Saturday, July 27, 2024
spot_imgspot_imgspot_img
Homeসম্পাদকীয়বিসিএস শেষ কথা নয়

বিসিএস শেষ কথা নয়

-ফিরোজ জামান চৌধুরী

দীর্ঘদিন তরুণদের সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, বাংলাদেশের বর্তমান প্রজন্মের তরুণেরা খুবই মেধাবী। কিন্তু দুঃখজনক বাস্তবতা হচ্ছে, তাদের কাজের সুযোগ সীমিত। ইদানীং যেকোনো আড্ডায় কান পাতলে শোনা যায়, চাকরিপ্রার্থী তরুণদের ব্রত হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রথমত বিসিএস, দ্বিতীয়ত বিসিএস, শেষ পর্যন্ত বিসিএস। যারা বিসিএসকেই ধ্যানজ্ঞান করে বসে আছ, তাদের নিচের পরিসংখ্যানের দিকে একবার চোখ বোলাতে অনুরোধ করব।

৪০তম বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (বিসিএস) পরীক্ষার জন্য আবেদন জমা পড়েছে ৪ লাখ ১২ হাজারের বেশি; এ সংখ্যা মালদ্বীপ রাষ্ট্রের মোট জনসংখ্যার সমান। যারা বিসিএস পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছ, তাদের জন্য একই সঙ্গে শুভকামনা ও সমবেদনা রইল। শুভকামনা বোঝা গেল, কিন্তু সমবেদনা কেন? কারণ, বিসিএসে মোট পদ রয়েছে ২ হাজারের কাছাকাছি। অর্থাৎ বিসিএস স্বপ্নের দৌড় থেকে এবার বাদ পড়বে ৪ লাখের বেশি তরুণ। যদি যুক্তির খাতিরে ধরে নিই যে মেধাবী এই ৪ লাখ তরুণকেই আমরা বিসিএস ক্যাডার হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করব, তাহলে আমাদের অপেক্ষা করতে হবে আরও ২০০টি বিসিএস পরীক্ষা এবং ১০০ বছরের বেশি সময়! অসম্ভব, অলীক, অবাস্তব এই পরিস্থিতিকে মাথায় রেখে আমাদের তরুণদের সামনে এগোতে বলব। বলব, ‘বি প্র্যাকটিক্যাল’।

কেন সবাই বিসিএসের দৌড়ে ছুটছে? কারণ খুবই স্পষ্ট—নিশ্চিত আয়, সম্মান ও ক্ষমতা। এ বাস্তবতা মাথায় রেখেও বলতে দ্বিধা নেই যে বিসিএস ভালো চাকরিগুলোর অন্যতম, কিন্তু একমাত্র ভালো চাকরি নয়। আমাদের চারপাশে চোখ মেললে দেখতে পাব, সমাজে বেশির ভাগ সফল মানুষ বিসিএসবৃত্তের বাইরে থেকে উঠে এসেছেন। আবার বিসিএস উত্তীর্ণ হয়েও চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন অনেকে। যেমন লেখক আনিসুল হকের কথাই ধরা যাক। তিনি বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগ থেকে পাস করে বিসিএস ক্যাডার হয়েছিলেন, চাকরিতে যোগও দিয়েছিলেন, কিন্তু এক বছর পার হওয়ামাত্র চাকরি ছেড়ে ফিরে আসেন সাংবাদিকতা আর লেখালেখির প্রিয় জগতে। বিসিএসে চাকরি করে জীবন পার করলে আনিসুল হকের মতো এমন সফল মানুষ কি বাংলাদেশ পেত?

এক দফা নয়

যারা বিসিএসের প্রস্তুতি নিচ্ছ, তাদের বলব, বিসিএসের প্রস্তুতি চলুক, কিন্তু চাকরির অন্য দরজা-জানালাগুলোও খোলা থাক। জীবনের কোনো কাজেই ‘এক দফা’ ভালো কিছু নয়। এক দফা অনেক সময় তোমাকে হতাশার গভীর খাদে ফেলে দিতে পারে। সব সময় অপশন খোলা রাখা হবে বুদ্ধিমানের কাজ। অপশন বা বিকল্প না থাকলে মানুষ ক্ষমতাহীন হয়ে পড়ে। বিসিএসের এক দফায় বুঁদ হয়ে থাকলে শেষ পর্যন্ত পস্তাতে হতে পারে। তিন–চার বছরব্যাপী আদাজল খেয়ে ভালো প্রস্তুতির পরও ১ নম্বর বা ০.৫ নম্বরের জন্যও ফসকে যেতে পারে স্বপ্নের বিসিএস। বিসিএসে উত্তীর্ণ হতে না পারলে কী করবে, তার প্রস্তুতিও চলুক একই সঙ্গে। প্রত্যেকের জীবনে একটা করে প্ল্যান বি থাকা দরকার। বিসিএসের বিকল্প কী হতে পারে, প্ল্যান বি কী হতে পারে, তার পরিকল্পনা এখনই শুরু করা জরুরি। যারা প্ল্যান বি নিয়ে এগোবে, ব্যক্তিজীবন আর পেশাজীবনে তাদের সফল হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি থাকবে।

হাজার দুয়ার খোলা

বিসিএস ছাড়াও উচ্চ বেতনের আরও হাজার রকম সরকারি চাকরি রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বিভিন্ন সরকারি ব্যাংক এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি। এ ছাড়া রয়েছে বিভিন্ন একাডেমি, অধিদপ্তর, ইনস্টিটিউট প্রভৃতি। বিসিএসের প্রস্তুতি এসব চাকরির পরীক্ষায় অনেকটাই কাজে লেগে যায়। সেনা-বিমান-নৌবাহিনীর চাকরির প্রতিও এ প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের আগ্রহ বাড়ছে। বিসিএসের সমান্তরালে এসব চাকরির ব্যাপারেও চাকরিপ্রার্থীদের চোখ-কান খোলা রাখা দরকার।

বেসরকারি চাকরি

বাংলাদেশে মোট কর্মসংস্থানের মাত্র ৩.৮ শতাংশ হলো সরকারি চাকরি। স্মার্ট তরুণদের জন্য বিভিন্ন করপোরেট প্রতিষ্ঠান হতে পারে প্রধান ঠিকানা। এখানে রয়েছে শুরুতেই উচ্চ বেতনে চাকরিতে প্রবেশের সুযোগ। কাজের দক্ষতার প্রমাণ দিতে পারলে দ্রুত উন্নতির সম্ভাবনা। বিভিন্ন বেসরকারি ব্যাংকের চাকরিও তরুণদের প্রিয় কর্মক্ষেত্র হয়ে উঠছে। উন্নয়ন সংস্থায় উচ্চ বেতনে কাজ করার সুযোগ রয়েছে। এ কথা আমরা সবাই জানি যে বেসরকারি চাকরিজীবীরা তুলনামূলক বেশি স্বাধীনতা ভোগ করেন। বেসরকারি চাকরিতে আমলাতন্ত্রের দেয়াল নেই বললেই চলে। সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও মত প্রদানের ক্ষেত্রে তাঁরা নিজেদের উদ্ভাবনী শক্তি কাজে লাগাতে পারেন। তাই যারা স্বাধীনচেতা, তারা সরকারি চাকরির চেয়ে বেসরকারি চাকরির দিকে নজর দিতে পারো।

এবং উদ্যোক্তা

আমরা সবাই যদি চাকরির পেছনে ছুটি, তাহলে চাকরি দেবে কে? বাংলাদেশে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে যে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছে, এর মূল কৃতিত্ব উদ্যোক্তাদের। তাহলে যারা নিজেকে সমাজের সম্মানজনক জায়গায় দেখতে চাও, তারা নিজেই হও নিজের চাকরিদাতা। মুখস্থ কিছু নামই বলি, মার্ক জাকারবার্গ, স্টিভ জবস, বিল গেটস—কেউই চাকরি করেননি, সরকারি চাকরি তো দূর অস্ত। প্রত্যেকেই নিজেকে সারা বিশ্বে সম্মানিত, জনপ্রিয় ও ক্ষমতাধর ব্যক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তো এবার তোমার পালা। তুমিই ঠিক করো, চাকরি করবে, নাকি চাকরি দেবে?

শেষ পর্যন্ত দক্ষতা

২০১৮ সালের ১৮ মে প্রকাশিত বিবিসির একটি প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, বিদেশি কর্মীদের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর কয়েক শ কোটি ডলার অর্থ চলে যাচ্ছে দেশের বাইরে। এসব দেশের মধ্যে রয়েছে ভারত, শ্রীলঙ্কা, ফিলিপাইন, কোরিয়া, চীন প্রভৃতি। শুধু বেতন-ভাতা বাবদ ভারতেই চলে যাচ্ছে প্রায় ৫০০ কোটি ডলার। ব্যবসায়ী নেতাদের উদ্ধৃতি দিয়ে ওই প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, দক্ষ জনশক্তির অভাবেই বাংলাদেশ কোটি কোটি ডলার হারাচ্ছে। দেশে মাঝামাঝি পর্যায় ও উচ্চ পর্যায়ের পেশাজীবীদের বড় ধরনের ঘাটতি রয়েছে, ফলে বাধ্য হয়ে বিদেশ থেকে এসব কর্মী আমদানি করতে হচ্ছে।

তাই সবশেষে তরুণদের উদ্দেশে বলব, বিসিএস কিংবা নন-বিসিএস, সরকারি আর বেসরকারি চাকরি—সব ক্ষেত্রেই মূল্যায়ন হয় দক্ষতা ও যোগ্যতার। সাফল্যে শর্টকাট বলে কিছু নেই। নিজের দক্ষতা বাড়াতে আর ঘাটতি দূর করার এখনই সময়। নিজ বিষয়ের দক্ষতার পাশাপাশি ইংরেজি ভাষার দক্ষতা ও প্রযুক্তির দক্ষতা পেশাজীবনে তোমাকে সব সময় এগিয়ে রাখবে। তো, চলো শুরু করে দিই, আত্মবিশ্লেষণ এবং নিজের দক্ষতা উন্নয়ন কার্যক্রম। সাফল্য তোমার দুয়ারে কড়া নাড়ছে, এবার তোমার প্রস্তুত হওয়ার পালা।

লেখক: শিক্ষক, সাংবাদিকতা বিভাগ, স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ।

Facebook Comments Box
প্রতিধ্বনি
প্রতিধ্বনিhttps://protiddhonii.com
প্রতিধ্বনি একটি অনলাইন ম্যাগাজিন। শিল্প,সাহিত্য,রাজনীতি,অর্থনীতি,ইতিহাস ঐতিহ্য সহ নানা বিষয়ে বিভিন্ন প্রজন্ম কী ভাবছে তা এখানে প্রকাশ করা হয়। নবীন প্রবীণ লেখকদের কাছে প্রতিধ্বনি একটি দারুণ প্ল্যাটফর্ম রুপে আবির্ভূত হয়েছে। সব বয়সী লেখক ও পাঠকদের জন্য নানা ভাবে প্রতিধ্বনি প্রতিনিয়ত কাজ করে চলেছে। অনেক প্রতিভাবান লেখক আড়ালেই থেকে যায় তাদের লেখা প্রকাশের প্ল্যাটফর্মের অভাবে। আমরা সেই সব প্রতিভাবান লেখকদের লেখা সবার সামনে তুলে ধরতে চাই। আমরা চাই ন্যায়সঙ্গত প্রতিটি বিষয় দ্বিধাহীনচিত্ত্বে তুলে ধরতে। আপনিও যদি একজন সাহসী কলম সৈনিক হয়ে থাকেন তবে আপনাকে স্বাগতম। প্রতিধ্বনিতে যুক্ত হয়ে আওয়াজ তুলুন।
RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments