মুসরাত আলম
অধ্যায় ১: ফেরত আসা
রুহানি ছোটবেলায় যে বাড়িটিতে বড় হয়েছিল, সেটি এখন ধূসর, নিশ্চুপ এবং ভয়াবহ নিস্তব্ধতায় ঢাকা।
তার বাবার মৃত্যুর পর সাত বছর গ্রামে কেউ পা রাখেনি, আর এখন সে একাই ফিরছে। গ্রামের নাম
‘চাঁদপুর ঘোনা’ – একসময় যার নাম ছিল শান্তির প্রতীক, এখন লোকেরা বলে, “সন্ধ্যার পর ওইদিকে
গেলে নামাজ পড়ে যেও।”
ঢাকা থেকে বাসে পাঁচ ঘণ্টা পথ, তারপর অর্ধেক ভাঙা কাঁচা রাস্তা ধরে রিকশাভ্যানে দুলে দুলে সে
পৌঁছায় হাসান ভিলার সামনে। কাঁধে ছোট ব্যাগ, হাতে একটি চাবির গোছা—যেটি তার বাবার ব্যবহৃত
ছিল, চাবিগুলো মরিচা ধরা, অনেকটা যেন সময়ের মতই মৃত।
গেটের তালা খুলতেই কড়কড় শব্দ হয়। ধুলো ও পচা পাতার গন্ধে চোখ জ্বালা করে। গেট ঠেলতেই
একদম ভেতর থেকে হালকা ধাক্কার মতো লাগে। যেন কেউ ধরে রেখেছিল।
রুহানি দাঁড়িয়ে পড়ে। মনে হয় কেউ তাকিয়ে আছে।
এখানে সব কিছুই থেমে আছে, শুধু সময় নয়। মেঘলা আকাশে সূর্য ঢাকা, হালকা বাতাসে শুয়ে আছে
পাতার আওয়াজ, কিন্তু সেই সঙ্গে আসে অন্য এক অদৃশ্য চাপ—যা বুকের ভেতরে ঢুকে নিঃশ্বাস ভারি
করে দেয়।
ভবনটির দরজায় হাত রাখতেই কাঠের গায়ে একটা আঁচড় নজরে পড়ে। বিশাল, অনেকটা নখের মতো
লম্বা রেখা। দরজা খুলতেই হঠাৎ শো শো করে বাতাস ঢুকে পড়ে ঘরে—আর গন্ধটা আসে… সেই চেনা
ঘ্রাণ—পুরনো চুলা, ধুলা, আর যেন কোথাও পচে যাওয়া কিছু।
রুহানি লাইটের সুইচ টিপে। কাজ করে না। অনেক বছর তো কেউ ছিল না।
হঠাৎ মনে পড়ে যায় গ্রামের মকবুল কাকার কথা। সেই যে চা দোকানে বসে কাকা বলেছিল:
“তুই ফিরছিস শুনে খুশি হয়েছি মা। কিন্তু ওই ঘরটা… এখন আর আগের মত নাই। তোর আব্বার
জানাজার রাতেও আলো আপনাআপনি জ্বলে উঠছিল… দরজাও নিজে খুলে গেছিল….”
তখন ভেবেছিল বয়স্ক মানুষের গল্প। এখন মনে হচ্ছে সব কিছু অত অলীক নয়।
রুহানি ঘরে ঢুকে পড়ে। জানালানার ধারে পুরনো সোফা, দেয়ালে তার ছোটবেলার ছবিগুলো- মা, বাবা,
হাসিমুখ। এখন সেই ছবিগুলো মলিন, ফ্রেমে ধুলো, আর চোখে যেন বিষন্নতার ছায়া।
সে মনে মনে বলে, “আমি শুধু কিছুদিন থাকব। পুরনো কাগজপত্র গুছিয়ে চলে যাব।” কিন্তু ঘরটি যেন
অন্য কিছু চায় ।
রাতের খাওয়া শেষ করে সে শুয়ে পড়ে নিজের পুরনো ঘরে। ঘড়ির কাঁটা টিক টিক করছে। হঠাৎ জানালার
কাঁচে আওয়াজ—
“টাপ…টাপ…”
কেউ যেন আঙুল বুলিয়ে দিচ্ছে বাইরে থেকে
রুহানি উঠে দেখে—কোনো কিছু নেই বাইরে। শুধু জানালার কাঁচে একটুকরো ভেজা ছাপ। গোলাকার, যেন
কোনো মুখ ছিল সেখানে।
অধ্যায় ২: ছায়া দেখা যায়
রাত তখন সবে ঘনিয়েছে। চারপাশ নিঃশব্দ, অথচ সেই নীরবতার মাঝেও কিছু একটার হাঁটাচলা যেন
স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বাতাসে যেন চাপা কান্নার গন্ধ, কোনো রকম শব্দ নেই, শুধু একটা অনুভূতি — কে
যেন চারপাশে আছে।
রুহানি ছাদে থাকা পুরনো খাটে শুয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করছে। চোখ বন্ধ করলেই তার মনের মধ্যে ভেসে
ওঠে সেই আঁচড়-কাটা দরজাটা, গেটের ধাক্কা খাওয়া ধাতব কণ্ঠ, আর সবচেয়ে বেশি জানালার কাঁচে
সেই অদ্ভুত ছাপ।
সে হালকা ভাবে বলে ফেলল, “নিজেকে বোকার মতো ভাবছিস, রুহানি। এসবই তো কাকতালীয়।” কিন্তু
এমন সময়, হঠাৎ…..
কচ কচ কচ—
বাড়ির পেছন দিক থেকে আওয়াজ ভেসে এলো। যেন কেউ ভাঙা কাঁচের উপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে, ধীরে
ধীরে। শব্দটা প্রথমে অনেক দূর থেকে, তারপর একদম পাশের ঘরে!
