একটু রাগও জমা হল মনের কার্নিশে। দাঁতে দাঁত পিষে বলল মুচকি তোমার পুচকিপনা ছোটাচ্ছি। ঘরে চল আগে। আজ দেখাবো মজা।
-বৌমা আর কই? কিছু তো দেখছি না। মাছ দিয়ে তরকারি রান্না করতে বলেছিলাম।
-মায়ের আওয়াজ শুনে তাহসিন খাওয়ার প্লেটে ফিরে এলো ভাবনার জগত ছেড়ে। তার মাঝে তাবাসসুম উত্তর করল।
-ওগুলো রাতে। এখন শুধু লাউ। - এগুলো কী?
দুটি বাটি থেকে ঢাকনা তুলে প্রশ্ন করল শশুর। মুহূর্তেই ঘ্রানে ম ম করে উঠলো চারপাশ।
-আগে থেকে বলা যাবে না। খেয়েই বলবেন। ছোট করে উত্তরটা দিল তাবাসসুম।
-ঘ্রানে জিভে পানি এসে গেছে। দ্রুত দাও মা। (শশুরের আবেদন)
শাশুড়ি এক পিস লাউ নিয়ে চাপ দিল, অমনি ফস করে গলে গেল। কয়েকটা নিয়ে যাচাই করে দেখল। কিন্তু না সবই তুল তুলে নরম। বড় বিস্ময়কর। তারপর খাওয়া আরম্ভ করল। প্রথম দু পদ গালে তুলে শাশুড়ী বললেন,,
-বাবা কালকে দেখিস তো অমন পাকা লাউ আর পাস কিনা?
-বাক্যটা শুনতেই তাবাসসুমের মন আনন্দে নেচে উঠল। বাচ্চাদের মতো হুটোপুটি খেতে লাগল। আড় চোখে তাকাল প্রিয়তমের দিকে। চোখে চোখ পড়ে গেল। চোখাচোখি হলো। তার নীরব দৃষ্টি মরুর বুকে জেগে ওঠা ঘুর্নির মতো তাবাসসুমের মনে পাক খেলো একবার। ক্রমেই তাহসিনের মুখ থেকে কালো মেঘ সরে গেল। বিরাগ বিরক্তি অনুরাগ অনুরক্তিতে রূপান্তর হল। বিমুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো প্রিয়তমার নূর ঝলমল চেহারার দিকে। কানে হলো মধুবর্ষণ। হৃদয়ে আনন্দের প্লাবন। সমস্ত অস্তিত্বে বয়ে গেল আনন্দের শিহরণ। অন্তরের সব অন্ধকার গলিপথে আলোর বিচ্ছুরণ। দুজনের চোখাচোখিতে ভোরের নিখাদ পবিত্রতা ও কাশফুলের শুভ্রতা মিশে আছে। পই পই করে বুঝে আসল কুরআনে বর্ণিত চক্ষু শীতল হওয়ার মর্ম।
-প্রভু আমাদেরকে চক্ষু শীতলকারী স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততি দান করুন।
সুরা ফুরকান-৭৪