তারিকুল আমিন
ঐ গাজীপুর, মাওনা চৌরাস্তা, শ্রীপুর, আব্দুল্লাহপুর, টঙ্গী। এভাবে এক এক করে যাত্রী ডাকছে। যাত্রী উঠছে, নামছে। তারপর যাত্রীদের পাশ কেটে হকার উঠে বিক্রি করে।
Ñ ঐ বুট..! বুট, চানাচুর, আলুর চিপ..।
এভাবেই বুট বলে হাঁক দিচ্ছে হকার ভাইয়েরা। দিপাশ বসেছে বাসের প্রথম সিটে। দিপাশের এইচ. এস. সি পরীক্ষার ফলাফল দিবে আর দু-তিন দিন পর। দিপাশের দাদি আসবে। দিপাশের বাবা বললÑ আগামীকাল তোমার দাদুকে নিয়ে আসবে গাজীপুর থেকে। কীভাবে যাবে, কোন বাসে যাবে, সব বলে দেয় দিপাশের বাবা। এই প্রথম দিপাশ তার মা-বাবা, ভাই-বোনকে ছেড়ে একা বাসে উঠবে। তাও আবার ঘরের বড় ছেলে হিসেবে তার দাদিকে গাজীপুরের চৌরাস্তা থেকে নিয়ে আসতে হবে। তার দাদি নেত্রকোনা থেকে বাসে করে গাজীপুর নামবে। তাই দাদিকে আনার জন্য গাবতলী থেকে বসুমতি বাসে উঠে। এই দীর্ঘপথ যাওয়ার জন্য সাথে নিয়েছে ব্যাগ, পানি আর শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যাায়ের বই “রামের সুমতি”। গাবতলী থেকে বসুমতি বাসে উঠার সাথে সাথে ভাবছে বই পড়বে নাকি পড়বে না। লজ্জা পায় দিপাশ। সকল লজ্জা, আর কে কী বলবে এসব ঝেড়ে তারপর বই খুলে পড়ে। দিপাশ জানালার পাশে বসেছে। এই অল্প সময় দিপাশের পাশের সিট থেকে অনেক ভদ্রলোক উঠেছে। আবার যার যার গন্তব্যে নেমেছে। আবদুল্লাহপুর থেকে পাশে এসে হঠাৎ বসে এক ইয়া মোটা ভদ্র মহিলা। এক দিকে গরম। অন্যদিকে দিপাশ প্রায় তার চাপে চ্যাপ্টা হয়ে চিতল মাছ হওয়ার অবস্থা। দিপাশ চুপচাপ স্বভাবের ছেলে। ভয়ে আর লজ্জায় কিছুই বলতে পারে না। তার উপর মহিলাটা উঁকি দিয়ে দিয়ে বইটি পড়ছে। তার শরীরপুরো ভেঁজা। ঘামে তার শরীর থেকে গন্ধ বের হচ্ছে। তার উপর তো বাসের ঝাঁকানি ফ্রি। ভদ্র মহিলা প্রায় আমার সাথে পড়া শুরু করেছে।
ভদ্রমহিলা : তুমি কী হিন্দু?
এমন সময় তার প্রশ্ন শুনে দিপাশ কিছু সময়ের জন্য নিস্তব্ধ হয়ে রয়।
দিপাশ : কেন?
ভদ্রমহিলা : না মানে বইটি খুব সুন্দর। পড়ে মনে হচ্ছে অসাধারণ লেখা।
ভদ্রমহিলা আমার ‘কেন’ এর উত্তর এড়িয়ে গেলেন মনে হচ্ছে। তারপর তার ঐ কথা ভুলে আবার ডুবে গেলাম পড়ায়। রাম ডাক্তার বাবুকে বলল- “ছাই দিচ্ছ! পচা ময়দার গুঁড়োতে অসুখ ভালো হয়!” কথাটি পড়ার সাথে সাথে নিজের সাথে নিজেই হেসে উঠি। মহিলা আমার দিকে তাকালো। এর কিছুক্ষণ পর মহিলা পানি চায় হ্যালপারের নিকট।
হ্যালপার : আপা পানি তো শেষ। দাড়ান সামনে থেকে বাস থামিয়ে নিয়ে নিবো?
মহিলা : আরে ভাই আর বলো না যে গরম পড়েছে। এ নিয়ে তিনবার পানি কিনেছি। এই সরকারের আমলে এত গরম। আর কোন সরকারের আমলে এতো গরম কখনও হয়নি। পাপ বুঝলেন সব পাপ!
দিপাশ ভদ্রমহিলাকে বলল : এই গরমে হয়তো আমার পানি কিছুটা গরম হয়েছে। তবে আপনার পানির তৃষ্ণা মিটবে আশা করি। এই নেন পানি?
ভদ্রমহিলা : থাক রেখে দাও। খাবো না।
দিপাশ : আপা কেন খাবেন না? আমি হিন্দু বিধায়?
তখন মহিলা আমার কথা শুনে হতচকিত হয়ে পড়ে। থোথমোথ খেয়ে বলেন।
ভদ্রমহিলা : আরে না..না! মানে..! আপনার নাম কী?
আমি বললাম কেন আমার নাম শুনে তারপর খাবেন বুঝি?
দিপাশ : আমার নাম দিপাশ আনোয়ার।
ভদ্রমহিলা : না মানে আপনি হিন্দুদের বই পড়ছেন তো তাই। (তখন পানি নিয়ে খেতে খেতে বলল) না মানে আমি ভাবলাম আপনি..!
দিপাশ : আমি হিন্দু তাই তো। হিন্দুদের বই পড়ছি দেখে ভাবছেন পানি খেলে আপনার ইমান নষ্ট হবে তাই তো? ভেবেছেন হিন্দু দেখে তার পানি খাওয়া যাবে না তাই তো? আপনি তো শিক্ষিত তাই না? কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা ‘মানুষ’ পড়েছেন হয়তো। আবার একটু মনে করিয়ে দেই যেহেতু আমি একজন আবৃত্তি শিল্পী।
“গাহি সাম্যের গান-
মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান!
নাই দেশ-কাল-পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্ম জাতি,
সব দেশে, সব কালে, ঘরে ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি।”
আর যেহেতু ধর্ম নিয়ে কথা তুলেছেন তাই সময় হলে আরাকটা কবিতা বলি।
গাহি সাম্যের গান-
যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান
যেখানে মিশেছে হিন্দু- বৌদ্ধ-মুসলিম-ক্রীশ্চান।
গাহি সাম্যের গান!
পরে মহিলা পানি খেয়ে আমার হাতে বোতলটা দেয়। আমিও রেখে দিলাম। এরপর আমি কথা না বাড়িয়ে আবার পড়ায় মনোযোগ দিলাম। মহিলা নেমেছে তিনটি বাস স্টপের পর। আমি তাকে পানি দিয়েছি। তার বিনিময়ে আমাকে ধন্যবাদটুকু বলার প্রয়োজন মনে করেনি।
প্রায় চার ঘন্টা লেগেছে গাজীপুর চৌরাস্তা যেতে। এরই মধ্যে পড়ে শেষ হয় “রামের সুমতি” বইটি। দিপাশের দাদির সাথে চাচাতো ভাই এবং ফুফাতো ভাই-বোনও আসে। দিপাশ দাদিকে ফোন করে।
Ñ হ্যালো দাদি! কোথায় আপনি?
Ñ আমি মূর্তির এখানে দাড়িয়ে।
Ñ এখানে মূর্তি কই? কালী মুর্তি নাকি দুর্গার মুর্তি।
Ñ আরে না। এ যে বন্দুক নিয়ে দাড়িয়ে আছে।
Ñ ও..! দিপাশ একটু সামনের দিকে হেটে দেখে একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার ভাস্কর্য। পরে দিপাশকে দেখেই চাচাতো ভাই দে দৌড়। দৌড় দিয়ে জড়িয়ে ধরে দিপাশকে। পড়ে বসুমতি বাসে আবার উঠে। এখন আর পড়ার কিছু নেই। চাচাতো ভাই অনেক দুষ্ট। ওকে সামাল দিতে দিতেই দিন শেষ। ও এটা খাবে। ওটা খাবে। এক পর্যায় হকারের উপর এতো রাগ উঠলো। আসার সময় দু একটি হকার দেখলাম। আর এখন প্রায় আট-দশটা হকার উঠাও শেষ। ওর এতো এতো বায়না দিপাশ কিছু বলতেও পারে না। এরপর দিপাশ লম্বা একটি ঘুম দেয়। এরপর উঠে দেখে প্রায় এসে গেছে। এরপর নামলো গাবতলী। সেখান থেকে আবার অটোতে করে চলে আসলো ঢাকা উদ্যান।