– তমসুর হোসেন
মঙ্গলবারের জমজমাট হাট যাত্রাপুরের । সূর্য ডুবে গেছে অনেক আগে। রাত বাড়ছে। লোকজন কমে হাটখোলা ফাঁকা হয়ে গেছে। বেশি রাত অবধি দোকানপাটে ঘুরে ভিক্ষা করলেও একটি কাজ না করে ময়েজ কখনও বাড়ি ফেরে না। তা হল কেরোসিনের ডিব্বা জ্বালিয়ে গলি ঘুপচিতে পড়ে থাকা চকচকে পয়সা কুড়ানো। লোকে তাকে জনম কানা বলে জানে। সাবানন্দ, গাড়–হারা, বালাডোবা, বেগমগঞ্জ এমনকি গোদমখাওয়া সিতাইঝাড়ের একটা পোকাও যদি টের পায় জনম আন্ধা ময়েজ বাত্তি পুঁড়ে হাটখোলায় পয়সা খোঁটে, তাহলেই হয়েছে এক কাÐ! গ্রাম ঘুরে ভিক্ষা মেঙ্গে তাকে পেট খোরাকি করতে হবে না। এ জমানার পোলাপানের যা বদ খাছলত, না জানি তার গলায় কালিমাখা হাড়ি ঝুলিয়ে হাটে বাজারে চরকি ঘুরান ঘুরিয়ে ছাড়ে। সেজন্য এ কাজটা খুব সাবধানে করে থাকে সে। যাতে পরিচিত লোকের সামনে পড়ে তাকে জিল্লতি ভুগতে না হয়।
পয়সা কুড়াতে ময়েজের গভীর রাত হয়। পয়সা খুব যে একটা মেলে তা নয়। এটা হল লোভের চরকিতে উড়ে বেড়ানো। মানুষ বাজার করতে এসে পয়সা মাটিতে ছিটিয়ে যায় না। তারপরও একটা বিষয়, পয়সা হল চাকতি জিনিষ, সতর্ক থাকলেও পড়ে যায়। মন লাগিয়ে তালাশ করলে পঞ্চাশ টাকা মিলে যাওয়া কোন বিষয় নয়। একদিনের কথা। সেদিন ধানের বাজারে বেসুমার ধান উঠেছিল। তিনশোবিঘা, তিনহাজারি, বারোবিশ ও দাঁতভাঙ্গা হতে বাদামতোলা নৌকায় ধানের বড় বড় মহাজন এসে বসেছিল কেনাকাটার জন্য। আলাভোলা দখনে বাতাসও ছিল সেদিন সারা হাটখোলা জুড়ে। সেই রাতে পয়সা খুঁজতে খুঁজতে সুপারিপট্টি হয়ে যেই ধানহাটির কানিতে পাড়া দিয়েছে ময়েজ, অমনি দেখে পাঁচটা চকচকে আধুলি মাটিতে পড়ে আছে। একটু দ‚রে কাগজের নিচে সে দেখতে পেল একখানা মচমচে দশ টাকার নোট। ময়েজ অনুমান করল আজ ছক্কা মাত হতে পারে। মাটিতে চোখ লাগিয়ে সারা ধানহাটি চষতে লাগল সে। একটা লটর পটর দোকানের পেছনে এক টুকরা কাগজে কে যেন পান খেয়ে কড়া পিচকি ফেলেছে। অন্য সময় ওটা নাড়লে ঘেন্নায় বমি আসত ময়েজের। দোনমনো করে লাঠি দিয়ে কাগজখানা উল্টিয়ে লাফ দিয়ে উঠেছিল সে। ওরিব্বাশ! নিজের চোখকে বিশ্বাসই হচ্ছিল না। পাঁচশ টাকার নোট পেয়ে উত্তেজনায় বুকখানা ধড়াশ ধড়াশ করতে লাগল তার। হাটখোলায় তখন একটি জনপোকাও নেই। সে রাতে বাজারের কোন জায়গা খোঁজা বাকি রাখেনি ময়েজ। বাতির তেল ফুিরয়ে গেলে তবেই সে বাড়ির দিকে রওনা দিয়েছে।
