সাইদুল হাসান
শুকনো মুখ। দেহের চামড়ার ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে আছে সহস্র ট্রাজেডি উপন্যাস। জোড়াতালি দেওয়া মোটা ফ্রেমের চশমাতে আটকানো স্বপ্নের দল। পড়নে জীর্ণশীর্ণ শাড়ির আচলে বাঁধা সন্তানের কাফনের কাপড়। মাটির ঘরে বিছানো পাটির উপর শুয়ে বসে কাটে রাতদিন। কেরি পোকাদের আসর জমে ভাঙা তালা ঝুলানো ছোট্ট ড্রামটায়। ঘরের চারপাশটা কেমন নির্জীব! জমিলার ঘরে সূর্যের প্রকরণ আসে দরজা ভেদ করে। তবে সুখের পরশ নেই বহুদিন।
জমিলার স্বামী মজুরির কাজ করতো ইট ভাটায়। একমাত্র ছেলের বহুল আকাঙ্ক্ষিত স্বপ্ন বিদেশে পারি দিয়ে তাদের দুঃখ ঘুচবে। কিন্তু এতো টাকা কোথায় পাবে তারা! স্বামী জনাব আলীর মজুরী দিয়ে কোনোরকমে খেয়ে পড়ে দিন কেটে যায়। ছেলে তো নাছোড়বান্দা। যেভাবেই হোক টাকা যোগাড় করে দেওয়াই লাগবে। জনাব আলীর কপালে চিন্তার রেখা ঝেঁকে বসে। একমাত্র ছেলে তাদের। বারবার মানা করলেও শুনছে না। কী আর করার। সুদে টাকা ধার করে ছেলেকে বিদেশ পাঠায়। মাস পেরুতে না পেরুতেই তাদের প্রতিবেশি এক ছেলে জানায় তাদের ছেলে নাকি দালালের খপ্পরে পরেছে। তার কোনো খোঁজ নেই। একথা শুনে তো জনাব আলীর মাথায় সাত আকাশ ভেঙে পড়ার মতো নাজেহাল অবস্থা। স্ট্রোক করে বসে সে। বিকেলে প্রচন্ড জ্বর আসে তার। গা যেন উত্তপ্ত লোহা। সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত হতেই জমিলার ঘর থেকে গুণগুণ শব্দের কান্না ভেসে আসে। প্রতিবেশিদের মনে খটকা লাগে। তাহলে কি বুইড়া ব্যাটা চইলা গেল! আমাগো ঋণের টাকা দিব কেডা? পোলাডারও খবর নাই। একটি বিরান রাত কাটে জমিলার। আশেপাশে তার দুয়েকজন মহিলা ছাড়া কেউ ছিল না এই মর্মান্তিক রাতে। সকাল হতেই মুয়াজ্জিন ঘোষণা দেয় মৃত্যুের সংবাদ। পাওনাদারদের ভিড় জমে বাড়ির আশেপাশে। শোকাবহ বাড়িটা যেন টাকা-পয়সা হিসেবের আসর। জমিলার কানে ভেসে আসে পাওনাদারদের অশালীন কথাবার্তা। এ যেন আধমরা জমিলা। চোখের সামনে স্বামীর লাশ। কলিজার টুকরো ছেলেটার নেই খোঁজ। এ যেন একলা চাঁদ মেঘের আড়াল থেকে খানিকটা দূরে। পাওনাদাররা তাকে শাসিয়ে যায় কড়াভাবে টাকা পরিশোধ করার জন্য। জমিলা, বোধশক্তিহীনের মতো কী জানি শুনছে। চোখের জল শুকিয়ে মরুভূমি। সেবারে কোনোক্রমে জানাজার পর্বটা পেরিয়ে যায় নানা মানুষের অনুরোধে।
নীল আকাশ। সাদা মেঘের ভেলা তুলোর মতো ওড়ছে। শরতের কাশফুল দেখা যায় জমিলার ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে। একমনে তাকিয়ে দেখে সে। দেখতে দেখতে বিশটা বছর কেটে গেল। চোখে জুড়ে বসল মোটা ফ্রেমের চশমা। ময়লা শাড়িতে ঢাকা শরীর। সুন্দর চেহারায় ভাঁজ পরেছে কালো রেখা। লাঠিতে ভর দিয়ে সঙ্গীহীন চলাফেরা। সেই পাওনাদারদের আর খোঁজ নেই। টাকা পরিশোধে অক্ষম বলে ঘরে থাকা কিছু তৈজসপত্র, বেতের মোড়া নিয়ে গিয়েছিল ওরা। ঘরের কোণে ছোট্ট একটা ড্রাম। মানুষের দেওয়া পুরনো কিছু চাল। সেগুলোতে অবাধ বিচরণ করছে কেরি পোকা। স্টিলের জগটায় ছিট পরে একদম নাজেহাল অবস্থা। মাটির চুলোটা সংস্কার করে দিয়েছিল ওপাড়ার জাহানারা। তরিতরকারি বলতে ঘরের সামনে ছোট্ট উঠানে কিছু শাকসবজি চাষ করে দিয়েছিল প্রতিবেশি ময়নাল। নিয়মিত পুষ্টিকর খাবারের অভাবে জমিলার শরীর শুকিয়ে একদম কাঠ। শরীরের হাড়গুলো ভেসে উঠে যেন ফুলকার সাহায্যে শ্বাস নেওয়া মাছের মতো। স্বামী, সন্তান হারানোর পর থেকে জমিলা বোবা হয়ে যায়। প্রয়োজন ছাড়া একটাও শব্দও উচ্চারণ করে না।
মাঘ মাস। ভোরবেলা কুয়াশায় ঢাকা চারপাশ। পরিবেশে শীত যেন ঝেঁকে বসেছে। সকাল পেরিয়ে দুপুর গড়ায়। কুয়াশার চাদরও সরতে থাকে। জমিলার ঘরের দরজা বন্ধ। প্রতিবেশি ময়নাল দরজার সামনে গিয়ে জমিলাকে ডাকে উচ্চস্বরে। কোনো সাড়াশব্দ নেই। দরজা ভেঙে দেখে জমিলা একপাশে উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। চোখ খোলা। হাতে ছেলের কাফনের কাপড়ের কিছু অংশ।