11.8 C
New York
Monday, May 6, 2024
spot_img

ছি…!

– তারিকুল আমিন

প্রচন্ড শীত পড়েছে আজ রাতে। ভোর হতে না হতে পাখির কিচিরমিচির শব্দ। তাই আজ সারা রাত ঘুমাতে পারেনি নান্টু। তবে এই পরিস্থিাতি সেই শিশুকাল থেকেই চলে আসছে। তাই শীতও নান্টুকে কাবু করতে পারেনা। এই ভোরবেলা নান্টুর ঘুম ভাঙে কাকের কর্কশ ডাকে। কা..কা…! অন্যদিকে কুকুরের ডাক। খেউ খেউ…! এদিকে কাকের কাঁ কাঁ শব্দের সাথে আস্তাকুঁড় থেকে ময়লা ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাওয়ার শব্দ। এই দৃশ্য নিত্যদিনের। কারণ নান্টুর বেড়ে ওঠা এই আস্তাকুঁড়ের কাক, চড়–ই ও কুকুরের সাথে। নান্টুর চোখে এসে পড়ে রোদ্রের আলো।
রহিম চাচার কোন ঘর ছিল না। ছিল না বউ ছেলে-মেয়ে। সেও নাকি এই আস্তাকুঁড়ে মানুষ হয়েছে। এই রহিম চাচাই নান্টুকে নাম দিয়েছে। হতভাগা নান্টু, রহিম চাচার ভালোবাসাও বেশি দিন পায়নি। আল্লাহর ডাকে তিনি সাড়া দিয়ে চলে যান কিছুদিন হলো। এখন নান্টুর বয়স প্রায় ১০ বছর। নান্টুর উর্ধাঙ্গ অনাবৃত থাকে বেশি সময়। আর নিম্নাঙ্গ ঢাকা থাকে একটি হাফ প্যান্টে। তার বাসস্থাান এই আস্তাকুঁড়ে। তবে সব সময় ও ঘুরে বেড়ায় ফুটপাতে কিংবাপতিত বড় পাইপের মধ্যে, পার্কের বেঞ্চিতে, ভাঙ্গা দেয়ালের পাশে, ঠেলাগাড়ির ওপরে, আবার ইটের ওপরে মাথা রেখে ঘুমায়। নান্টুর নিত্য সঙ্গি কুকুর। ভোরে ঘুম থেকে জাগিয়ে দেয় কাক। কারণ কাকের কর্কশ শব্দতে কেউ ঘুমাতে পারে না। কাক ভোর হলেই কাঁ কাঁ শব্দ করে। মাঝে মাঝে নান্টু বিরক্ত হয়ে কাকের সাথে ঝগড়া করে। কারণ পথে শোয়া মানে আরামে শোয়া যায় না। কুকুরের সাথে নান্টু সারাদিন দুষ্টমি করে বেড়ায়।
নান্টুর বেশি সময় কাটে এই আস্তাকুঁড়ে। এই আস্তাকুঁড়ে থাকতে ওর বড্ড ভালো লাগে। কারণ ওর বিশ্বাস ওর মা-বাবা জীবিত থাকলে একদিন আসবে। এসে যদি না পায় নান্টুকে তাই সেই আশায় বুক বেঁধে থাকে। তাই বেশির ভাগ সময় এখানে কাটায়। নান্টু ময়লার ¯‘পে বসে, শুয়ে, খাবার খেতে খেতে, কথা বলে কুকুরের সাথে, পাখিদের সাথে এবং ময়লার ¯‘পে থাকা ছোট ছোট কীটপতঙ্গের সাথে। গরু, ছাগল ও মশার সাথেও। নান্টু খুব বুদ্ধিদীপ্ত, বিচক্ষণতায় ভরা এবং খুব রসিক মানুষ। নান্টুর নেই কোনো চিন্তা, নেই পড়ার ভাবনা। সারাদিন মনের আনন্দে মার্বেল গুটি দিয়ে খেলা, নৌকা চালানো, বাঁশি বাজানো বা পথে কোন শিল্পীকে দেখলে ছুটে যায় সেখানের বাদ্য বাজনা শুনতে। অনুরোধ করে সেও বাজাবে। কেউ শিখিয়ে দেয় আবার কেউ তাড়িয়ে দেয়। কেউ আবার গালমন্দ করে। নান্টু লিখতে পারে না। হাত দিয়ে মাটিতে উঁবু হয়ে আকাঁ-আঁিক করে। কখনও আনন্দে দেয় ছুট। কখনও একা বসে থাকে, আবার দেয়ালে শুয়ে আকাশ দেখে। আকাশে উড়ে যাওয়া পাখিদের ডাক দেয়। রাতে শুয়ে তারা ও চাঁদের সাথে গল্প করে। মাঝে মধ্যে খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে।