সেই থেকে পয়সা কুড়ানো তার নেশায় পরিণত হয়েছে। ঝড়-বাদলা, বান-বন্যা তাকে এ কাজ থেকে বিরত রাখতে পারে না। তার এলাকার কোন শালপইতের যাত্রাপুরে ব্যবসাপাতি নেই। একবার গোদমখাওয়ার বংমারা কজন ছেলে চিটাগুড়ের কারবার করতে হাটের কানিতে একটা গুদাম ঘর তৈরি করল। শোনা গেল তারা হরেক রকম মালমাত্তার মজুদদারি শুরু করবে। বাজারে অনেক সময় ধান, পাট, কলাই, সরিষা আদনা দামে পাওয়া যায়। খরিদ করে গুদামে রাখলেই হল। উঠতি দাম দেখে বেচতে পারলে কেল্লা ফতেহ। সেই সময় ময়েজ দারুণ ফাঁপড়ে পড়েছিল। তারা গুদাম ঘরটা তুলেছিল বাজারের মুখ বরাবর। আর সিতাইঝাড় গোদমখাওয়ার মোবাইলডাঙ্গা ছেলেরা অনেক রাত ধরে আড্ডা মারা শুরু করেছিল সেখানে। ওদের চোখ থেকে বাঁচার জন্য তাকে সুপারিপট্টি, মনুহারি দোকান আর গোরুর দালালের ছাপড়ার পাশে হামকুড় দিয়ে পয়সা কুড়াতে হত। হঠাৎ কী হল! ভাই ভাই কাজিয়া করে সেই গুদামঘরটা বন্ধ হয়ে গেল। এখন ওসব ফক্কাবাজরা কোথায় থাকে ময়েজ জানে না।
আজ তার মন ভালো মন্দে মিশেল। আকাশে জোসনা জ্বলছে। একটা মুরগির বা”চা পেয়েছে সে হাট কুড়োবার সময়। কিছু খুচরা পয়সা জুটেছে। গুনলে চার পাঁচ টাকা হতে পারে। একটা টলের নিচে বা”চাটা চিঁচিঁ করছিল। কেউ মনে হয় বেচার উদ্দেশে এনেছিল। পাজিটা হাত ফসকে ছুট দিয়েছে। এই বয়সে কতটা দৌড়ানো যায়। ওটা ধরতে ময়েজের ধকল কম হয়নি। অনেকদিন থেকে তার মুরগির কলজি খাবার সখ। ওটাকে বাড়িতে নিয়ে সে নিজ হাতে জবাই করবে। পরের জিনিষ, দামটা অসুল হবে না। এসব ভেবে লাভ নেই। ফকিরের জন্য সব হালাল। বালা মুছিবতের আবর্জনা গিলে সে সুস্থা সবল আছে। মুরগি জবাই করলে তেল মশলার দরকার হবে। গরম মশল্লায় কসানো মুরগির ঝোল দিয়ে ভাত গিলতে শান্তি লাগত। হাউসের কী আছে! ঘরে নুলা বাশলি বউ। এই ঠাÐায় বিবিজান গরম ভাতের মুখ দেখাবে তা ভাগ্যের বিষয়। জনম আন্ধা নয় ময়েজ। ছোটবেলায় চোখের অসুখ হয়েছিল তার। বাও লাগা না চক্ষু সান্নিক ভালো করে বলতে পারে না সে। মা তাকে বৈদ্যের কাছে নিয়ে গিয়েছিল। বৈদ্য চোখে কড়া ঔষধ ঢেলে দিয়েছিল। সেই ঔষধের ঝাঁঝে চোখ এমন ফুলে উঠেছিল যে বাঁচার কথা ছিল না। অনেক চিকিৎসায় সে সুস্থা হয়েছিল বটে চোখের ঝাপসা কেটে যায়নি। চোখের উপরের চামড়া ঝুলে এমন দশা হয়েছে ও দেখা না দেখার শামিল হয়েছে। সেই থেকে সাতগ্রামে সে অন্ধ ময়েজ নামে পরিচিত।