রুহানি বসে পড়ে। বুকের ভেতরে শব্দ ওঠে ঠক ঠকঠক। সে নিজের সেলফোনের টর্চ জ্বালে। আলোটা
কাঁপছে, তার হাতের মতোই।
পাশের ঘরটি… তার ছোটবেলার খেলার ঘর ছিল, এখন বহু বছর তালাবন্ধ। কিন্তু আজ সে দেখল—
দরজাটা হালকা ফাঁকা। তালা ঝুলছে না, বরং দড়ির মতো কিছু দিয়ে বাঁধা। অথচ সে জানে, এই ঘর বাবা
সবসময় তালা দিয়ে রাখত।
হাত বাড়িয়ে দরজার ফাঁক দিয়ে টর্চের আলো ফেলতেই সে দেখতে পেল–ঘরের ভেতরে, মেঝেতে কাঁচ
ভাঙা! আর সেই কাঁচের উপরে ছোট ছোট পায়ের ছাপ। নারী পা, খালি, কাচে রক্তের দাগ ।
হঠাৎ টর্চ নিভে গেল।
অন্ধকারে চারপাশের নীরবতা এক নিমেষে ভারি হয়ে উঠল। সেই সময়, এক নিঃশব্দ আওয়াজ কানে
আসল।
“তুমি…ফিরেছো?”
কণ্ঠস্বর নারীর, শান্ত কিন্তু কাঁপা। যেন কারও মন ভেঙেছে অনেক আগেই, কিন্তু ব্যথা এখনো
রক্তের মতো গড়িয়ে পড়ছে।
রুহানি পিছিয়ে আসে। হঠাৎ তার কাঁধের উপর ঠাণ্ডা স্পর্শ—আঙুলের ছোঁয়া নয়, বরং বরফের
ধাক্কার মতো।
সে চিৎকার করতে চাইল, কিন্তু গলা থেকে শব্দ বেরোল না।
ঘরের দেয়ালের কোণার দিকে হালকা আলো পড়তেই সে দেখতে পেল—একটি ছায়া।
বাতি বন্ধ, আলো নেই। তবুও ছায়াটা স্পষ্ট। একটি নারীর অবয়ব—দীর্ঘ, মাথা নিচু, চুল সামনে পড়ে
আছে। সে কোনো শব্দ করছে না, শুধু স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
রুহানি চোখ বন্ধ করে ফেলল এক মুহূর্তের জন্য ।
কিন্তু চোখ খুলতেই… ছায়াটা এগিয়ে এসেছে, একদম তার সামনে
সে দৌড়ে ঘরের দরজা বন্ধ করল, হাওয়া খোলা জানালা গরম নিঃশ্বাসের মতো কাঁপছে। সে জানে না
এটা দুঃস্বপ্ন, না কি বাস্তবের ঊর্ধ্বে কোনো দুনিয়া যার দরজা আজ হঠাৎ খুলে গেছে।
বিছানায় ফিরে গিয়ে সে কাঁপা হাতে ডায়েরি খুলল। তার লেখা প্ৰথম পৃষ্ঠা:
“বাড়িতে আমি একা, কিন্তু কারও উপস্থিতি যেন সব ঘরের দেয়ালে লেগে আছে। কেউ কি ফিরে এসেছে?
নাকি কেউ ছিলই, সব সময়?”
সে একটাই সিদ্ধান্ত নিল – সকালে মকবুল কাকার সঙ্গে দেখা করবে। তাকে প্রশ্ন করবে, আসলে কী
হয়েছিল এই বাড়িতে?
এবং একবার যদি উত্তর পায়… তারপর কী করবে, সে জানে না।
অধ্যায় ৩: রেকর্ডারে মৃত কণ্ঠ
সকাল। কিন্তু আলো যেন এসেও আসেনি।
রুহানি জানালার পর্দা সরিয়ে বাইরে তাকায়। সূর্য উঠেছে ঠিকই, কিন্তু আলোয় নেই সেই চেনা উষ্ণতা।
বাড়ির পেছনের নারকেল গাছ, পাখিদের ডাক—সবই আছে, তবুও অদ্ভুত নিঃসঙ্গ লাগছে চারপাশ।
সে নাস্তা না করেই বেরিয়ে পড়ে মকবুল কাকার বাড়ির দিকে। কাকা একসময় তার বাবার সঙ্গী ছিলেন,
তারপর গ্রামের ইলেকট্রনিকের দোকান চালাতেন।
কাকা চুপচাপ শুনে গেল রুহানির কথা, তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
“তোর আব্বা বলত, এই ঘরে শব্দ রেকর্ড হলে… সেটা মুছে যায় না। মৃতরাও কথা ফেলে যায়। তোর
ছেলেবেলায় এক রেকর্ডার ছিল, মনে আছে? ওটাই ছিল তোর আব্বার শেষ কাজ।”
রুহানি অবাক। সে সেই রেকর্ডারের কথা ভুলেই গিয়েছিল।
সন্ধ্যায় ফিরে এসে ঘরের এক কোণায় পুরনো কাঠের বাক্সে খুঁজে পেল সেই সাদা টেপ রেকর্ডার।
ধুলোয় ঢাকা, তবুও পুঙ্খানুপুঙ্খ যত্নে রাখা।
রুহানি নতুন ব্যাটারি লাগিয়ে রেকর্ডার চালু করল। একটা পুরনো ক্যাসেট ঢোকানো ছিল। সে প্লে
বোতাম চাপল।
প্রথমে সোঁ সোঁ শব্দ… তারপর ধীরে ধীরে একটা মিহি কণ্ঠ বেরিয়ে এল :
… আমি জানি, সে আমার ওপর বিশ্বাস করেনি। আমি বলেছিলাম আমি একা নই…. আমার ভেতরে কেউ
আছে। সে বিশ্বাস করল না।”
কণ্ঠটা নরম, কিন্তু গলার ভিতর জ্বালাধরার মত ব্যথা। তারপর আবার—টেপে থেমে থেমে কণ্ঠ
শুনতে পাওয়া গেল:
“সে আমাকে বলল, আমি পাপ করেছি। কিন্তু আমি তো শুধু মা হতে চেয়েছিলাম….”