সকাল হলে পেটের ক্ষুধা মেটানোর জন্য হাতের বস্তা নিয়ে বেরিয়ে পড়ে পথে। কুঁড়িয়ে যা পায় তা দিয়ে সকাল, বিকাল ও রাতের খাবারের বন্দোবস্ত করে। আবার মাঝে মাঝে একবেলা বা দুবেলা না খেয়েও থাকতে হয়। তাও কারো কাছে হাত পাতে না। মাঝে মধ্যে স্কুলের ঘন্টার শব্দ শোনার জন্য ছুটে যায় স্কুল প্রাঙ্গনে। সেই পথে হাজার হাজার ছেলে-মেয়ে চলাফেরা করে। সবার জীবন কোন না কোন ভাবে চাঁদের আলোর মত উজ্জ্বল হয়। কিন্তু নান্টু বা নান্টুদের মত মানুষরা সব সময় অন্ধকারের অতল গহবরে তলিয়ে থাকে। স্কুলের ঘণ্টার শব্দ শুনলে নান্টুরও ইচ্ছা করে স্কুলে পড়বে। স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের দেখে মনে মনে বলে, আমিও তো এভাবে স্কুলে যাইতে পারতাম। আমারও তো মা-বাবা ওদের মতো হাত ধরে নিয়ে যেতো। এভাবে স্কুল প্রাঙ্গনে ওদের মত ছুটে চলতে পারতাম। নান্টু দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার তার সেই চিরচেনা আস্তাকুঁড়ে চলে আসে। সেই অন্ধকার, যেখানে পুরো আকাশের আলো এসে পড়ে কিন্তু নান্টুর কাছে সেই আলো ম‚ল্যহীন।
রহিম চাচা এই আস্তাকুঁেড়র পাশে পলিথিনের ছাউনি দিয়ে থাকতো। নান্টুকে এই আস্তাকুঁড়ে কাঁদতে দেখে কোলে তুলে নেয়। এই রহিম চাচাই নান্টুকে কোলে পিঠে করে বড় করেছে। তিনি মারা যাওয়ার পর থেকেই নান্টু নিজের দায়িত্ব নিজেই নিয়েছে। এভাবেই দিন কাটে, কাটে বছর। অধরা তার পুত্র শোকে আচ্ছন্ন। এতো বছরেও সে তার পুত্র শোক কাটিয়ে উঠতে পারেনি। এখন অধরা অন্যের ঘরের ঘরনি।
রোজকার মত আজও সকালে হাটতে হাটতে অফিসে যায়। তখন পথের পাশে একটি প্রতিবন্ধি বা”চা ও তার মাকে দেখে কিছু সময়ের জন্য হারিয়ে যায় তার অতীতে। রানা অধরার প্রেমিক ছিলেন। অধরাকে নাকি খুব ভালোবাসতেন। তবে এখানে রানা নয়, অধরা জীবন দিয়ে ভালোবেসেছে রানাকে। রানা ছিল খুব জঘন্য ও কুরুচিপ‚র্ণ মানুষ। অধরার সাথে অবৈধ সম্পর্ক করে। অধরা ভেবেছে সন্তান হলেই বিয়ে করবে রানা। কিন্তু রানা তা করেনি। দ‚র দ‚র করে তাড়িয়ে দেয় অধরাকে। অধরা বা”চা প্রসব করেন প্রায় একবছর পরে।সমাজের কটু কথার ভয়ে, লৌক-লজ্জায়, বাবা-মার কথায় বা”চাকে আস্তাকুঁড়ে ফেলে দিয়ে আসে। এমন সময় প্রতিবন্ধি রনি তাকে ডাকে। অধরা হতচকিত হয়ে পরে। পরে অধরা ছেলেটাকে পাঁচটাকা দিয়ে চোখের জল মুছে চলে যায়। নান্টুর বাবা জনাব রানা আরাকটা বিয়ে করেছে। সে ঘরেও একটা পুত্র সন্তান আছে। সে খুব অহংকারী। খুব জেদী। মানুষকে মানুষ বলে গণ্য করে না। রকির হাত থেকে খেলনা পড়ে যায়। সেই খেলনা উঠিয়ে দেয় নান্টু। ধন্যবাদ না দিয়ে বরং নান্টুর থেকে খেলনা নিয়ে তা পা দিয়ে ভেঙ্গে ফেলে। কারণ ও গরিব! ওর খেলনা ঐ পচাঁ হাতে ধরলো কেন? খেলনাটা নাকি নোংরা করে দিয়েছে। এটাই ছিল নান্টুর ম‚ল অপরাধ। এরপর ভেঙ্গে রকি নান্টুকে একটি চড় ও ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়। গিয়ে পড়ে অধরার পায়ের কাছে। নান্টুর অনেকটা ছিলে রক্ত বের হয়। অধরা রানাকে দেখেনি। তবে রানা অধরাকে দেখে চিনতে পারে। রানা তার ভুল বুঝতে পেরে অধরাকে অনেক খুঁজেছে। কিন্তু পায়নি কোথাও।