চৈত্রের নিরালা রাত। বাঁধটা পশ্চিমে ফেলে বাড়ির দিকে হাঁটে ময়েজ। একটা খারাপ অভ্যেস আছে তার। পথ চললে কথা না বলে থাকতে পারে না। বসন্তের ধোঁয়াটে রাত চোখে বিভ্রমের সৃষ্টি করছে। হাঁটছে সে অনুমানে। আন্দাজে ফেলছে প্রতিটি পদক্ষেপ। এ পথ তার সুখ-কল্পনায় মাখা। চোখ বেঁধে দিলেও মটকির মতো গড়িয়ে যেতে পারবে। রাতে সে পথ চলতে বেশি পছন্দ করে। আজ সে ভিক্ষা করতে গিয়েছিল আটা খাওয়ার চরে। সেখানে চাউলি প্যারা, মাছকলাইয়ের আবাদ ওঠেছে। সেই ভিক্ষা কুড়িয়ে তার মন ভালো নেই। বিকেলে গজরাতে গজরাতে হাটের দিকে রওনা দিয়েছিল সে। “হালায় চৈত মাসে চর চাচড়ায় ভিক মাংগতে যামু কি! পাড়ার ধুমড়ি ছেরিরা গমের মইদ্দে বালু দিয়া যা ফোক্কর ফোক্কর শুরু কইরা দেয়, গলা ফাডায়া চিক্কুর দিলেও হুনবার পায় না। এগুর কানে বাতাস দিতে দেহি মজ্জিদের হরেণ লাগে। বেহায়া শালিগো কই, মঙ্গা দিনে সতিনের বাপের বাড়িত নায়ওর যাগা। সোয়ামির মাকু চলে না শিয়ালি গম চাইল করার বাকরোষ কত। শালির বেডিরা, সস্তা ভিক দিয়া যে ফকিরগো খেদাস তোর বুড়া লাঙ্গে কি এউগলা গিলবার পারে?”
গৌরির চরের দক্ষিণে চিকন বালু পড়েছে। এখান থেকে রেলবাজার পর্যন্ত অনি মামুদ সরকারের জোত। বেচারা কিছু জমি প্রজাপত্তন করে জমিদারের খাজনা শোধ করেছে। কী সোনার সম্পত্তি ছিল! রাক্ষুসি নদির পেটে একবার যে জমি ঢোকে তা আর আস্ত থাকে না। হাতি খাওয়া কলাগাছের মতো বিশ্রি দশা হয়। এদিকে মানুষ গোয়ালবাড়ি তুলেছে। বাংগি, তিতকরলার আবাদ প্রচুর জমেছে। মিঠকুমড়া ভুট্টার খেত পাহাড়ের মতো ফুলে আছে। সবখানে অভাবের খাউ খাউ। গোয়ালঘরে রাত জেগে লোকজন ওসব পাহারা দেয়। মুরগির বা”চাটা বিরক্ত করছে। মিঠি মিঠি ঠাÐা পড়েছে। কোটের ভেতর ঢুকতে চায় ওটা। একটা লোক ময়েজের কষ্ট দেখে দান করেছে কোটটা। ভেতরটা পশম দিয়ে মোড়ানো। বেশ গরম। সামনে দুটো বড় পকেট। একটাতে দুকেজি করে চাল ধরবে। একটা পকেটে বা”চাটাকে ঢুকিয়ে দেয় ময়েজ। আরাম পেয়ে নরম কণ্ঠে চিঁচিঁ করে ওটা। মনে হয় মুরগির পাখার তলে স্থাান পেয়েছে। পায়ের নখ দিয়ে খুরখুর শব্দ করছে। ময়েজের হাসি পায়। পাকা দাঁড়ি আর অদ্ভ‚ত কোটের ভেতর থেকে খকখক হাসে সে। রাতের নীরবতা ভেঙ্গে তার হাসির শব্দ খুব একটা বিস্তৃত হল না। সুপারির কষটা লেগে রাতে শ্বাসকষ্ট হয়। তার উপর বেতাল বাতাস, চিমসে রোদ বুকে পাথর চাপা দেয়। কাঁধের বোঝা নামিয়ে বালুতে বসে খানিকটা জিরিয়ে নেয় সে। বয়স তো কম হল না। ভুরুর চুলে পাক ধরল। তার সাথিরা কত আগে টিকিট কেটেছে। যে বয়সে মানুষ পাছার কাপড় তুলে ঘুম পাড়ে সে বয়সে টই টই করে ঘুরে বেড়ায় সে। মুরগির কথা ভেবে মুখে পানি আসে তার। পকেটে হাত দিয়ে আদর করে সে। সংসারে তো মোটে দুজন। মাইফুল তো ব্রেনসর্ট মহিলা। একটু ঝোল পেলে সে খুশিতে ভুষি হয়ে যাবে।
