Thursday, November 21, 2024
Homeসাহিত্যসাহিত্য সমালোচনাবাঙালি লেখকের জীবিকা সম্পর্কে দড়াটানা ঘাটের কথা

বাঙালি লেখকের জীবিকা সম্পর্কে দড়াটানা ঘাটের কথা

একজন লেখক প্রথমত একজন ভালো পাঠক। ফলে একজন লেখকের থাকে প্রয়োজনীয় কিছু বই, যা তিনি বারবার পড়েন, পড়ে আত্মস্থ করেন, সমর্পিত হন সেই বইটির কাছে। আর সেটা ঘটে নির্ধারিত কোনো বিষয় সম্পর্কে জানার জন্য, কখনো ভালো লাগার কারণে কিংবা কোনোকিছু বারবার জানার একান্ত আগ্রহ থেকে। আর আমরা যারা লিখি বা লিখতে এসেছি, আমাদের কৌতুহল হয়, কীভাবে লিখতেন আমাদের পূবসূরীররা। এজন্য আমরা দ্বারস্থ হই বিভিন্ন সাহিত্যপত্র, অনলাইন ম্যাগাজিন কিংবা দৈনিক পত্রিকার। কিন্তু যে পূর্বসূরী আমাদের জন্য ছিলেন পথ প্রদর্শক, যারা চিনিয়ে দিয়ে গেছেন সাহিত্যের গলি- ঘুপচির পথের দিশা, সেইসব বরেণ্য লেখক এবং তাঁদের লেখালেখির সময়কাল এবং সাহিত্যবিষয়ক বিভিন্ন পরামর্শ সম্পর্কে আমাদের জানাশোনার ব্যাপারটা কম ক্ষেত্রেই ঘটে থাকে। আমাদের সেই কৌতূহল উদ্দীপক পূর্বসূরী লেখকদের কথা এবং তাদের লেখালেখির সময়কালের বিভিন্ন স্মৃতিচারণ এবং তাদের সাহিত্য ও সাহিত্যিক জীবন নিয়ে তাঁদের অভিজ্ঞতা ইত্যাদি যদি একটি বইয়ের মলাটের মধ্যে আবদ্ধ পাওয়া যায় তবে একজন লেখকের জন্য সেটা দারুণ উপকারি বটে। লেখক প্রশান্ত মৃধা এমন এক সাহিত্যের ইশারা দিয়েছেন একটি প্রবন্ধের বইয়ের মাধ্যমে। নাম, দড়াটানা ঘাট সাহিত্যের ইশারা কিংবা হাতছানি।

নিছক নীরস সাহিত্য সমালোচনা নয়, বরং সাহিত্যজগতের বিচিত্র অলিগলি ও লেখকের মনের অন্দরমহলের সরস সুলুকসন্ধান নিয়েই এই বই। বইটিতে নেই কোনো লেখকের সাহিত্যকৃতির সাদামাটা বিবরণ, আছে লেখালেখির গোপন কলাকৌশলের খবরাখবর ও নিবিড় বিশ্লেষণ। যাঁরা লেখালেখি করছেন অথবা করতে চান অথবা একজন নিমগ্ন পাঠক- এই দুই তরফের জন্যই বইটিতে রয়েছে বহু চিন্তার খোরাক। যেনো বইটি সাহিত্যের কলকব্জার খুঁটিনাটি দেখবার এক আশ্চর্য আতশকাচ।

২২২ পৃষ্ঠার এই বইটিতে লেখক তুলে ধরেছেন কালজয়ী সব সাহিত্যিক এবং তাদের সাহিত্য জীবনের কথা। পাঠ্য বইয়ের মত গম্ভীর কোনো আলাপ নয়, সাধারণ এবং সোজাসাপটা ধরণের সাহিত্যালাপ। আর যে পর্বগুলো সাজিয়েছেন, প্রতিটি পর্বের শিরোনাম নির্বাচনেও দিয়েছেন আশ্চর্য চমক। নান্দনিক শিরোনামের সুবাদে লেখক খোদ বাংলা বাংলা সাহিত্য তো বটেই, বিশ্বসাহিত্য বা সাহিত্যিকদের নিয়ে হরেক আলাপ তুলে ধরেছেন প্রবন্ধগুলোর মাধ্যমে।

