মুহাম্মদ মুহিউদ্দীন ইবনে মোস্তাফিজ
গ্রাম থেকে এসে শহরে বাবু হয়ে ওঠার গল্প। গ্রামের সহজ সরল মানুষ শহরে এসে
শহরে জীবন-যাপন করতে গিয়ে জীবনের আসল অর্থই ভুলে গেছি। গ্রামের কষ্টের
জীবন এই পাথরের শহরে জীবন থেকে অনেক ভালো। সকাল হয় মোরগের ডাকে রাত্রি
হয় সূর্য ডোবার মাধ্যমে। শহরের এই অলি-গলিতে ইট পাথরের উঁচু উঁচু দালানের
মাঝে সূর্য উঠা আর ডোবার চিত্র এ শহরের মানুষ দেখতে পায় না। কিভাবেই বা
দেখবে! উচু উঁচু দালানের মাঝে তো সূর্যের কিরণই পরেনা। শহরের মানুষের ঘুম
ভাঙ্গে গাড়ির হরণে। গাড়ির হরণের শব্দে মাথা ব্যথা উঠে যায়। শহরে জীবন গ্রামের
কিছু দিক দিয়ে উন্নত হয়েছে। খাবারের আর কষ্ট পেতে হয়নি। কিন্তু ইট পাথরের
এই শহরে হাজার মানুষ না খেয়ে রাত্রি যাপন করছে কিন্তু গ্রামের মানুষদের না
খেয়ে ঘুমাতে হয় না। লবণ ভাত খেয়ে হলেও রাত্রি যাপন করতে পারছে। শহরে এমনটা
হয় না, গ্রামে একে অন্যের খবর নেয়, শহরে ইট পাথরের দালানের মাঝে মানুষের
এত সময় নাই যে দেশের মানুষের খবর নেবে। প্রাণীর খবর নেয়ার সময় হয় কিন্তু
রক্তে মাংসে মানুষের খবর নেয়ার সময় তাদের হয় না। মানুষের দুই টাকার মূল্য
তাদের কাছে নেই! শহরি বাবু বলে কথা। আমি কিভাবে গ্রাম থেকে এসে শহরেই বাবু
হয়ে উঠলাম তা জানতে অনেকেই আগ্রহী। গ্রাম থেকে আসার সময় কিছু টাকা নিয়ে
শহরে এসেছিলাম। সেই টাকা দিয়ে রাস্তার পাশে ফুটপাতে একটি পানের দোকান
দিয়েছে। আলহামদুলিল্লাহ! দোকানে বেচাকেনা ভালোই চলতে ছিল। বেশ কিছুদিন পান
বিক্রির পর কিছু টাকা হাতে জমাতে শুরু করলাম। সেই জমানো টাকাগুলো দিয়ে একটি
চায়ের দোকান দিব বলে চিন্তা করলাম। যেই চিন্তা সেই কাজ। ফুটপাতের দিলাম
একটি চায়ের দোকান। সেখানে চা, পান উভয়টাই বিক্রি করি। বেচা বিক্রি ভালোই
চলছে। এভাবে ধীরে ধীরে হাতে টাকা জমাতে লাগলাম। একলা মানুষ কত টাকায় বা
খরচ হয় মাস শেষে। আর বাকি টাকাগুলো জমিয়ে রাখতাম। এভাবে করতে করতে
একটা সময় গিয়ে অনেক বড় অংকের টাকা জমা হয়ে যায়। তখন চিন্তা করলাম বড়
কিছু করতে হলে আরো টাকার প্রয়োজন তাহলে টাকাগুলো যেমন আছে তেমনি থাক,
খরচ করার প্রয়োজন নেই। এর দুই বছর পর আরো বেশ কিছু টাকা জমানো হলো।
এবার চিন্তা করলাম এ টাকা দিয়ে বড় কিছু করা উচিত, তাই করলাম। একটি সুপার
শপ দিয়ে দিলাম। আমার কষ্টের জমানো সব টাকা সুপার শপ দিয়ে শেষ। কিন্তু সুপার
শপে বেচা বিক্রি তেমন ভালো ছিল না। খুব চিন্তায় পড়ে গেলাম। আমার কষ্টের
জমানো অর্থ যদি এভাবে নষ্ট হয়ে যায় তাহলে আমার কী হবে? সব অর্থই তো
সুপার শপের পিছনে ব্যয় করলাম। যদি এই সুপার শপের উন্নতি না দেখি তাহলে আমি
শেষ। একটা কথা বলতে ভুলে গেছি, আমি আমার শখের চায়ের দোকান বিক্রি করে
দেইনি। প্রতিদিনের মতো চায়ের দোকানে চা বানাই। সুপার শপের জন্য কর্মচারী
রেখেছি। এভাবে বেশ কিছুদিন কেটে গেল। এভাবে চলতে চলতে আমার সুপার শপ
আলোর মুখ দেখতে শুরু করেছে, মানুষের কাছে পরিচিত লাভ করছে। মানুষ আমার শপে
কেনাকাটা করতে আসে। আমার শপের নাম বলতেই ভুলে গেছি, আমার সুপার শপের
নাম ‘আমার শপ’। মানুষ এখন আমার শপের থেকে কেনাকাটা করে। এভাবে ধীরে ধীরে
সুপার সব থেকে আমার পুঁজির সব অর্থ হাতে আসতে লাগলো। এদিকে চায়ের দোকান
থেকেও ভালো টাকা আসতে লাগলো। এ টাকা জমিয়ে শহরে জায়গা কিনলাম। সেখানে
একটি ১০ তলা ভবন নির্মাণ করবো বলে অনেক দিনের স্বপ্ন চোখের সামনে দেখতে
পেয়েও খুশি হলাম। টাকা জমিয়ে ১০ তলা ভবনের কাজ শেষ করলাম। ১০ তলা ভবনের
মালিক হয়েও শখের চায়ের দোকান আমি ছাড়িনি। শখ করে চায়ের দোকানের নামকরণ
করেছিলাম, শখের চায়ের দোকান। এভাবে ধীরে ধীরে আমার ব্যবসা বাড়তে লাগলো।
শহরে জায়গা কিনতে লাগলাম ভবন তুলতে লাগলাম। এলাকার সকলে আমাকে দেখলে
শহরে বাবু বলে ডাকে। কোন গ্রামের সহজ-সরল দিনমজুর মানুষ আজ শহরে
সম্পত্তির পাহাড় গড়েছে। গ্রামের সহজ সরল মানুষ আজ শহরে বাবু। শহরে বাবু হই
বা যাই হই না কেন। গ্রামের মায়া ভুলতে পারিনি। এত সম্পদ থাকা সত্তেও শান্তি
খুঁজে পাই না। গ্রামের মানুষ সত্যি গ্রামেই সুন্দর। এই ইট পাথরের শহরে নিঃশ্বাস
বন্ধ হয়ে আসে। নাই কোন আলো বাতাস নাই, কোন পাখির কলতান। গাড়ির হরণের
শব্দে বিরক্তিকর পরিস্থিত হয়ে ওঠে। নেই কোন শান্তির সুর। শহরি বাবু হয়ে কী
লাভ? যদি শান্তি না থাকে। আমি শুধুই শহরে বাবু!