মনের কষ্ট কার কাছে বলবে ময়েজ। লোকটা পরিষদের সেক্রেটারি। সে তার মায়ের রুহ সাফাতের দোয়ার অনুষ্ঠান করেছে। দশজন ফকির চেয়েছিল ময়েজের কাছে। প্রত্যেক ফকিরকে বিশ টাকা দান করতে চেয়েছিল। স্পেশাল খানা তো হবেই। কথা মোতাবেক দশজন পিওর ফকির নিয়ে ভোর কা ভোর সে পৌঁছেছিল তালুকশ্যামপুর গ্রামে। খুটে খুটে এক লক্ষ কলেমা খতম করে খেতে বসে ময়েজের দেমাগ বিগড়ে গেল। আলাদা প্যান্ডেলে চেয়ারে বসে যারা খাচ্ছে তারা মউতের জন্য এক ছটাক দোয়াও করেনি। অথচ তাদেরকে বহুত তাজিম করে খাওয়ানো হচ্ছে। জিহŸার ব্যথা করে দোয়া পড়ে পাতে পড়ল সস্তা আলুর ফালা। ময়েজের চোখে পানি আসল। অনেক আশা নিয়ে সে খেতে বসেছিল। নিজেরা তো কপালপোঁড়া। খুঁজে খাওয়া ভুখা মিসকিন। ভিখ না করলে পেটে ভাতে দরশন হয় না। মউতের চল্লিশায়ও পক্ষপাতিত্ব চলছে। ক্ষোভে লাঠি দিয়ে মাটিতে গুতা মারে ময়েজ। “ফকিরকে আছুদা কইরা খিলাইবার পার না বড়লোকি মারাও। খয়রাতি গম বেইচা মার তামদারি কর। বেজু বেনামাজিরে খিলাও গোস্তের ঠুমা। তোমার মায় ভেস্ত যায় না জান্নামে পৌঁছে সেটা বুঝবা পরে। তোমার বাপ হইল গিয়া নোয়ারি তসলেম। চরের ঘাস বেই”চা তোমারে পড়া শিকাইছে। এহন তুমি হইলা গিয়া গম চোরা সেরকেটারি।”
আঁধারের জালে এলোমেলো পা ফেলতে থাকে ময়েজ। চতুর্দশির চাঁদ অনেকটা পশ্চিমে সরে গেছে। ডিব্বা থেকে দোক্তা বের করে মুখে দেয় সে। এতক্ষণে বাড়ি পৌঁছার কথা। পথ কী ভুল হয়েছে। চিন্তার বিষয়। এটা কোন রাস্তা। সামনে বালু আর বালু। বাড়িঘর নজরে পড়ে না। ভুলে ধরল নাতো! গত হাটবারে চার যোয়ানকে ঘুরে নিয়ে বেড়িয়েছে যে পিশাচ, সেটা ওর উপর আছর করেছে নাকি। গায়ে থুথু ছিটায় ময়েজ। “পিশাচি করবার জাগা পাস না। আমি হইলাম হাড্ডি চোষা ফহির। কত জখাজখিরে কাইত করলাম। তুই আইচস আমার লগে চশকা করতে। গাইটা ব্যাতের বাইরান যদিল না খাইবার চাস তয় ভালয় ভালয় রাস্তা ছাইড়া দে।” এক হুজুর কইছিল কোরান শরিফে জিন খেদাইন্না ছুরা আছে। পাক সাফ মতো আমল করলে জিন হাসেল করা যায়। ময়েজের প্যাটে নাই কালা অক্ষর, সে এহন যাইব চেঙ্গু দিয়া জিন মারতে। ইসরে, একটা কাজের কাজি জিন যদি হাসেল করা যাইত। সারে জাহানের বাদশাই করা ব্যাপারই হইত না।”
দুটো হুলো বালুর চরে বিবাদ করছে। ওদের আওয়াজ শিশুর মতো মনে হয়। ময়েজ ভেবে পায় না এত রাইতে ওদের কাইজা কিসের। একটা উরচুঙ্গাও তো এখানে মিলবে না। হুকনা মুখে কিসের ঝগড়া ? ছোটবেলার কথা মনে পড়ল ময়েজের। তখন সে লেংটি পড়ে রাখালের গোরুর পেছনে ঘোরে। সেই সময় একটা হুলো দারুণ বজ্জাতি শুরু করল। কয়েক রাতে তাদের সাত জোড়া লকপকা কবিতর সাবাড় করে দিল। খোয়াড়ের হাঁস-মুরগি ধরে নিয়ে মজা করে খেতে লাগল বেতমিজ হুলোটা। তখন এক গুটিডাংগা বাউদা ছোড়া করল দুষ্টামি বুদ্ধি। খোকশার আটা আর বিলাতি পাউডার দিয়া সে এক মজাদার সন্দেশ তৈয়ার করল। এমন মজার খাবার পেট পুরে খেয়ে জঙ্গলে চলে গেল হুলোটা। আর যায় কোথায়! দাঁত বের করে কিছুক্ষণ হাসে ময়েজ। খোকশার আটা আর বিলাতি দুধের কিসসা কি সে মছ্ছব জানে ? বাহ্য-পেছাব বন্ধ হয়ে জঙ্গলে ওঁয়া ওঁয়া চিৎকার করে শেষে ফাসকার টেকে পাড়ি জমাল। হঠাৎ হুলো দুটো ছুটে আসতে লাগল ময়েজের দিকে। ওর চারদিকে তারা লাফালাফি শুরু করে দিল। একটা লাফ দিয়ে উঠল তার গায়ে। তার সাথে অন্যটাও। কী আজব কাÐ শুরু হল! ভয় পেয়ে গেল ময়েজ। ওদের আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য হাতের লাঠি ঘুরাতে লাগল সে। তাতে ওরা আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠল। একসাথে ঝটিকা আক্রমণ চালাতে লাগল ওর ওপর। সেও লাঠি ঘুরিয়ে বাতাসের সাথে উড়াতে লাগল। বেগতিক দেখে রণে ভঙ্গ দিয়ে পালিয়ে গেল হুলোরা।
হুলো থেকে রক্ষা পেয়ে এলোপাতাড়ি হাঁটতে লাগল ময়েজ। হঠাৎ তার চোখ থেকে একটা কালো পর্দা সরে গেল। সবকিছু সে ভালোভাবে ঠাহর করতে পারল। ওই তো বাবর হাজির বাঘডোকরা খয়ার বাগান! গতবার ওই বাগানে একটা চিতাবাঘ এসেছিল। একটা গোরু মেরে বাঘটা রাখালের সামনের পাটির দাঁতও খুলে নিয়েছিল। তিনজন পাক্কা শিকারি অনেক কৌশল করে বাঘটাকে মেরেছিল। ওখানে এসে তার পেটটা মোচড় দিয়ে ওঠল। সকালে না খেয়েই বেড়িয়েছিল সে। নুলাবাশলি বউ, ঠাÐায় জড়সড় হয়ে থাকে। দুপুরে তার পেটে ক্ষুধার মহিষ বাগাড় দিয়ে ওঠল। চর চাচড়ার বউবেটি হাউস করে অনাথ মিসকিনকে কি খেতে দিতে পারে। ভালো ঘরের মেয়ে বিয়ে হয়েছে আটঘরিয়া চাষার সংসারে। ময়েজের শুকনা মুখ দেখে সেই বেচারির মনে হয় মরা বাপের কথা মনে পড়েছিল। একটা বিচিকলা আর গমের গুড়া সে এগিয়ে দিয়েছিল তার সামনে। পানি ঢেলে সেই গুড়া খেয়েছিল সে পেট পুরে। তারপর প্রাণ ভরে সেই বেচারির জন্য সে দোয়া করেছে। ক্ষুধার সময় মুখের সামনে যে খাবার এগিয়ে দেয় তার জন্য দোয়ার কোন অন্ত থাকে! সেই বেটির নাস্তার গুড়া মনে হয় তার ক্ষতিই করল। পেট মোচড় দিয়ে পরপর দুই ঝাকা দাস্ত হল তার। তাতেই তার শরীরখান দশদিনের জ্বরের রুগির মতো অসুস্থা হয়ে গেল। ঘাড়ের বোঝা কাছাড়ে রেখে হাজির দিঘিতে ভালো করে পানি খরচ করল সে। দাস্তর পর খুব ঘুম পাচ্ছিল তার। বালুতে শুয়ে তার ঘুমাতে ইচ্ছে করছিল। কত রাত হয়েছে দিশা পায় না ময়েজ।
গত বন্যায় তার বাড়িতে বড়সড়ো কুড়া পড়েছিল। এবার সে ঘর তুলেছে হারানঘাটুর পোঁড়ার চরের জোতে। সে এক লম্বা কিসসা। চর দখল করতে অনেক লোক এনেছিল হারান-ঘাটু দুই ভাই। বিশাল গ্রাম বসেছিল। সেই গ্রামে আগুন দিয়েছিল মোকারম ডাকাতের ছেলে আজগর আর মোকাদ্দেস। সে ঘটনা নিয়ে বহুত মামলা মোকদ্দমা চলছে। সে ফকির মানুষ। মামলায় যে জিতবে তাকে বাপজান বলে সালাম করবে। তার বাড়িটা শ‚ন্য পাথারে বুক চাপড়িয়ে রোদন করে। ফকিরের কি কোন সমাজ জামাত আছে। কারও বাড়িতে মউতের কুলখানি হলে তার খোঁজ হয়। কথায় বলে অমন ঘুঘুনাচা বাড়িতে সলেয়া এসে পেয়াদা হয়। এবার তার বাশলি ভোগা বউ একটা আধামরা বকরি বর্গা এনেছে। ছাগল পুষে এখন ধনপতি সদাগর হবে। মাঝ থেকে পেচ্ছাবের সাটানি গন্ধ ময়েজের ভ‚ড়িতে গ্যাস্টিক বাড়ায়। একটা কথা চিন্তা করে তা সহ্য করে সে। ছেলে মেয়ে তো নেই। ম্যাম্যানি বকরিটা পেলে বেচারি যদি কিছু আরাম পায় দোষ কি। দুপায়ে কাঁশের গুতো খেয়ে বাড়িতে পৌঁছে যায় ময়েজ। আঙিনায় ঘাড়ের বোঝা নামিয়ে সে চিৎকার দেয়,“ও বুড়ি দজ্জা খোল। দুবার বাহ্যি কইরা চউকে আন্দার দেইকপার নাগচি। তার উপরা গবরির চরে আসন্দি হুলার দাবাড়। বিচিকলা দিয়া গমের ছাতু গিল্যা প্যাটে জোড় বলদের লড়াই। হ্যাগা কাÐ কি? দজ্জা যে খোলাই দেকচি। নাডির গুতায় আইজ তোর জান নিকাল দিমু। খাইলসা বাড়িত দজ্জায় খিল না দিয়া হুইচো কোন আক্কেলে।”
ময়েজের শোরগোলে ঘুম ভেঙ্গে মাইফুল আঙ্গুলে চোখ ডলে। মিনমিন কণ্ঠে সে বলে, “দজ্জা তো বন্ধ কইরা হুইচি। খুলল কেডায়? ছোর আইছিলনি! ছাগলডা দেহিনা ক্যা। বাক্সডা খুলছে কেডায়। ওরে আল্লারে, সব ছোরে নিয়া গ্যাছেরে…
কোন বজ্জাত বাইদার পোলা, মরাকাটা কাটিহারার নাতি এই কাম করল। হের মায় কি আঁচলে খুদি বাইন্দা ভাসুরের লগে দ্যাশ ছাড়ছে। হতাল হউরির চ্যাংগা খাওয়া বউ নিয়া হে কি কাউয়ার চরে ঘর বান্ধচে। বউয়ের গলা হারগিলার লাহান লম্বা। সেই গলা ভরাইবার লাই ফকিরণির ছাগল ছুরি করে। মায়ের থন চুইসা প্যাট ভরে নাই, মাইফুলের বকরির মুত হাড়ির মদ্দে ভাইজা খাউগ্যা।”
লাঠিতে ঠেস দিয়ে ময়েজ পাথরের মতো দাঁড়িয়ে থাকে। ওই বাক্সে তার হাট কুড়ানো ছয় মাসের কাচা পয়সা জমা ছিল। অসুস্থা শরীরে এরকম ঘটনার ধাক্কা সহ্য করা তার পক্ষে মোটেই সম্ভব নয়। হাতের লাঠি দরজার ফাঁকে রেখে সে বিছানায় গা এলিয়ে দিতে মনস্থা করে। সহসা মুরগির বা”চার কথা মনে পড়ে তার। পকেটে হাত দিয়ে ময়েজের জবান সরে না। “পকেট থনে লাফ দিয়া বা”চাটা কোন সম জানি ভাগচে।” বড় পকেটটার এদিক ওদিক ভালো করে খোঁজে ময়েজ। মুরগির তাজা বিষ্টা ছাড়া সেখানে সে কিছুই পায় না।