বইটির শুরুতে, যেখানে থাকার কথা মুখবন্ধ কিংবা ভূমিকার কথা, ঠিক সেখানেই চোখে পড়ে বইটি সম্পর্কে বিশেষ এক কৈফিয়ত নামা। দৃষ্টি দেওয়া যাক সেই কৈফিয়তনামার দিকে, বইটি সম্পর্কে কর্তৃপক্ষ আসলে কী কৈফিয়ত দিয়েছেন আমাদের কাছে। “যে শহরের জল হাওয়ায় বেড়ে উঠেছি, সেখানে কেউ হঠাৎ আলটপকা কথা বললে তাকে বলা হয়, সে যেন এই সমস্ত কথা দড়াটানা ঘাটে গিয়ে পায়ের উপরে পা তুলে বলে। বন্ধুজনের উদ্দেশে সেই আদেশমেশানো অনুরোধে একটু তাচ্ছিল্যের সুরও থাকে। এমন লাগামছাড়া কথার যোগ্য ওই ঘাট।

বৈঠকিকেতায় ইয়ারদোস্তদের গুলতানি কিংবা ছোটখাটো আলোচনাসভা, যার ধরন কিছুটা মজলিশি, সে সবের উপযুক্ত জায়গা- দড়াটানা ঘাট।

সারাবেলা দু-চারজন আড্ডায় মশগুল থাকে এই নদের কোন ঘাটে। সেখানে কাটিয়ে দেওয়ার নেই খিদের খবর আর ঘরে ফেরার তাগিদ। কেউ যদি তাদের খোঁজ করে, তাহলে সে জানে পাওয়া যাবে ওখানেই। সে ঘাট অবশ্যই নির্দিষ্ট একটি জায়গা। যদিও ওই নদের পাড়ে বেশ কয়েকটি ঘাটে এমন লাগাতার আড্ডা আজও জমে। সব কটি ঘাট আসলে একটি নির্দিষ্ট ঘাটের সহোদর!

এই ভৈরব নদের তীরে, দক্ষিণ সাগর থেকে উঠে আসা নোনা বাতাস গায়ে মেখে যেভাবে সকল অর্গল খুলে কথা বলা যায়, দিনভর, রাতেরও প্রথম দুটো প্রহর প্রায় ছুঁয়ে, অনেকটা সে আদলে সাহিত্যিক বিষয়াদি নিয়ে এখানে কিছু কথা বলা হয়েছে। পুরোপুরি মজলিসি ভঙ্গিতে হয়তো নয়। সেভাবে কথার পিঠে কথা তুলে বাধঁবার মতন সুযোগ আর যোগ্যতা কোনোটিই নেই তবু—

বইটির শুরুতে এই যে কৈফিয়তের আলাপ এতে সহজেই অনুমান করা যায় লেখক আসলে কি বার্তা চেয়েছেন পাঠকের জন্য। সূচিপত্রের দিকে তাকালেই আমাদের সেই কৌতুহল অনেকটা মেটে। যেমন, বাঙালি লেখকের জীবিকা, গদ্যলেখকের সামর্থ্য ও শ্রম, বঙ্কিমচন্দ্রের বারো দফা, অরণ্যের নির্জন পথে কবিয়াল, তারাশঙ্করের সংগ্রাম, জীবনানন্দ সম্পর্কে শোনা কথা, ঢোঁড়াই ও সতীনাথ, আত্মহত্যার পূর্ব ঘোষিত অধিকার, অনুচ্চ রাগের সেতারবাদক, তেত্রিশ বছর পরে, যে খোঁজে আপন ঘরে, শিল্প নিজের মাটি থেকেই উদ্গত, দ্রোণাচার্য, নিরাপদ তন্দ্রা, কোলাহলে নৈঃশব্দ, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের প্রভাব ও প্রস্তুতি, ছোটগল্পের হুমায়ূন আহমেদ, হারু ঘোষ যে কে! কোন সে জন, কাফকার একটি চিঠি, ছাপাখানার ভূত এখন দিনের আলোয়, ফসলশূন্য শীতের রিক্ত মাঠ, ম্যাকফারসন লাইব্রেরি, রুশ বই, গদ্যলেখক কবিতার কাছে, ছোটগল্প প্রযুক্তি সাংস্কৃতিক শূন্যতা ইত্যাদি, নীহাররঞ্জন রায়ের সাবধান বাণী ইত্যাদি।