রুহানির হাত কাঁপতে লাগল। টেপে আবার আওয়াজ এলো—কোনো পুরুষ কণ্ঠ:
‘শয়তানের সন্তান! আমি তোকে এই ঘরে বাঁচতে দেব না…”
তারপরই—একটা কষ্টের কান্না। শিশুর। তারপর কিছু নয়, শুধু হো হো হাওয়ার মত শব্দ।
রুহানি টেপ বন্ধ করে দেয়। কিন্তু তখনও রুমে কিছু একটা বাজতে থাকে।
সে তাকিয়ে দেখে—রেকর্ডার বন্ধ, তবুও টেপ ঘুরছে।
হঠাৎ দরজার পাশে রাখা আলমারির দরজা খুলে গেল নিজে থেকে। একটা পুরনো সাদা চাদরে মোড়ানো
বস্তু পড়ে যায়। রুহানি ধীরে ধীরে সেটা খুলে দেখে—একটা ছোট শিশুর জামা। রক্তের দাগ! যেন বহু
পুরনো, তবুও এখনো তরতাজা।
রেকর্ডার থেকে এবার ভেসে এল একদম ঠান্ডা কণ্ঠে একটি নাম:
“রুহানি…
সে দৌড়ে আলমারির দরজা বন্ধ করতে যায়, কিন্তু হাত ফসকে যায়। তার আঙুলে কেউ যেন ঠান্ডা
ছোঁয়া দিল। রক্ত হিম হয়ে গেল মুহূর্তে ।
সে পেছনে ঘুরতেই দেখল—আয়নার সামনে, এক নারীর প্রতিচ্ছবি। সাদা কাপড়ে ঢাকা, গলায় দড়ির
দাগ, আর কোলে এক শিশুর কঙ্কালসার মূর্তি।
কিন্তু সবচেয়ে ভয়ংকর—আয়নায় রুহানির নিজের প্রতিবিম্ব নেই ।
অধ্যায় ৪: মৃতের নামের খাতা
রাত তখন দুইটা বেজে চলেছে।
রুহানি জানে, এই সময়টাতে কিছু একটা বদলে যায়—ঘর নিঃশব্দ হয় না, বরং জেগে ওঠে। দেয়ালে
হালকা ফিসফিস শব্দ, মেঝেতে পদচারণার আওয়াজ, জানালার কাচে অজানা আঙুলের ছাপ। সে জানে না
এগুলো তার কল্পনা, না কি বাড়ির নিজস্ব আত্মা—যেটা এখন ধীরে ধীরে তাকে চিনে ফেলছে।
সে আলমারির সামনে এসে দাঁড়াল। আগের দিন যেখানে শিশুর রক্তমাখা জামা ছিল, সেখানেই ছিল এক
ছোট পুরনো টিনের বাক্স। উপরে ধুলোর স্তর, তবু তাতে এখনো অস্পষ্টভাবে লেখা আছে এক
নাম—“ফারজানা”।
হাত কাঁপতে কাঁপতে বাক্সটা খুলল রুহানি ৷
ভেতরে… পুরনো কাগজপত্র, কিছু শুকনো গোলাপের পাঁপড়ি, আর একটামাত্র খাতা। চামড়ার বাঁধাই,
কালো রঙের, আর তাতে বড় করে লেখা—”যারা ফিরে আসেনি।
সে ধীরে ধীরে খাতা খুলল।
প্রথম পাতায় ছিল শুধু নাম। একটার পর একটা—
১)রাবেয়া খাতুন
২)আনোয়ারা বেগম
৩)তানজিলা আক্তার
৪)সারমিন আরা
আর প্রতিটি নামের পাশে ছিল একটি তারিখ, আর একটি অদ্ভুত চিহ্ন—
বুঝতে পারল না এই চিহ্নটার মানে, কিন্তু অনুভব করল—এটা যেন কোনো শিকল বা আবদ্ধতার
প্রতীক।
রুহানি পাতা উল্টাতে উল্টাতে পৌঁছে গেল শেষ পাতায়।
আর সেখানে যা দেখল, তার চোখ ঠাণ্ডা হয়ে গেল।
সেই পাতায় একটামাত্র নাম, বড় অক্ষরে লেখা :
রুহানি ফারহানা
তারিখ: আগামী শুক্রবার
তারিখটা দেখে তার পা এক ধাক্কায় পিছিয়ে গেল। আজ শনিবার, মানে পরবর্তী শুক্রবার মাত্র ৬ দিন
পর!
সে বিশ্বাস করতে পারছিল না। খাতায় তার নাম কী করে এল? কে লিখল?
ঠিক সেই সময় ঘরের বাতাস বদলে গেল। বাতাসে লবণাক্ত গন্ধ, পুরনো কাপড় ভেজার মতো এক গন্ধ,
আর… এক নারীর নিঃশ্বাস।
খাতার পেছনে হঠাৎ করে আঁচড় পড়ল—নিজে থেকে!