অধরা নান্টুকে বলল, বাবা তোমার তো পা অনেকটা কেটে গেছে। চল তোমাকে বাসায় দিয়ে আসি। নান্টু বলল, আমার তো…! অধরা বলল, আরে না কর না। চল তোমার বাসায় দিয়ে আমাকে অফিসে যেতে হবে। নান্টু তার কথা বলতে পারলো না। পরে বলল, আমার বাসায় যাইবেন মেডাম। তাহলে চলেন। এরপর নান্টু অধরাকে নিয়ে যায় সেই আস্তাকুঁড়ে। যেখানে নান্টু থাকে।
অধরা যত যাচ্ছেততই পুরোনো কথা মনে করে দ‚র্বল হয়ে যাচ্ছে। স্মৃতিতে সেই পুরোনো কথা মনে পড়ছে। রানাও তাদের পিছু পিছু চলে আসে। রানা অধরাকে অনেকবার ডেকেছে। কিন্তু অধরা শুনতে পারেনি। এরপর নান্টু সেই আস্তাকুঁড়ে এসে থামলো। অধরা বলল, এই জায়গায় কেন বাবা?আর এই জায়গায় তো খুব দ‚র্গন্ধ!এখানে তো কোন ঘর নেই?
নান্টু বলল, মেডাম কই এখানে গন্ধ। আমি তো পাইনা। আপনারা তো বড় লোক, তাই হয়তো গন্ধ পান। জানেন মেডাম, আপনার মতোই একজন নারী তার পাপ হয়তো ঢাকার জন্য আমাকে রাতের অন্ধকারে এখানে ফেলে যায়। তিনি হয়তো আজ খুব সুখে আছে। ছেলে-মেয়ে স্বামী নিয়ে। আর আমার জীবনটা এই আস্তাকুঁড়ের অন্ধকার গহিনে তলিয়ে আছে। তবে আমার কোন অভিযোগ নেই তার বিরুদ্ধে। কত মানুষ আমাকে বলে আমি নাকি ঝাড়জ। আজ এই শব্দটা শুনতে শুনেত বড় হয়েছি। আচ্ছা মেডাম ঝাড়জ শব্দটার অর্থ কী? এই কথা শুনে অধরা ভেঙ্গে পড়ে। কান্না জুড়ে দেয়।
নান্টু বলল, মেডাম এই জায়গাটা সেই থেকে আমার ঘর। আপনাদের ঘর থেকে আমার ঘর বিশাল বড়, তাই না মেডাম? অনেক আলো বাতাস যাওয়া আসা করে। আর আপনারা ঠাণ্ডা হাওয়ার জন্য এসি লাগান, ফ্যান লাগান আরো কত কি? অধরা স্তম্ভিত হয়ে শুধু প্রশ্নগুলো শুনছে। কারণ, বলার মত কোন ভাষা নেই অধরার কাছে।
নান্টু বলল, মেডাম ঐ আকাশ দেহেন ঐডা আমার ঘরের চালা। এই যে মাটি দেহেন, এটা আমার বিছানা। আর ঐ যে পাশে কুকুর। ও! ও আমার মাঝে মাঝে বালিশ হয়। আমার শরীরে হ্যালান দিয়ে শুয়ে থাকে। আর এই বস্তাটা দেহেন এটা আমার বন্ধু। শীত কন, রোদ কন, বৃষ্টি কন সব থেকে আমারে রক্ষা করে। শুনতে শুনতে অধরা এখন আর কিছু বলতে পারেনা। সে অঝরে কান্না করে, খুব কষ্ট করে, বুকে পাথর চেপে, খোকা বলেই ফেলে নান্টুকে। নান্টুকে গিয়ে জড়িয়ে ধরে অধরা। পাশে রানা শুনে নিজের ভুল ভেবে বলার কিছু থাকে না।খোকা শব্দটা শুনে নান্টু অবাক হয়। নান্টু কিছু সময়ের জন্য মার কোমল পরশ অনুভব করলো। নান্টু অনেকদিন পর মার আদর পেলো। সেই আদর অনুভব করা দীর্ঘস্থাায়ী হল না। পরে আস্তে আস্তে হাতটা ছেড়ে দিয়ে চলে যায়। অধরা খোকা বলে ডাকে। অধরার ডাকে নান্টু সাড়া দেয় না। কিছু দূরে গিয়ে বলে ‘ছি’! ]

Facebook Comments Box
প্রতিধ্বনি
প্রতিধ্বনিhttps://protiddhonii.com
প্রতিধ্বনি একটি অনলাইন ম্যাগাজিন। শিল্প,সাহিত্য,রাজনীতি,অর্থনীতি,ইতিহাস ঐতিহ্য সহ নানা বিষয়ে বিভিন্ন প্রজন্ম কী ভাবছে তা এখানে প্রকাশ করা হয়। নবীন প্রবীণ লেখকদের কাছে প্রতিধ্বনি একটি দারুণ প্ল্যাটফর্ম রুপে আবির্ভূত হয়েছে। সব বয়সী লেখক ও পাঠকদের জন্য নানা ভাবে প্রতিধ্বনি প্রতিনিয়ত কাজ করে চলেছে। অনেক প্রতিভাবান লেখক আড়ালেই থেকে যায় তাদের লেখা প্রকাশের প্ল্যাটফর্মের অভাবে। আমরা সেই সব প্রতিভাবান লেখকদের লেখা সবার সামনে তুলে ধরতে চাই। আমরা চাই ন্যায়সঙ্গত প্রতিটি বিষয় দ্বিধাহীনচিত্ত্বে তুলে ধরতে। আপনিও যদি একজন সাহসী কলম সৈনিক হয়ে থাকেন তবে আপনাকে স্বাগতম। প্রতিধ্বনিতে যুক্ত হয়ে আওয়াজ তুলুন।

বিষয় ভিত্তিক পোস্ট

শহীদুল ইসলামspot_img

সাম্প্রতিক পোস্ট