আলোচনার দীর্ঘসূত্রিতায় পাঠকের ধৈর্যচ্যুতি ঘটার অনুমানে আজকের এই পর্বে বইটির প্রথম প্রবন্ধ “বাঙালি লেখকের জীবিকা” নিয়ে খানিক আলোকপাত করা যাক। চার পৃষ্ঠার এই প্রবন্ধের শেষভাগে লেখা আছে প্রবন্ধটি লেখার দিনক্ষণের কথা। আর সেটা খুব বেশি অতীতের কথা এমনও নয়। লেখক এই প্রবন্ধটি লিখেছেন ২০১৮ সালের কোন একটা সময়ে। একজন বাঙালি লেখক শুধুমাত্র লিখেই যে জীবন ধারণ করতে পারেন না, তাঁরও আছে জীবীকার তাগিদ, আছে পেটের দায়-পিঠের সওয়া। লেখকজীবনের এই ঘোষিত সত্য কথাটি তুলে ধরার জন্য লেখক এই প্রবন্ধে বলেছেন সেইসব কালজয়ী সাহিত্যিকদের লেখালেখির সময়কালের কথা। উঠে এসেছে, লেখার বাইরে তাঁদের ব্যক্তিগত পেশার কথা। আর সেইসব পেশা সামলে লেখক একের পর এক সেরা লেখাটি লিখে আমাদের মত পাঠকদের মন আজও ভরিয়ে রেখেছেন। শুধুমাত্র লেখাকে পেশা হিসেবে না নিয়ে অনেকেই এই শিল্পচর্চাটি করে গেছেন বিনাশ্রমে। কখনো, কেউ কেউ জীবিকার প্রয়োজনে অন্য পেশার সাথে জড়িত থাকলেও তাদের ধ্যান-জ্ঞানে মিশে ছিল সাহিত্য নামক প্রেম। ফলে যে যে পেশায় থাকুক না কেন দিনশেষে তাঁরা কোনো এক অদৃশ্য তাগিদেই বসে যেতেন লেখার টেবিলে। পেশাগত কাজের সমস্ত ধকল পেরিয়ে দিনশেষে যেটুকু বিশ্রামের সময়, একজন আত্মনিবেদিত লেখক সেই বিশ্রামকে প্রশ্রয় দেননি কখনো। অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে লিখে ফেলেছেন একের পর এক মহৎ গ্রন্থ। তবে সেইসব লেখার পেছনে লেখকের যে শ্রম-ঘাম, যে বেদনা নিহিত রয়েছে তার একটি পষ্ট খতিয়ান পাওয়া যায় প্রবন্ধটিতে।

লেখক প্রবন্ধটা শুরু করেছেন এভাবে- “দুনিয়ার সবচেয়ে বঞ্চিত শ্রমজীবীদের একজন বাংলা ভাষার কথাসাহিত্যিক। প্রায় প্রবাদের মতো করে বলা একথা শুনে পাশ থেকে তার সমকালীন কবি বন্ধু হয়তো মুচকি হাসেন, কিন্তু মেনে নেন। মেনে না নিয়ে উপায় নেই।”