একটি বাক্য ধীরে ধীরে খোদাই হয়ে উঠল সেই পৃষ্ঠায়, লাল কালি নয়—রক্ত দিয়ে
“যদি সত্যি জানতে চাও, নিচতলার ঘরের দরজা খোলো। কিন্তু মনে রেখো… কিছু দরজা একবার খোলার
পর, আর বন্ধ হয় না।”
রুহানি পেছন ফিরে দেখল—ঘরের দরজাটা খোলা! অথচ সে জানে, বন্ধ করেই ছিল। বাতাসে ভেসে
আসছে সিঁড়ির নিচের গন্ধ, সেই ভেজা মাটির ঘ্রাণ যা শিশুকালে সে অনুভব করত, যখন ভয়ে সিঁড়ি বেয়ে
উঠত।
তবু এবার, তাকে নামতেই হবে। ।
রুহানি টর্চ জ্বালিয়ে সিঁড়ি ধরে নামতে শুরু করল। প্রতি ধাপে অদ্ভুত ঠাণ্ডা, যেন পায়ের নিচে মাটি
নয়—বরফ।
নিচে নেমে এল এক পুরনো কাঠের দরজার সামনে। এই ঘরটা সারাজীবন তালাবদ্ধ ছিল। বাবা বলতেন,
“ওটা ওদের ঘর। কেউ ঢুকে না।”
কিন্তু আজ, দরজাটায় কোনও তালা নেই। শুধু একটা ছেঁড়া লাল ফিতা, এক সময় পবিত্ৰ কিছু বাধার
জন্য ব্যবহৃত হত হয়তো।
রুহানি দম আটকে দরজা ঠেলে খুলল।
ভেতরে ঘোর অন্ধকার। বাতাস ভারি। দেয়ালে কেমন একটা রুমালে মোড়ানো ছবি—একটি নারীর, যার
মুখ খালি। ক্যানভাসে শুধু গলার দাগ, চুলের রেখা, কিন্তু চোখ-মুখ নেই। যেন সে সব কিছু ভুলে গেছে।
হঠাৎ ঘরের কোণ থেকে ভেসে এল এক ফিসফিস শব্দ :
“রুহানি… তুই জানিস না, কে তোর অপেক্ষায় আছে।”
রুহানি পেছনে তাকাতে যাবার আগেই…
দরজাটা ধাক্কা খেয়ে বন্ধ হয়ে গেল।
অধ্যায় ৫: গর্ভবতী ছায়ার কান্না
ঘরটা ছিল এক অদ্ভুত নিঃস্তব্ধতায় ভরা। না, ঠিক নিঃস্তব্ধ নয়—বাতাসের গভীরে যেন ঢেউ খেলানো
কান্না লুকিয়ে আছে। দরজা বন্ধ হয়ে যাওয়ার সাথে সাথে রুহানির মনে হলো, সে আর এখান থেকে
বেরোতে পারবে না।
আলো নেই। শুধু তার টর্চের কাঁপতে থাকা কণ্ঠে ছায়া পড়ে থাকে দেয়ালের গায়ে।
ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে একটা কাঠের দোলনা। জংধরা, পুরনো, আর তার নিচে লাল হয়ে শুকিয়ে যাওয়া
ছোপছোপ দাগ। শিশুর রক্তের মতোই লাগে।
রুহানি এগিয়ে গেল, টর্চের আলো ফেলল দোলনার ভেতরে।
একটা ছোট কম্বলে মোড়া ছিল ভেতরে কিছু… সে হাত বাড়িয়ে খামচে ধরতেই—
একটা শূন্যতা।
কিন্তু তখনই পেছন থেকে এক গর্ভবতী নারীর হালকা কণ্ঠ কেঁপে উঠল।
“আমার সন্তান… সে কই? সে কাঁদছিল… তুমি শুনতে পাওনি?
রুহানির পুরো শরীর ঠান্ডা হয়ে যায়। ধীরে ধীরে পেছনে ঘোরে সে।
ঘরের এক কোণায় দাঁড়িয়ে একজন—একজন নারী। ঢেউ খেলানো চুল, সাদা সালোয়ার-কামিজে ঢাকা,
কিন্তু তার কাপড়ের নিচে স্পষ্ট গর্ভের ফোলা আকৃতি। চেহারা আবছা, চোখ দুটি যেন
কুয়াশার মত ফ্যাকাসে, তবু তার মধ্যেও দগদগে যন্ত্রণা ।
নারীটি হেঁটে আসে ধীরে ধীরে। হালকা শব্দ—চাপা কান্নার মত পায়ের আওয়াজ।
“সে বলেছিল এটা তার সন্তান নয়… সে বলেছিল আমি অভিশপ্ত… কিন্তু সে তো আমারই
রক্ত!”
হঠাৎ নারীটির চোখ গলে গলে পড়তে শুরু করল কালো রক্ত।
রুহানি একপা পিছিয়ে গেল।
কিন্তু নারীটির গলা ক্রমে ফেটে যেতে লাগল, ঠিক যেন তারই গর্ভ ফেটে যাচ্ছে ভেতর থেকে “আমি
মরিনি, রুহানি। আমাকে জ্যান্ত কবর দিয়েছিল। আমার সন্তানটাও… সে-ও…” এক দমকা হাওয়া এসে
টর্চের আলো নিভিয়ে দিল। ঘর এক মুহূর্তে কুয়াশায় ঢেকে গেল। তখনই শিশুর কান্না—একটানা, হৃদয়
ছিঁড়ে দেওয়া কান্না ভেসে এল ঠিক রুহানির পাশ থেকে সে আবার টর্চ জ্বালাতে চেষ্টা করল, কিন্তু
এবার টর্চ কাজ করছে না। তার মোবাইল বের করে ফ্ল্যাশ অন করতেই দেখতে পেল—
দোলনার পাশে দাঁড়িয়ে সেই নারী, কোলে কিছু একটা ধরে রেখেছে।
রক্তমাখা এক খাঁচা হাত, যেটা আসলে শিশুর পচে যাওয়া শরীরের অংশ!
রুহানি চিৎকার করে উঠে দাঁড়াল।
দেয়ালের দিকে দৌড়ে গেল—কিন্তু ঘরটা যেন ঘুরে যাচ্ছে, প্রতিটি দেয়ালে ছায়া নাচছে—এক মা, এক
সন্তান, আর এক অভিশপ্ত পুরুষের বিভৎস মিলন যেন।
নারীটি আবার বলল—
“তুমি তো বুঝবে রুহানি… তুমি তো মেয়ে। তুমি জানো মাতৃত্ব কাকে বলে। তুমি জানো আমার বেদনা। তাই
আমি তোমার শরীর চাই।”
রুহানির শরীর হঠাৎ ভারী হয়ে এলো। চোখের সামনে ঝাপসা হয়ে গেল সবকিছু।
তার গর্ভের উপরে হাত রাখল সে–কিন্তু, কীভাবে সম্ভব?
সে তো গর্ভবতী না! তবু, যেন কিছু একটা তার ভিতরে নড়ে উঠল।
বুকের ভেতরে ঢেউ খেলে উঠল এক শব্দ
“মা…”
অধ্যায় ৬: কাল সিঁড়ির নিচে যে অপেক্ষা করে
ঘরের দরজাটা কিছুতেই খুলছে না। রুহানি বারবার ধাক্কা দিচ্ছে, ঘামাচ্ছে, হাঁপাচ্ছে, অথচ বাইরে যেন
সম্পূর্ণ নিঃশব্দ। হঠাৎ একটা শব্দ—
আর তারপর… এক নিঃসঙ্গ গলা:
“ওই সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামিস না রুহানি। কেউ ফিরেনি।”
এই কণ্ঠস্বর তার মা’র মতো। কিন্তু মা তো মারা গেছেন তিন বছর আগে। কাঁপা হাতে রুহানি
মোবাইলের ফ্ল্যাশটা আবার চালু করল।
আলো পড়তেই সে দেখতে পেল–ঘরের এক দেয়ালের সঙ্গে জোড়া লেগে আছে একটি কাঠের সিঁড়ি, যা
নেমে গেছে মাটির নিচে, যেন কুয়োর মতো অন্ধকারে গিলে ফেলার জন্য অপেক্ষা করছে। সিঁড়িটার কাঠ
কালচে-লাল, ঠিক যেন কারও রক্তে ভেজা।
রুহানি জানে না কী টান তাকে নিচে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সে থামতেও পারছে না।
প্রথম ধাপে পা রাখতেই সে অনুভব করল নিচ থেকে বাতাস আসছে—কিন্তু সেটা ঠাণ্ডা নয়, বরং
উষ্ণ, যেন কারও নিঃশ্বাস।
ধাপে ধাপে নামতে থাকল সে।
সিঁড়ির দেয়ালে পেরেক গাঁথা পুরনো ফটো—যেমনটা লোকে আত্মহত্যার আগে রেখে যায়। একটিতে
একজন নারীর গলা কাটা ছবি। আরেকটিতে একটি শিশুর মুখ নেই, শুধু ফাঁকা গহ্বর । হঠাৎ কোথাও
থেকে জ্বলল এক টিমটিমে হারিকেন আলো। অদ্ভুতভাবে সে টিকছে বাতাসহীন এই নিচতলায়।
সেই আলোয় দেখতে পেল—একজন মানুষ দাঁড়িয়ে। না, মানুষ না… ছায়া।
ছায়াটার মুখ স্পষ্ট নয়। তবে তার হাতগুলো ঘোরানো, আঙুলগুলো উল্টো দিক থেকে গাঁথা, আর পা
দুটো—পেছন দিকে বাঁকা, ঠিক যেভাবে মৃতের শরীর শক্ত হয়ে যায়।
সে সিঁড়ির নিচে দাঁড়িয়ে, তাকিয়ে আছে রুহানির দিকে।
“তুই এত নিচে নেমে এসেছিস কেন, রুহানি?
“আমি তো এখনও ওপরে অপেক্ষা করছিলাম। কিন্তু তুই এলে… আর যেতেও পারবি না।”
রুহানি পেছন ফিরে দেখল, সিঁড়ি আর নেই। শুধু দেয়াল। চারপাশ অন্ধকার।
ছায়াটা এবার হাঁটছে। না, হেঁটে আসছে না—মেঝের ওপরে ঘষটে ঘষটে এগিয়ে আসছে। গা ছমছমে
ঘরজোড়া শব্দ: “ঘরrrrrrrrr…”
সে মুখ খুলল। কোনো জিহ্বা নেই। শুধু এক গহ্বর, যেখান থেকে বেরিয়ে এল কান্নার মতো শব্দ
“আমি জানতাম, তুই আসবি। তুই আমার নতুন ঘর হবি। আমি তোর শরীরে থাকব। আমার নামে লোকজন
চিৎকার করবে—কিন্তু কেউ তোকে চিনবে না…”
তার ছায়া বাড়ছে। একসময় পুরো ঘর ঢেকে গেল।
রুহানি ফুঁপিয়ে উঠল। পেছনে ফেরার পথ নেই। সামনে এক ছায়ার ভয়ানক উপস্থিতি। একমাত্ৰ
পথ—সামনের অন্ধকার, অথবা নিজের মনের ভিতরে গুমরে মরার আর্তনাদ।
তার মাথার ভেতর গুনগুন করে উঠল এক কণ্ঠ:
“যে নিজের অতীত জানে না, সে নিজের ভবিষ্যৎ বাঁচাতে পারে না।
হঠাৎ সে কিছু স্পর্শ করল—একটা পুরনো কাঠের বাক্স। খুলে দেখে, ভেতরে একটা ছোট আয়না৷
কিন্তু আয়নাতে তার মুখ নেই ।
শুধু সেই ছায়ার গলায় দড়ি বাঁধা প্রতিবিম্ব।
এবার ছায়াটা কথা বলল তার গলায়, রুহানির গলায়:
“রুহানি নাই, এখন শুধু আমি আছি। এই ঘর আমার।”
অধ্যায় ৭: মৃতের নামের তালা
দেয়ালের চারপাশটা নরম কাদায় ভরা, যেন সিঁড়ি থেকে পড়ে এসে রুহানি ঢুকে পড়েছে এক গুহার মধ্যে।
নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু এর মাঝেই তার চোখে পড়ে—একটা লোহার দরজা। মাঝখানে একটা
অদ্ভুত নকশা। সর্পিল লেখা, জংধরা তালা, আর তার নিচে লেখা :
“এই ঘরের তালা শুধু সেই খোলে, যে জানে মৃতদের নাম। ভুল বললেই সে নিজেও মৃত হয়ে যাবে।”
রুহানির মুখ শুকিয়ে গেল। এই প্রথমবার সে বুঝল—এটা কেবল প্রেতাত্মার গল্প নয়, এটা এক
অভিশপ্ত খেলা। এখানে বাঁচতে হলে জানতে হবে… কারা মরেছে। কবে, কেন
সে দরজার পাশে তাকাল। দেয়ালে খোদাই করা অদ্ভুত প্রতীক। একটাতে হাত কাটা। আরেকটায় নারীর
মুখ। আর তৃতীয়টিতে একটা শিশু—যার চোখ নেই।
হঠাৎ তার মনে পড়ল সেই গর্ভবতী আত্মার কথা। যার নাম ছিল….
“আফরোজা ।”
রুহানি শব্দটা ফিসফিস করে বলতেই তালার একটা অংশ “টিক” করে খুলে গেল।
সে আবার খুঁজতে শুরু করল স্মৃতির গহ্বর থেকে। দ্বিতীয় আত্মা—ছায়া যেটা তার গলায় দড়ি দিতে
চেয়েছিল, যে হাসছিল অন্ধকারে… তার নাম ছিল—
“শারিফা।”
দরজার দ্বিতীয় তালা খুলে গেল।
এবার বাকি আছে শেষ নাম। কিন্তু এইবার সে বোঝে না কোন নামটা সঠিক। হঠাৎ তার চোখ পড়ে
দেয়ালের নিচে খোদাই করা শব্দে:
“যে নবজাতক দাফনের আগেই কেঁদেছিল, তার নাম কেউ রাখেনি। তবে তার মায়ের শেষ ডাকই তার নাম।”
রুহানি কেঁপে ওঠে। মনে পড়ে সেই করুণ কণ্ঠ:
“তামিম… আমার তামিম…”
সে নিঃশব্দে বলে ওঠে, “তামিম।”
চরম নীরবতা। তারপরে দরজার তালা খুলে যায়।
এক মুহূর্তে ঘরটা দুলে ওঠে, যেন পৃথিবী তার নিচে ফেটে যাচ্ছে।
দরজা খুলে গেলে ভেতরে দেখা যায় একটা অদ্ভুত ঘর। মেঝেতে আঁকা বৃত্তের মাঝে শুয়ে আছে তিনটি
ছায়া। তিনজনই মৃত, কিন্তু মুখে অদ্ভুত শান্তি। তাদের চারপাশে ঘুরছে বাতাসে লেখা কিছু
নাম—ভাসছে, ঘুরছে, আর বিলীন হচ্ছে।
হঠাৎ তৃতীয় ছায়াটি চোখ মেলে রুহানির দিকে তাকায়।
“তুমি আমাদের নাম ভুলোনি, তাই আমরাও তোমায় ভুলবো না। কিন্তু এখনও এক জন বাকি…”
রুহানি দম বন্ধ করে ফেলে।
“সে যে নিজেকে মেরে ফেলেছিল, তার নাম কেউ জানে না। তার নাম লুকানো আছে তোমার ভেতরে। তুমি
সেই নাম উচ্চারণ না করা পর্যন্ত কেউই মুক্তি পাবে না।”
রুহানি পেছনে ঘোরে।
একটি আয়না। আয়নার ভেতর তার প্রতিচ্ছবি নেই—সেখানে দাঁড়িয়ে আছে এক কিশোরী, সাদা ওড়নায়
মুখ ঢাকা
“তুইই তো বলেছিলি, আমি নিজের দোষে মরেছি। বল এখন, বল আমার নাম। বল…. আমি কে?”
রুহানির গলা শুকিয়ে আসে। হাত কাঁপে। মনে পড়ে, ছোটবেলায় এক বান্ধবী ছিল তার—নাজিফা। যাকে
তারা স্কুলে চড়-থাপ্পড় দিত, কেবল ‘অন্যরকম’ ছিল বলে। একদিন হঠাৎ সে গলায় ওড়না দিয়ে ঝুলে
পড়েছিল।
রুহানি চিৎকার করে বলে ওঠে:
“নাজিফা!”
ঘর কেঁপে ওঠে। বৃত্তটা আগুনে ঘিরে যায়, তারপর নিভে যায় এক ফুঁয়ে ।
সব ছায়া মিলিয়ে যায় আলোতে।
তালাবদ্ধ দরজাগুলো খুলে যায় এক এক করে। বাতাস স্বাভাবিক হয়। কুয়াশা সরে যায়।
রুহানি হাঁপাতে হাঁপাতে উপরের দিকে তাকায়। সিঁড়িটা ফিরে এসেছে।
অধ্যায় ৮: হাড়ের পাথর, জীবন্ত মাটির নিচে
সিঁড়ি ধরে উপরে ওঠার পর রুহানি কিছুক্ষণ নিশ্চুপ বসে থাকে। সে ভাবছিল সব শেষ। কিন্তু না ৷ ঘরের
কোণে এবার সে খেয়াল করে একটি পুরনো চৌকো কাঠের বাক্স। তার উপর হালকা খোদাই : “যারা
মাটির নিচে দাফন হয়নি, তাদের কান্না বাতাসে ভেসে থাকে…”
বাক্সটা খোলার সঙ্গে সঙ্গেই সারা ঘর ঠান্ডা হয়ে এল। তার ভেতরে একফালি কাগজ আর ছোট্ট
একটা পাথর।
পাথরটা হাড়ের মতো ফ্যাকাশে, আর খুব ঠান্ডা—মনে হয় যেন কোনো মৃতদেহের শরীর থেকে কাটা
এসেছে।
কাগজে লেখা:
“পাহাড়ের পেছনে পাথরের কূপ৷
সেখানে ‘তাকে’ জীবন্ত পুঁতে রাখা হয়েছে।
যদি মুক্তি চাও—গেলেই দেখতে পাবে। যদি সাহস থাকে…”
রুহানি জানে, এড়ানো যাবে না। এই ঘরের ইতিহাস শুধু ভৌতিক নয়, এটা এক নৃশংস সত্য। এবং এর শেষ
পাতাটা এখনও লেখা হয়নি।
পাহাড়ের কূপ
ভোররাতে রুহানি বের হয় বাড়ি থেকে। মেঘলা আকাশ। শীতল বাতাস।
পুরনো মানচিত্রে দেখা যায়, গ্রামের পেছনে পাহাড় ঘেঁষে একটা পরিত্যক্ত কূপ আছে, যেটা ৩০ বছর
আগে বন্ধ করে দেওয়া হয়—বলা হয়েছিল, ভেতরে কেউ পড়ে গিয়েছিল।
কিন্তু সে পড়ে যায়নি ৷
তাকে ফেলা হয়েছিল। জীবন্ত।
কূপের মুখ আজও পাথর দিয়ে ঢেকে আছে। বড় একটা গোলাকার পাথর, যার উপর আঁকা অদ্ভুত প্রতীক
—যেন কারও চিৎকার মুখে আটকে গেছে।
রুহানি সে হাড়-ঠান্ডা পাথরটা বুকে চেপে ধরে। কূপের মুখে রাখতেই পাথরটা গলে গেল, আর ঢাকনাটা
নিজে থেকেই সরে গেল।
হঠাৎ বেরিয়ে এল এক কান্নার গলা, যা মাটির গলা দিয়ে আসছে, যেন বহু বছর ধরে কেউ নিচে থেকে
শুধু একটা শব্দ বলে চলেছে:
“বের করে দে… আমার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে…
রুহানি কূপের ভেতরে আলো ফেলল। কিছু দেখা যায় না। শুধু এক নিঃসীম অন্ধকার। আর একটা
শব্দ:
টুক… টুক… টুক…
কারা যেন দেয়ালে নখ ঘষছে। হঠাৎ পুরো কূপ কেঁপে উঠল।
সেই সঙ্গে উঠে এল এক হাঁটু-ভাঙা, শরীর-মচকে যাওয়ানারী… যার দেহটা আজও পচেনি। গায়ে সেই
দিনেরই জামা, চোখে কেবল একটাই আকুতি:
“তুই কি আমায় দেখতে এলি? না কি আমায় আবার ফেলে দেবে?”
রুহানির গলা শুকিয়ে আসে। সে বুঝতে পারে, এই আত্মা এত বছর ধরে ‘জীবন’ থেকে না, বরং ‘ভুলে
যাওয়া’ থেকে প্রতিশোধ নিচ্ছে।
নারীটি এবার আস্তে আস্তে ভেসে আসে তার দিকে। তার মুখে নেই কোনো হিংস্রতা, বরং ভয়ঙ্কর এক
অভিমান।
“তারা বলেছিল আমি পাপ করেছিলাম… অথচ আমি শুধু প্রেমে পড়েছিলাম। ওর পরিবার আমায় মেরে
ফেলল, পাথর দিয়ে মুখ চেপে ধরেছিল….”
হঠাৎ তার চোখে আগুনের মতো অশ্রু ঝরে পড়ে।
“আমায় কেউ খুঁজে আসেনি, কেউ আমার নাম নেয়নি… এখন তুই এসেছিস… তুই কি আমার নাম
জানিস?”
রুহানি ফিসফিস করে বলে:
“রেজওয়ানা…”
মুহূর্তেই সেই নারী থেমে যায়। বাতাস স্তব্ধ। পাথরের গায়ে ফাটল ধরে।
নারীটি পেছন ঘুরে ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায়।
আর সেই সঙ্গে পুরো কূপটা জ্বলে উঠে – কিন্তু আগুনে না, আলোয়।
রুহানি জানে, এই আলো কোনো দৈনন্দিন আলো না – এটা একজন বঞ্চিত আত্মার মুক্তির
আলো।
অধ্যায় ৯: পেছনের দরজা যেটা খুলতে নেই
রুহানি কূপ থেকে ফিরে আসে ভোরবেলায়। তার মনে হচ্ছিল সব শেষ। ঘরে ঢুকেই সে ডায়েরিটা খুলে
লেখে—
“আজ একজন বেঁচে গেল… মৃত্যু থেকে নয়, ভুলে যাওয়া থেকে।
কিন্তু ঘরটা অদ্ভুত ঠান্ডা। দরজার ফাঁক দিয়ে ঠান্ডা বাতাস আসছে। সে জানে, সব দরজা সে বন্ধ
করে রেখেছিল।
তবুও… একটায় ঝুলছে না আর কোনো তালা |
ঘরের পেছনের ছোট কাঠের দরজা। যেটা রুহানি আগে কখনো খোলেনি। এমনকি স্পর্শও করেনি। বৃদ্ধ
হারুন মিয়া একবার সতর্ক করে বলেছিল—
“ওই দরজা না খোলাই ভালো। খোলার মানেই হচ্ছে নিজের স্মৃতিগুলোকে জাগিয়ে তোলা।”
রুহানি কিন্তু খোলেনি। তবু আজ সেটা খোলা ।
দরজার ভেতর থেকে একটা ঘ্রাণ আসছে—বিস্বাদ, পচা কিছু… আর কিছুটা নিজের শরীরের মতো। সে
কাঁপা হাতে ধীরে ধীরে দরজার দিকে এগোয়।
দরজার ওপারে
দরজা পেরিয়ে সে দেখে—এক সরু করিডোর। দেয়ালে নেই কোনো ছবি, শুধু লাল রঙের হাতের ছাপ। এবং
একটি আয়না, করিডোরের ঠিক শেষে।
রুহানি হাঁটতে হাঁটতে বুঝতে পারে-এটা তার নিজেরই তৈরি করা এক করিডোর। প্রতিটি পদক্ষেপে তার
মনে পড়ে যাচ্ছে একেকটা ঘটনা, যেগুলো সে ভুলে যেতে চেয়েছিল।
স্কুলের দিন, যেখানে সে নিরীহ নাজিফাকে অপদস্থ করেছিল।
সেই রাতে মা-বাবার চিৎকার, যেদিন সে নিজেই দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল।
একবার একটি কুকুর মরতে দেখেও পাশ কাটিয়ে চলে গিয়েছিল।
এই করিডোর কোনো ঘরের অংশ নয়। এটা তার নিজের মন। তার স্মৃতির ভেতর।
শেষে সে পৌঁছে যায় আয়নার সামনে।
আয়নায় তার প্রতিবিম্ব নেই। বরং সেখানে দাঁড়িয়ে আছে… এক কিশোরী। মুখে পচা-ফাটা দাগ, চোখ
দুইটা গলে পড়েছে। মুখে কিন্তু একটি দুঃখী হাসি।
“আমি তোর অপরাধ। আমি তোর স্মৃতি। আমি সেই রুহানি-যাকে তুই মেরে ফেলেছিস।”
রুহানি কেঁপে ওঠে। তার কণ্ঠে আওয়াজ আসে না। আয়নার রুহানি আবার বলে-
“তুই এত মৃত আত্মার মুক্তি দিলি, কিন্তু আমি তো এখনো আটকা… তোর ভেতরেই। আমায় চিন, মাফ
কর, মুক্তি দে-না হলে তুই নিজেই অর্ধেক বেঁচে থাকবে।”
আয়নার কাচ চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায়।
হঠাৎ চারপাশে অন্ধকার নেমে আসে। করিডোরের দেয়ালগুলো কাঁপছে, যেন স্মৃতি আর বাস্তব
মিলেমিশে এক ভয়ানক বাস্তবতা গড়ে তুলছে।
রুহানি মাথা নিচু করে ফিসফিস করে বলে:
“আমি তোকে ভুলে যাইনি… শুধু ভয় পেয়েছিলাম। আজ মেনে নিচ্ছি-তুই আমার এক অংশ, তোর ভুল
আমারই ভুল।”
এক মুহূর্তে আলো ফিরে আসে। আয়না আবার সেজে ওঠে। এবার সে দেখে নিজেকে-একটা শান্ত, চোখে
কাঁটার মতো অশ্রুভরা মেয়ে, যার চোখে ভয় নেই, বরং বোঝাপড়ার ছাপ।
অধ্যায় ১০: যারা কখনো ঘর ছাড়েনি
রুহানি ঘরে ফিরে এসে থমকে যায়।সব দরজা বন্ধ। বাতাস নিস্তব্ধ। ঘড়ির কাঁটা থেমে গেছে। এমনকি
পাখিরা ডাকাও বন্ধ।
ঘরটা যেন নিঃশ্বাস নিচ্ছে না-অথচ জীবিত।
দেয়ালের এক কোণ থেকে আসছে এক চেনা শব্দ।
টুক… টুক…
কেউ যেন ছাদের কোনায় লাথি মারছে… আবার থেমে যাচ্ছে। আবার বাজছে। যেন কেউ জানাচ্ছে-“আমি
আছি”।
রুহানি জ্বালায় একটি মোমবাতি। আলো ফেলতেই সে দেখে দেয়ালের উপর ছায়া-কোনো মানুষের নয়,
বরং ঘরের গড়নের মতো। একটা জানালা, দরজা, সিঁড়ি… এবং মুখ!
ছায়াটি ফিসফিস করে:
“তুই অনেককেই মুক্তি দিয়েছিস। কিন্তু আমরা কিছুজন… এখানেই থাকি। কারণ আমরাই এই ঘর। তুই
যেতে পারবি, কিন্তু আমাদের নিতে হবে।”
রুহানি পেছনে ঘুরে দাঁড়াতেই ঘরটা বদলাতে শুরু করে।
ঘরের মেঝে ফেটে যাচ্ছে। দেয়াল থেকে ঝরছে ধুলো, পুরনো ছবি একে একে পড়ছে নিচে। মেঝের নিচ
থেকে ভেসে আসে শিশুর কান্না, নারীর আর্তনাদ, কারো ফিসফাস-
“এই ঘর আমার ছিল…”
“আমি এখানেই মরেছি…”
“তুই এলে, আমরাও জেগে উঠলাম…”
ঘরের অন্তরাত্মা
রুহানি বুঝতে পারে, শুধু আত্মারা নয়-এই বাড়ির কাঠ, ইট, ছাদ… সবকিছুতেই ছড়িয়ে আছে মানুষের
যন্ত্রণা, বিশ্বাসঘাতকতা, ভালোবাসা আর ভয়।
যারা মরেও থেকে গেছে-তারা এই ঘরের অংশ হয়ে গেছে। এখন তারা আর মুক্তি চায় না।
তারা চায়… একজন নতুন অভিভাবক। একজন ‘জ্যান্ত’ রুহানি।
আবার ফিসফিস:
“তুই চলে গেলে আমরা ঘুমিয়ে পড়ব… আবার একদিন জেগে উঠব। তুই থাকলে, আমরা জেগে থাকব-
তোর স্বপ্নে, তোর কানে, তোর আত্মায়।”
রুহানি মোমবাতি হাতে তুলে নেয়। একটা মুহূর্তে মনে হয়, থেকে যাওয়া উচিত। কারণ এ ঘর শুধু ভয়ের
না-এটা তার নিজের তৈরি ইতিহাস, তার আবিষ্কৃত গলিত সত্য, তার প্রশ্নের উত্তর।
কিন্তু সে হেঁটে বেরিয়ে আসে।
দরজায় দাঁড়িয়ে, পেছন ফিরে তাকায়-ঘরটা নিঃশব্দ, শান্ত, আর… চোখ মেলে তাকিয়ে আছে।
শেষ ডায়েরির পাতা
বাড়ি ফিরে রুহানি ডায়েরির শেষ পাতায় লেখে:
“ঘরের সব আত্মা মুক্তি পায় না। কেউ কেউ ঘর হয়ে ওঠে। কেউ কেউ গল্প। আমি এখন জানি, এই ঘর
আমাকে চিরকাল ডাকবে।
তবু আজ আমি ফিরলাম। কারণ জীবনের গল্প এখনও লেখা বাকি।”
ঠিক তখন, জানালার কাঁচে পড়ে একটা ছায়া।
একজন দাঁড়িয়ে।
মুখ দেখা যায় না, কিন্তু কণ্ঠ ভেসে আসে:
“রুহানি? আপনি কি ভৌতিক ইতিহাস নিয়ে কাজ করেন?”
শেষ নয়, নতুন শুরু
এখানেই শেষ রুহানির ঘর।
কিন্তু ঘরের দরজা এখন খোলা।
হয়তো আগামীবার, ডাক আসবে তোমার জন্য।
“রুহানির ঘর” – এক তরুণীর ভৌতিক ইতিহাস খুঁজতে গিয়ে নিজের অতীত, অপরাধবোধ এবং বিস্মৃত
আতঙ্কের মুখোমুখি হওয়ার কাহিনি।
রুহানি ভেবেছিল ভূতেরা কেবল বাইরের কেউ। কিন্তু সিংহবাড়ির পরিত্যক্ত ঘরে সে যাদের খুঁজে পেল,
তারা ছিল নিজেরই একেকটা টুকরো।
ঘরের দেয়ালে লেখা ছিল সেই নাম, যাদের আর কেউ মনে রাখেনি। আয়নার ভেতর ছিল এমন এক মুখ,
যাকে মুছে ফেলেছিল সে নিজেই। আর প্রতিটি দরজার ওপারে অপেক্ষা করছিল এমন এক সত্য-যা
জানলে কেউ আগের মতো
থাকে না।
এটি শুধু একটি ভূতের গল্প নয়। এটি স্মৃতির, ক্ষমার, এবং সেই ঘরের গল্প…
যে ঘর কখনো কাউকে পুরোপুরি ছেড়ে দেয় না।

খুব ভালো লাগলো
Such a lovely story
রুহানির ঘর
Very nice story…
Something new seen…
Waiting for some more Stories like this…
Keep it up.
Regards & best wishes…