back to top
Google search engine
Homeসাহিত্যগল্পহিংস্র ঢেউ

হিংস্র ঢেউ

আকাশ ইসলাম সাগর

কয়েক দিন ধরে মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। আর হবেই না কেন? এখনতো আষাঢ় মাস। আষাঢ়ে আকাশটা কেমন জানি ক্ষণে ক্ষণে রূপ বদলায়। চারিদিকে জলাশয়গুলো জলে টইটম্বুর।

দিনটি শনিবার। আজ আকাশ কিছুটা মেঘমুক্ত, চারিদিক রৌদ্রোজ্জ্বল। তবে বয়োজ্যেষ্ঠরা বলেন, শনিবার নাকি শনির দিন।

দুই দিনের ছুটি শেষ। রবিবার অফিসের কাজে যোগদান করতে হবে। এবারের যাত্রার সঙ্গি বন্ধু রাকিব। গ্রামে আসার পর বায়না ধরলো, এবার তোর সঙ্গে ঢাকা যাবো। রাকিব কখনো ঢাকা যায়নি। ছোটবেলার বন্ধু বলে কথা, আমিও রাজি হলাম। সকালে বের হওয়ার কথা থাকলেও, রাকিব সঙ্গী হওয়ায় যাত্রা বিলম্ব হলো।

সূর্য মাথার উপর মেঘের আড়াল থেকে উঁকি দিচ্ছে। তাই কালক্ষেপন না করে, বাবা-মায়ের আশীর্বাদ নিয়ে বাড়ি থেকে বের হলাম। বাস স্ট্যান্ড থেকে টিকিট কেটে সৃষ্টিকর্তার নাম স্মরণ করে বাসে বসে পড়লাম। স্বস্তির নিঃশ্বাস নিলাম এই ভেবে যে, সঙ্গ দেওয়ার জন্য বন্ধুতো আছে। দশ মিনিটের মধ্যে মুকসুদপুর থেকে বাস জাজিরা ঘাটের উদ্দেশ্যে ছেড়ে গেল। গাড়ির গতি ৫০ থেকে ৬০ কি:মি মধ্যেই উঠানামা করছিল। এর অন্যতম কারণ রাস্তা তেমন একটা ভালো না। হেলে দুলে গাড়ি তার আপন মনে চলছে। মুকসুদপুর পার হওয়ার পরেই আচমকা আঘাত সামনের সিটের সঙ্গে। পরক্ষণে শুনতে পেলাম গাড়ির চাকা পাংচার হয়ে গেছে। মনে পড়ে গেল বয়োজ্যেষ্ঠদের শনিবার নিয়ে বলা কথাটা। শুধু বারবার মনে হচ্ছিল, শনিবার আসলেই কী শনির দিন? পাশে বসে থাকা বন্ধু রাকিব ঘুমিয়ে গেছে।
গাড়ি মেরামত করতে বেশ সময়ও লাগবে। আমি বাসের জানালা দিয়ে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম।

যতদূর চোখ যায় অথৈ পানি। প্রকৃতির এই সৌন্দর্য দেখে মনে পড়ে গেল কবি আকাশ ইসলাম সাগরের কবিতা।

মনে মনে করিতার বানি পড়া শেষ হতে না হতেই আচমকা গাড়ি চলার ঝাঁকি অনুভব হলো। আবার মনের অজানা ভয় জাগ্রত হলো, আজ শনিবার!

এবার বাস্তবতায় পদার্পণ। মাঝে মাঝে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। এই আলো এই অন্ধকার। মেঘ যেন আকাশে জেঁকে বসার পাঁয়তারা করছে।

এভাবে প্রায় দুই ঘন্টা পরে গাড়ি জাজিরা প্রান্তে পৌঁছায়। আমি প্রথমে মনে মনে ভাবলাম ফেরিতে পার হবো। নড়াইল যাতায়াতে ফেরিতে উঠেছিল রাকিব, তাই বন্ধুর অনুরোধে লঞ্চে ওঠার সিদ্ধান্ত নিলাম। লঞ্চঘাট এসে আমি একেবারেই নির্বাক!

প্রকৃতির সৌন্দর্যের সঙ্গে নদীর সৌন্দর্য মিশে একাকার। ঘরে ফেরা পাখির গানের সঙ্গে নদীর পানির মৃদু নৃত্য। দেখতে বেশ ভালোই লাগছিল।

সূর্য পশ্চিমা আকাশে অস্তমিত প্রায়। গ্রাম্য ভাষায় আকাশে সিন্দুর ভেঙেছে। তাইতো সন্ধ্যার প্রকৃতি লালচে।

এভাবেই প্রকৃতির সৌন্দর্যে গোধুলি অতিক্রান্ত, সন্ধ্যায় পদার্পণ। সন্ধ্যার ফিকে আলোতে কালোমেঘ, অন্ধকারে নতুন মাত্রা যোগ করেছে।

আমার মতো কয়েকশো যাত্রীর ভিড় ঠেলে আল্লাহকে স্মরণ করে লঞ্চে উঠে পড়লাম। লঞ্চ জাজিরা প্রান্ত ছেড়ে যাচ্ছে, সঙ্গে লঞ্চ ঘাটের আলোও ক্ষীণ হচ্ছে।

দুজনই লঞ্চের নিচ তলায় জানালার পাশে বসে অন্যদের ব্যস্ততা দেখছি। হঠাৎ দমকা হাওয়া ও ঝিরিঝিরি বৃষ্টি ভিজিয়ে দিচ্ছিলো জানালার পাশে বসা সবাইকে।

পদ্মার বুক চিড়ে লঞ্চ তার আপন গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। আর কয়েক মিনিট অন্তর হুইসেল বাজাচ্ছে। হুইসেলের শব্দ এতোটাই বিদঘুটে যে, বারবার কেমন যেন অজানা ভয় আমাকে গ্রাস করছিল। জানালা দিয়ে বাহিরে তাকাতে ভয়টা দ্বিগুন হয়ে গেল।

বিদঘুটে অন্ধকারের মধ্যে বিদ্যুৎ চমকানো আলো নদীতে খানিক আলো দিয়ে উধাও হয়ে যাচ্ছে। আবার সঙ্গে গুড়ুম গুড়ুম শব্দ। শব্দের তীক্ষ্ণতা বেড়েই চলছে।

নদী উত্তাল। নদীর এই ভয়ানক রূপ এর আগে কখনো দেখিনি। শুনিনি তার গর্জন। আমার মনে হচ্ছিল এ এক রাক্ষসের ডেরা। নদীর সাথে সাথে প্রকৃতিও অশান্ত।

লিখুন প্রতিধ্বনিতেলিখুন প্রতিধ্বনিতে

শুরু হলো প্রচণ্ড বৃষ্টি ও দমকা হাওয়া। নদীর উত্তাল ঢেউ লঞ্চের এপাশে থেকে ওপাশে আছড়ে পড়ছিল। লঞ্চ ঢেউয়ের সাথে দুলছে। আজ পদ্মার ঢেউ হিংস্র প্রাণির মতো আচরণ করছে। ঢেউয়ের এই হিংস্রতা বেড়ে চলছে ক্ষণে ক্ষণে। লঞ্চ এতটাই দুলছিল যে, আমি ও রাকিব স্থির হয়ে বসে থাকতে পারলাম না।

এদিকে মানুষের করুণ আর্তনাদ আমাদের ভয়ের মাত্রা বাড়িয়ে দিচ্ছে। লঞ্চের উপরের তলায় উঠে কোনো রকম লোহার খাম্বা ধরে দাঁড়িয়ে আছি।

অন্য সবাই যার যার মতো প্রাণ বাঁচানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। হঠাৎ, কয়েক মিনিট আগে বসে থাকা এক মায়ের চিৎকার। কেউ আছেন আমার ছেলেটাকে বাঁচান! হাউমাউ কান্না করে বলছে, পানিতে পড়ে গেছে আমার বাপধন। বুঝতে পারলাম মানুষের ধাক্কায় নিজেকে সামলে রাখতে না পেরে পানিতে পড়েছে ছেলেটি।

রাকিব ছেলেটির পানিতে পড়ার কথা শুনেই, কোথা থেকে এক গাছা রশি এনে রেলিং এর সঙ্গে বেঁধে নিচে ফেলল। ছেলেটি যাতে রশি ধরে উপরে আসতে পারে।

আমি অবাক হলাম এটা দেখে যে, কয়েক মিনিট আগেও যার যার প্রাণ বাঁচানোর চেষ্টা করছিল। আর এখন একটি ছেলের প্রাণ বাঁচানোর জন্য সবাই আপ্রান চেষ্টা করছে। ১০ থেকে ১৫ মিনিটের চেষ্টায় ১২ বছরের ছেলেটি প্রাণে বেঁচে গেল।

এভাবেই ৪০ থেকে ৪৫ মিনিটের ব্যবধানে ঝড় ও বৃষ্টি কমতে শুরু করে। সবাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। কারন এ যাত্রায় সবাই হিংস্র ঢেউয়ের কবল থেকে বেঁচে ফিরলাম। মনে মনে শুকরিয়া জানালাম আল্লাহর প্রতি। সর্বশক্তিমানের করুণায় আমাদের নতুন জীবন। যাহোক লঞ্চ থেকে নেমে যার যার গন্তব্যে রওনা হলাম। আর এই লঞ্চ ভ্রমনই জীবনে অভিজ্ঞতার নতুন মাত্রা যোগ করল। “কেননা আজ শনিবার!”

প্রতিধ্বনি
প্রতিধ্বনিhttps://protiddhonii.com
প্রতিধ্বনি একটি অনলাইন ম্যাগাজিন। শিল্প,সাহিত্য,রাজনীতি,অর্থনীতি,ইতিহাস ঐতিহ্য সহ নানা বিষয়ে বিভিন্ন প্রজন্ম কী ভাবছে তা এখানে প্রকাশ করা হয়। নবীন প্রবীণ লেখকদের কাছে প্রতিধ্বনি একটি দারুণ প্ল্যাটফর্ম রুপে আবির্ভূত হয়েছে। সব বয়সী লেখক ও পাঠকদের জন্য নানা ভাবে প্রতিধ্বনি প্রতিনিয়ত কাজ করে চলেছে। অনেক প্রতিভাবান লেখক আড়ালেই থেকে যায় তাদের লেখা প্রকাশের প্ল্যাটফর্মের অভাবে। আমরা সেই সব প্রতিভাবান লেখকদের লেখা সবার সামনে তুলে ধরতে চাই। আমরা চাই ন্যায়সঙ্গত প্রতিটি বিষয় দ্বিধাহীনচিত্ত্বে তুলে ধরতে। আপনিও যদি একজন সাহসী কলম সৈনিক হয়ে থাকেন তবে আপনাকে স্বাগতম। প্রতিধ্বনিতে যুক্ত হয়ে আওয়াজ তুলুন।
এই ধরণের আরো লেখা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

প্রতিধ্বনির বর্তমান মূল্যprotiddhonii.com estimated website worthprotiddhonii.com domain valuewebsite worth calculator

সাম্প্রতিক লেখা

Recent Comments