লেখক তো শুধুমাত্র একজন লেখকই নন, দিনশেষে তিনি একজন আমাদের মতই সাধারণ মানুষ। ফলে জীবিকার প্রশ্নে পরম বাস্তব সত্যটির কথা মেনে না নিয়ে উপায় থাকেনা। আর এই প্রসঙ্গে লেখক বাংলা ভাষার প্রধানতম বহু গদ্য লেখকদের প্রসঙ্গ তুলে এনেছেন, যাঁরা লেখার পাশাপাশি নিয়োজিত ছিলেন বিভিন্নরকমের পেশার সাথে। এক্ষেত্রে সর্বাগ্রেই উল্লেখ করা যায় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা। লেখালেখির পাশাপাশি লেখকের পেটে যে ভাত থাকতে হয়, এই সমস্যা তিনি হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছেন। যা আমরা তাঁর স্মৃতিচারণমূলক গদ্যগুলো থেকে উপলব্ধি করতে পারি। প্রবন্ধাকার উদ্বৃতি দিয়ে লিখেছেন, ‘এই সমস্যা তিনি হারে হারে বুঝেছেন তার মত করে, বোঝেননি আর কোন লেখক। একেবারে জীবন দিয়ে নিজেকে নিঃস্ব করে বোঝা যাকে বলে। অথচ লেখক হিসেবে তিনি খানিকটা নাম করা বয়সে মাত্র ২৮ তখনই (১৯৩৬) তো লিখে ফেলেছেন বাংলা ভাষার চারটি গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাস- দিবারাত্রির কাব্য, জননী, পদ্মা নদীর মাঝি ও পুতুল নাচের ইতিকথা। বাংলা গদ্য কাহিনীর তাতে হয়তো উন্নতি হয়েছে কিন্তু বিক্রমপুরের মালপদিয়ার মানিক বাড়ুজ্যের লাভ হয়নি কিছুই তবু লেখাকে জীবিকা করার চেষ্টা করে গেছেন তিনি। তাই শেষ জীবনে তার উপলব্ধি বড় করুণ। চারটি ডাল ভাতের ব্যবস্থা না রেখে কোন বাঙালি লেখক যেন লিখতে না আসে।’

যদিও নির্মম তবে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের জীবনের শেষ ভাগের এই করুণ কথাগুলো বলার পর লেখক তুলে এনেছেন আরো কয়েকজন বাঙালি লেখকের উদাহরণ যাঁরা কিনা শুধুমাত্র জীবিকার তাগিদেই বেছে নিয়েছেন বিভিন্ন রকমের পেশা আর তাদের কেউ ছিলেন শিক্ষক কেউ সাংবাদিক কেউ সরকারি আমলা অথবা কেউ আইন পেশায় নিয়োজিত দাপুটে উকিল।

বুদ্ধদেব বসু কিংবা সৈয়দ মুজতবা আলীর মত ডকসাইটের লেখক পেশাগত জীবনে কখনোই স্বস্তিতে ছিলেন না। বুদ্ধদেব বসু তাঁর এক স্মৃতিচারণে লিখেছেন, বাড়িতে হাঁড়িচড়ে তার কলমের নিব ঘসে। যদিও সৈয়দ মুজতবা আলীর বিষয়টা একটু অন্যভাবে দেখেছেন লেখক। প্রথম লেখা দেশে-বিদেশে থেকেই তিনি বিখ্যাত কিন্তু শিক্ষকতা বা সরকারি চাকরি কোথাও তাকে স্বস্তি দেয়নি। ওদিকে চাকরি যখন থাকতো তখন কলম চালাতে চাইতেন না তিনি। বলতেন যে, রাজ্যে পয়সা থাকলে লিখব কেন। যদিও লিখেই তাকে চলতে হয়েছে জীবনের অনেকগুলো দিন। তাই অর্থকষ্ট পিছু ছাড়েনি কোনোদিনই। জীবনানন্দ দাশ বরিশালের ব্রজমোহন কলেজে চাকরির আগে বারবার অনিশ্চয়তার ভেতর দিয়ে গেছেন। তিনি চাকরি করেছেন সংবাদপত্রের পাতায়, অর্থকষ্ট ঘোচাতে লিখতে হয়েছে উপন্যাস কিন্তু অজ্ঞাত কোন এক কারণে সেই উপন্যাসগুলি তখন ছাপতে দেননি তিনি। তবে বেকারত্বের মলিন দিনগুলো ভরিয়ে তুলেছেন অমলিন সব গল্প উপন্যাসে একান্তে আর নিভৃতে।

তিরিশের দশকে লেখকদের ভিতরে অনেকেই ছিলেন মেধাবী ছাত্র। তাঁদের কেউ কেউ আবার সচ্ছল পরিবারের সন্তান। যেমন অমীয় চক্রবর্তী, অন্নদাশঙ্কর রায়, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, ধূর্জটি প্রসাদ মুখোপাধ্যায়, সতীনাথ ভাদুড়ী প্রমুখ। প্রায় হারিয়ে যাওয়া জমিদার বাড়ির ছেলে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যাপারটা এখানে উল্টো। কেননা, তাঁর পেটে বিদ্যা ছিল কম। তাই যখন লিখে দিন চলে না, পরিবার থেকে দূরের কলকাতায় থাকতেন একা। বোম্বে টকিজে কাহিনি রচনার জন্য মোটা বেতনের প্রস্তাবও ফিরিয়ে দিয়েছেন তিনি গ্রহণ করবেন না বলে। অন্যদিকে জগদীশ গুপ্ত ছিলেন আদালতের টাইপ রাইটর। সাংবাদিকতা করেছেন কাজী নজরুল ইসলাম। যদিও সেখানে সচ্ছলতার মুখ খুব একটা দেখেছেন এমন নয় তবে তাঁর কাব্যগ্রন্থের বিক্রির রেকর্ড আজও বিস্ময়কর। পরে গ্রামোফোন কোম্পানির গান লেখাই ছিল তাঁর প্রধান জীবিকা। কিন্তু সেই পর্বে আয়রোজগার যদিও ছিল ভদ্রস্থ কিন্তু দুরারোগ্য ব্যাধি কেড়ে নিল তাঁর সেই সুদিনের পথ।

প্রবন্ধটিতে লেখক স্মরণ করেছেন শিবরাম চক্রবর্তীর কথা। যিনি জীবিকার খোঁজকে তোয়াক্কা না করেই কাটিয়ে দিয়েছেন একটি জীবন। অন্যদিকে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় চাকরি করেছেন জমিদারের স্টেটে। পরে অবশ্য শিক্ষকতাও করেছেন তিনি। কিন্তু তাঁর আত্মভোলা জীবনাচরণ কখনো লেখা আর জীবিকার দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করেনি। অন্যদিকে বিশিষ্ট রম্য ও সমাজ সচেতন লেখক আবুল মনসুর আহমদ জীবিকা নির্বাহ করেছিলেন সাংবাদিকতা এবং আইন পেশা দিয়ে এছাড়াও বিচিত্র জীবিকায় নিয়োজিত ছিলেন অনেক লেখকই। জরাসন্দ্র ছিলেন জেলখানার জেলার, সুবোধ ঘোষ প্রথম জীবনে ছিলেন বাসের হেলপার, পরে ট্রাক ড্রাইভার আর সার্কাসের ক্লায়নের কাজও করেছিলেন তিনি। শেষমেশ হতে পেরেছিলেন বিখ্যাত সাংবাদিক। অবধূত ছিলেন একজন সন্ন্যাসী আর সেই সময়েই লিখতে শুরু করেন তিনি। ফলে জীবিকার বিষয়টি মাথায়ই ছিলনা তাঁর। গোপাল হালদার, লীলা মজুমদার করেছেন শিক্ষকতা অচিন্ত্য সেনগুপ্ত ছিলেন সরকারি আদালতের মুন্সেফ। প্রেমেন্দ্র মিত্র করেছেন সাংবাদিকতা, চলচ্চিত্র পরিচালনায় ছিল তাঁর উত্তম হাত। মেধাবী ছাত্র নীরদ চন্দ্র চৌধুরী কখনো একটানা নির্দিষ্ট কোন জীবিকার সাথে জড়িতই ছিলেন না।

এই পর্বের লেখকদের প্রায় কেউই কখনো জীবিকাই খুব একটা ভীতু ছিলেন তা নয় তবে অনিশ্চয়তা কখনোই পিছু ছাড়েনি তাঁদেরকে।

ব্রিটিশ রাজ্যের পতনের পর এবং দেশভাগের পরে উভয়বাংলায় নতুন কিছু চাকরির পথ সৃষ্টি হওয়ার কারণে বেশ কয়েকজন লেখক সরকারি দপ্তরে পেয়ে যান গুরুত্বপূর্ণ পদে চাকরির সুযোগ। এর বাইরে অনেকেই সারা জীবন ছিলেন সাংবাদিক অথবা শিক্ষক। অরুন মিত্র, যতীন্দ্রনাথ, বিমল মিত্র, অমিয়ভূষণ মজুমদার, আবু রুশদ, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, শওকত ওসমান, নরেন্দ্রনাথ মিত্র, আহসান হাবীব, ফররুখ আহমেদ, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, বিমল কর, রমাপদ চৌধুরী, রশিদ করীম, অসীম রায় প্রমুখ লেখকরা সরকারি- বেসরকারি চাকরি, সাংবাদিকতা আর শিক্ষকতা নিয়ে কাটিয়ে দিয়েছেন সারাজীবন। অন্যদিকে কমলকুমার মজুমদার ছিলেন আমদানি রপ্তানির ব্যবসায়ী। পরে অবশ্য শিক্ষকতা করে জীবনের শেষ সময়টা কাটিয়ে দিয়েছেন লেখালেখির আনন্দ নিয়ে।

