গাজী আবদুস সালাম
নিজের চেহারা দেখে আঁতকে উঠল ছেলেটি। তার চেহারা তো খুবই সুন্দর ছিল। তাহলে এখন এমন কুৎসিত হলো কেন? কিছুতেই মাথায় আসছে না তার। বিশাল এক বিরান মাঠের মাঝ দিয়ে হেঁটে চলেছে সে। হঠাৎ দূর থেকে দুইজন অদ্ভুত লোক এল তার কাছে। মূহুর্তেই তাদের চেহারা বিদঘুটে হয়ে গেল। চোখগুলো হয়ে গেল আগুনের গোলার মতো। মনে হলো এক্ষুনি ছেলেটার কলিজা বের করে চিবিয়ে খাবে তারা। ছেলেটিকে শক্ত করে ধরল তারা। তারপর টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে যেতে লাগল। ছেলেটি তার পায়ের তলায় আগুনের উষ্ণতা পেতে লাগল। মনে হলো তার পায়ের গোশত গলে যাচ্ছে তাপে।
-তোমরা কারা, আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছ? আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। আমাকে ছেড়ে দাও, দোহাই তোমাদের। আমার পা আগুনে পুড়ে যাচ্ছে। বলল ছেলেটি।
-আমরা হলাম আযাবের ফেরেশতা। তোমাকে আজ শাস্তি পেতেই হবে। অবশ্যই তুমি যন্ত্রণা ভোগ করবে আজ। এটাই তোমার উপযুক্ত পাওনা। বলল তারা।
-কিন্তু কেন, আমার অপরাধটা কী। আর আমাকে খুলে না বললে আমি বুঝব কীভাবে?
-অপরাধ শুনতে চাও? মনে করে দেখো কী অপরাধ করেছ তুমি।
ছেলেটি কিছুই মনে করতে পারল না। ফেরেশতারা তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। তৎক্ষনাৎ সবকিছুই মনে পড়তে লাগল তার। চোখের সামনে ভাসতে লাগল সব পাপ কাজের চিত্র। সে মানুষের গীবত করে বেড়াত। মানুষকে নিয়ে অহেতুক মজা করত। মানুষের নাম বিকৃত করত। সে আল্লাহকে ভুলে গিয়েছিল। নামাজ পড়ত না। অশ্লীলতার মধ্যে ডুবে থাকত সবসময়। তার এক বন্ধু তাকে প্রায়ই নামাজের জন্য ডাকত। কিন্তু সে তার কথা তো শুনতই না বরং উল্টো তার নামে কুৎসা রটনা করত।
এসব ভাবতেই ছেলেটি ভীষণ কষ্ট পেল। কিন্তু হায়! আজকে তো বাঁচার কোনো উপায় নেই। সে বুঝতে পারল সে মারা গেছে। তখন ভয়ংকর ফেরেশতারা তাকে বলল, ‘কি বুঝতে পেরেছ, তোমার অপরাধগুলো কী? তারপর আগুনের কাঁচি দিয়ে তার জিহ্বাটি কাটতে লাগল তারা। তার মাথা হাতুড়ি দিয়ে চূর্ণ-বিচূর্ণ করতে লাগল। নতুন নতুন শাস্তি তার সামনে হাজির করা হলো। কী আশ্চর্য! তার শরীর চূর্ণ-বিচূর্ণ হবার পরেও আবার নতুন রূপে ফিরে আসছে। চিৎকার করতে লাগল সে। কিন্তু কোনো লাভ হলো না। কাঁদো কাঁদো স্বরে সে আল্লাহকে ডাকতে লাগল। একটা গায়েবি আওয়াজ ভেসে এল তখন: আজকে আমি তোমাকে ভুলে গেলাম, যেমন করে দুনিয়াতে তুমি আমাকে ভুলে গিয়েছিলে। আমাকে আর ডেকো না আজ। বলেই আওয়াজটি বাতাসে মিলিয়ে গেল।
তীব্র পানি পিপাসায় ছেলেটির জিহ্বা বের হয়ে বুক পর্যন্ত নেমে এল। কিন্তু পানি আর মিলল না। হঠাৎ বিকট চিৎকারে পুরো ঘর কেঁপে উঠল। ছেলেটির মা তার গায়ে টোকা দিল। ‘এই খোকা, খোকা! ভয় পেয়েছিস বুঝি, দুঃস্বপ্ন দেখেছিস, তাই তো? আর ভয় নেই। এই যে আমি এখন তোর পাশে।’ অভয় দিয়ে বলল তার মা। ঘুম ভেঙে গেল তার। শরীর থেকে দরদর করে ঘাম ঝরতে লাগল। চোখ দুটো তখনও বড়ো হয়ে আছে তার।
ফজরের সময় হয়ে গেছে। মসজিদ থেকে মুয়াজ্জিনের সুমিষ্ট আজানের সুর ভাসতে লাগল বাতাসে। হায়্যি আলাল ফালাহ… আসসলাতু খইরুম মিনান নাওম…। কী এক অপূর্ব সুর! সেই সুর ভেসে যাচ্ছে দূর-বহুদূর। ও সুরে কী জাদুমাখা, তা কে জানে।
মাকে কিছু না বলেই সোজা ওয়াশরুমে গেল সে। সুন্দররূপে অজু করে মসজিদের দিকে রওনা দিল। যে ছেলেটি তাকে নামাজের কথা বলত, আজ তাকে ডেকে নিয়ে সে মসজিদে গেল।
ইমাম সাহেব মহাগ্রন্থ আল কুরআন থেকে সুরেলা কন্ঠে তিলওয়াত ধরলেন। মহান প্রভুর স্বর্গীয় বাণী এটি। যতই শুনছে ততই অভিভূত হচ্ছে ছেলেটি। একপর্যায়ে ইমাম সাহেব কান্নাজড়িত কন্ঠে সূরা আল মুদ্দাসিরের (৪২-৪৮) নম্বর আয়াত তিলওয়াত করতে লাগলেন।
”তোমাদের আজ কীসে এ ভয়াবহ আযাবে উপনীত করেছে? তারা বলবে, আমরা নামাজীদের দলে শামিল ছিলাম না… আমরা আখেরাতকেও মিথ্যা প্রতিপন্ন করতাম। এমনকি চূড়ান্ত সত্য মৃত্যু আমাদের কাছে হাজির হয়ে গেল। তাই কোনো সুপারিশকারীর সুপারিশই তাদের কোনো উপকারে আসবে না।”
ছেলেটির চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে সিজদার স্থান ভিজে গেল। নামাজ শেষে মোনাজাতে প্রতিজ্ঞা করল সে, কঠিন প্রতিজ্ঞা। আর কোনোদিন আল্লাহকে ভুলে যাবে না সে।
যে জগদ্দল পাথরটি এতদিন চেপে ছিল তার বুকে, আজ তা থেকে সে মুক্তি পেল।