শেষদিকে প্রবন্ধাকার একজন লেখকের জীবিকার জন্য যে দৈনন্দিন হাহাকার সেটি প্রকাশ করেছেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের দুটো ডায়েরির পাতার উদ্বৃতি দিয়ে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ডায়রিতে দিনযাপনের হিসাবের সঙ্গে লিখেছেন যে, একটি গল্প বা উপন্যাস লিখে কত টাকা পাবেন অথবা একটি উপন্যাস ভেঙে কয়েকটি গল্প লিখে দিলে বেশি পয়সা পাওয়া যাবে। অন্যদিকে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস বলেছেন, কলেজের এমন সব কাজ তাঁকে দেওয়া হয়েছে যে, তিনি লিখবার সময় বের করতে পারছেন না। অথচ লেখার জন্য সময়ের তাঁর ভীষণ প্রয়োজন। এখানে প্রায় দম নিতে না পারা মানুষের মতো অসহায়ত্ব তখন। ইলিয়াস সবসময়ই বলতেন যে, তিনি সার্বক্ষণিক লেখক। অর্থাৎ জীবিকাসহ অন্যান্য কাজের সময় বের হয় ঠিকই আসলে তখনও লিখবার সময়টাকে বের করতে চান, তাই লেখা তাঁর কাছে সার্বক্ষণিক।

এই যে লেখকদের জীবন ও জীবিকা নিয়ে আলাপ এটা অত্যন্ত করুন এবং মর্মস্পর্শী । সমকালীন লেখকরাও কোন না কোন পেশার সাথে জড়িত। কিন্তু অতীতে তো বটেই, বর্তমানেও কোন লেখকের লেখালেখিকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়ে জীবিকা ধারণের সুযোগ নেই। ফলে একজন লেখককে পেটের দায়ে সাত থেকে আট ঘন্টা নিয়োজিত থাকতে হয় পেশাগত কাজের ভেতর। অনেককে তার চাইতেও বেশি। তবে দিনশেষে একজন লেখক ঘরে ফিরে বিশ্রামের সময়টুকুকে একপাশে ঠেলে রেখে সাহিত্যের প্রতি নিবেদিত প্রাণ নিয়ে যখন লিখতে বসেন, পৃথিবীর সমস্ত বেদনা তাঁর কাছ থেকে সরে যায় যোজন যোজন দূর। এমনকি এই পৃথিবী থেকে অন্য কোনো গ্রহে, মহাপৃথিবীর পথে।

সারাটা জীবনই ছোটখাট একটা না পাওয়ার বেদনা আর অপূর্ণতার অভাব কাজ করে লেখকের ভেতর। আর তিনি মনে মনে এটাও এরাদা করেন, যদি সার্বক্ষণিক সময় তাঁর জন্য নিয়োজিত থাকতো, তবে মনের ভেতরকার জমে থাকা কথাগুলো কলমের আঁচড়ে একের পর এক লিখে ফেলতে পারতেন তিনি। কিন্তু সমাজজীবন এবং ইহলৌকিক ব্যস্ততা আর জীবিকার তাগিদ ইত্যাদি সেই সুযোগ কখনো কি দিয়েছে আমাদের দেশর লেখকদেরকে! কিংবা দেবে! তবুও দিনশেষে ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত একজন লেখক হয়ে ওঠেন সত্যিকারের একজন শিল্পী। যিনি কোনভাবেই না লিখে থাকতে পারেন না।

ক্রমশ…

মোস্তফা অভি

খিলক্ষেত, ঢাকা।

তারিখঃ মে ১০, ২০২৪।

Facebook Comments Box
RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments