Saturday, July 27, 2024
spot_imgspot_imgspot_img
Homeসম্পাদকীয়বিসিএস না হলে কি পরিশ্রম বৃথা

বিসিএস না হলে কি পরিশ্রম বৃথা

-সঞ্জিব কুমার রায়

একজীবনে অনেক চাকরি পরীক্ষায় অংশ নিতে হয় চাকরিপ্রত্যাশীদের। দেশে বিসিএসের পরীক্ষা অন্যতম, বলতে গেলে সেরার সেরা। বিসিএস ক্যাডার হওয়ার স্বপ্ন দেখেন না, এমন বৈরাগ্যধারীও যেন বিরল! যেমন মানসিক লড়াই, তেমনি শারীরিক লড়াই! তীব্র লড়াই সব প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে। নিজের বয়সের বিরুদ্ধে, নিজের পরিবার ও সমাজের বিরুদ্ধে, অভাবের বিরুদ্ধে, বিরুদ্ধবাদীদের বিরুদ্ধে, সময়ের বিরুদ্ধে, এমনকি স্বয়ং ভাগ্যেরও বিরুদ্ধে।

অসম্ভব সব প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়েই হতে হয় একজন বিসিএস ক্যাডার। সময় শেষে তাই একজন বিসিএস ক্যাডার হয়ে যায় মহাকাব্যিক চরিত্র।

কিন্তু এটা অনেক পরের কাহিনি। সর্বশেষ কাহিনি। তবে এরও আগে রয়ে গেছে আরও অনেক না জানা কাহিনি, অনেক না জানা গল্প। একজন শিক্ষার্থীর বিসিএস–ভাবনা শুরু হয় ইন্টারমিডিয়েট থেকে। কোনো কোনো শিক্ষার্থীর ভাবনা শুরু হয় মাধ্যমিক পর্যায় থেকে। এমনকি কোনো কোনো শিক্ষার্থীর বিসিএস–ভাবনা শুরু হয় প্রাথমিক থেকেই, যাদের মা–বাবা শিক্ষিত কিংবা যাদের গৃহশিক্ষক অথবা স্কুলশিক্ষক দক্ষ অথবা বিসিএস নিয়ে যথেষ্ট জ্ঞান রাখেন। বিসিএস ক্যাডার হওয়ার ভাবনা মনে পুষে রাখে মোটামুটি দীর্ঘ ৮ থেকে ১০ বছর বা তদূর্ধ্ব। যেহেতু এ দীর্ঘ সময় ধরে একজন শিক্ষার্থী এই স্বপ্ন মনের মধ্যে লালন করেন, তাঁকে এ দীর্ঘ সময় ধরে মানসিক প্রস্তুতি নিতে হয়। শুধু মানসিক প্রস্তুতিই নয়, বরং মানসিক লড়াইও তাঁকে চালিয়ে যেতে হয় এ দীর্ঘ সময়। শরীরে ছোট হয়েও তাঁকে দূরদৃষ্টি রাখতে হয় তাঁর ভবিষ্যতের বড় দেহের ওপর। বয়সে অল্প হয়েও তাঁকে দূরদৃষ্টি রাখতে হয় তাঁর দীর্ঘকাল পরের ২৭ থেকে ৩০ বছরের ওপর। এ এক অচিন্তনীয় ব্যাপার!

দীর্ঘ সময় মানসিক প্রস্তুতিই কেবল একজন শিক্ষার্থীকে নিতে হয় না, তাঁকে দিতে হয় দীর্ঘ সময়ব্যাপী মেধার স্বাক্ষর, মেধার ধার। কেননা তিনি তাঁর অগ্রজদের কাছে সর্বদা এই শুনে শুনে বড় হন যে ‘যদি বড় হয়ে বিসিএস ক্যাডার হতে চাও, এ রকম ম্যাজিস্ট্রেট হতে চাও কিংবা ও রকম পুলিশ কর্মকর্তা হতে চাও কিংবা ওই রকম সর্বশ্রদ্ধেয় শিক্ষক হতে চাও, তবে তোমাকে সকল বিষয়ে এখন থেকেই শ্রেষ্ঠ হতে হবে। বিসিএস সারা জীবনের পরিশ্রমের ফল।’ ফলে একজন শিক্ষার্থী এহেন জনমনক্রাশিং চাকরি পাওয়ার জন্য দীর্ঘ সময় ধরে মেধার স্বাক্ষর রাখার চেষ্টা অব্যাহত রাখেন। দীর্ঘ দীবস দীর্ঘ রজনী, দীর্ঘ বরষ মাস!

এভাবে চলে একজন বিসিএসপ্রত্যাশী শিক্ষার্থীর দীর্ঘ সময়ের নিরলস স্বপ্ন বোনা এবং স্বপ্নকে ছুঁতে নিরলস পরিশ্রম। অতঃপর স্নাতক শেষ করে এবং বিসিএসে আবেদন করার যোগ্যতা অর্জন করেন, তখন তাঁর কাছে এ যেন ‘এ তো স্বপ্নের দ্বার’ মনে হয়। এ সময়ে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে ছাপানো হয় বিসিএস জয়ের গল্প। কে কতটা পরিশ্রমের বিনিময়ে বিসিএস জয় করলেন, কে কীভাবে পড়ে বিসিএস জয় করলেন, কার কত রকম প্রতিকূলতা সত্ত্বেও বিসিএস জয় হলো ইত্যাদি ইত্যাদি। অনলাইন পেজ তথা বিভিন্ন গ্রুপে বিসিএসের ব্যাপক কাটাছেঁড়া চলে, চলে বিভিন্ন নির্দেশনা। ইউটিউবে পর্দা কাঁপিয়ে ভেসে ওঠে বিসিএস ক্যাডার নামক বিভিন্ন আইকন, এপিক ক্যারেক্টাররা। বিসিএসের আবেদন থেকে পরবর্তী প্রিলিমিনারি, রিটেন ও ভাইভা পর্যন্ত চলে সেসব বিসিএস–জয়ী মহানায়কদের দিকনির্দেশনা, সাহস জোগানো ও স্বপ্ন দেখানো।

নিজেদের একাডেমিক পড়াশোনার পাট চুকিয়ে, বিসিএসে আবেদন করে এবং বিসিএস জয় করার অদম্য স্পৃহা নিয়ে শুরু হয় প্রত্যাশীদের অবর্ণনীয় হাড়ভাঙা খাটুনি। পত্রিকা, অনলাইনে প্রাপ্ত সেনানায়কদের যুদ্ধজয়ের ইতিহাস ও কৌশল রপ্ত করা এবং বাস্তবিক অর্থে সেসব প্রয়োগ করার দুর্বার মনোনিবেশ স্থাপন করে বিসিএসপ্রত্যাশী সৈনিকেরা স্বেচ্ছায় নির্বাসনে যান। একটি বিসিএসের ভাইভা রেজাল্ট পেতে কমপক্ষে ২ বছর, ঊর্ধ্বে ২ থেকে ২.৫ বছরের বেশি সময় লেগে যায়। উল্লেখ্য, ৩৮তম বিসিএসের বিজ্ঞাপন হয়েছিল ২০১৭ সালের ২০ জুন। এখন পর্যন্ত (১৮ মার্চ ২০২০) ওই বিসিএসের ভাইভা রেজাল্ট হয়নি। অর্থাৎ ৩৩ মাস বা ১০০০ দিন পার হলেও ৩৮তম বিসিএসের পূর্ণাঙ্গ রেজাল্ট পাননি বিসিএসপ্রত্যাশীরা। এ ছাড়া রেজাল্ট হলেও যাঁরা ক্যাডার হবেন, তাঁদেরই নিয়োগ পেতে হয়তো আরও কিছু সময় লাগবে গেজেট প্রকাশ হতে। আর যাঁরা নন–ক্যাডার হবেন, তাঁরা হয়তো গলা পর্যন্ত পানিতে দাঁড়িয়ে থাকার মতো কষ্টে দিনাতিপাত করবেন। তাঁরা সুখে হাসতেও পারবেন না, আবার অতি দুঃখে কাঁদতেও পারবেন না। আর যদিও বা এসব নন–ক্যাডারের নিয়োগ হয়, তবে সেটাও আরও বহুদূর! অপেক্ষার প্রহর যেন শেষ হতেই চাইবে না।

এই যে দুই থেকে আড়াই বছর সময়টায় একজন বিসিএস পরীক্ষার্থীকে ছাড়তে হয় অনেক কিছুই। বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন, এমনকি পরিবার–পরিজনকেও। কেননা যেকোনো মূল্যে বিসিএস ক্যাডার হওয়া চাই। তীব্র প্রতিযোগিতা। অসংখ্য প্রতিযোগী। কত শত রথী–মহারথী!

একটা মজার ব্যাপার হলো, কোনো পাড়ায় বা কোনো এলাকায় কোনো ছেলে বা মেয়ে যদি বিসিএসের প্রিলিমিনারিতে কোয়ালিফাই করেন, তাতেই ওই পাড়ায় বা এলাকায় একপ্রকার মিনিস্টারে পরিণত হয়ে যান। এ মিনিস্টার ফুল স্টারে পরিণত হয়ে যান, যখন তিনি রিটেনে কোয়ালিফাই করেন। আর পূর্ণাঙ্গভাবে যখন তিনি সিলেক্টেড হন, তখন তো তিনি হয়ে যান ওই এলাকার সুপারস্টার। কিন্তু সুপারস্টার হওয়াটা সবার কপালে হয়ে ওঠে না। হয়তো বিধাতা কপালে লিখে রাখেনি, তাই হয়নি। কিন্তু ভাইভায় অংশগ্রহণকারী সবাই দক্ষ ও যোগ্য বলে মনে হয় আমার। হয়তো সবাই সমান যোগ্য নন, তবে একটা চাকরি পাওয়ার জন্য কমপক্ষে হলেও তাঁরা যোগ্য বলে আমি মনে করি। তা ছাড়া তাঁদের এই বিসিএসের ভাইভা পর্যন্ত যেতে কত সময় বিনিয়োগ, কষ্ট ও শ্রমের বিনিয়োগ, কত স্বপ্ন ধারণ ও বুনন, তা কমবেশি সবারই জানা। কাজেই এতগুলো সময় ও শ্রমের বিনিময়ে, যে ছেলে বা মেয়ে বিসিএস ভাইভায় অংশগ্রহণ করেন, তাঁদের নিতান্তই শূন্য হাতে ফিরিয়ে দেওয়াটা খুবই দুঃখজনক ও হতাশার।

এবার আসা যাক চূড়ান্ত ফলের পর সামাজিক ও পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি কেমন দাঁড়ায়, তা দেখা যাক। যে ছেলেটা এত দিন ফুল স্টার ছিলেন, চূড়ান্ত রেজাল্টে তাঁর ক্যাডার লিস্টে রেজিস্ট্রেশন নম্বর থাকায় রাতারাতি তিনি সুপারস্টারে পরিণত হয়ে গেল। শত শত শুভেচ্ছা ও প্রশংসায় ভরে যায় তাঁর দিনগুলো। পরিবার ও স্বজনদের মাঝে খুশির জোয়ার বয়ে যায়। তাঁকে ও তাঁর মতো অন্য সফল ছেলেমেয়েদের দেওয়া হবে অভ্যর্থনা। কিছুদিন পর হয়তো পত্রপত্রিকায় ছাপানো হবে তাঁর আগের দিনগুলোর কষ্টের কথা, তাঁর পড়াশোনার পদ্ধতির কথা। কিন্তু স্মৃতির অতল গহ্বরে রয়ে যাবে সেই ছেলেটা বা মেয়েটা, যাঁর বিসিএসটা ফাইনালি হয়নি। সবাই হয়তো ভুলেই যাবেন তাঁর পরিশ্রমের কথা। একনিমেষে তিনি হয়ে যাবেন ‘নাথিং’! তিনিও হয়তো কাউকে বলতে পারবেন না যে আজ যে বিসিএস ক্যাডার হলেন, তাঁর চেয়ে তিনি কোনো অংশে কম নন। তাঁর মতো তিনিও হাড়ভাঙা খাটুনি করেছেন, সময় বিনিয়োগ করেছেন, স্বপ্ন দেখেছেন। তাঁর আজকের এ অবস্থায় আসার জন্য কেবল ৮ থেকে ১০ মিনিটের ভাইভা নামক একটা কাল নিঠুর মহাকালে রূপ নিয়েছে। তিনি নিজেও হয়তো মানতে চাইবেন না যে কেবল ৮ থেকে ১০ মিনিট তাঁর দীর্ঘ সময়ের অক্লান্ত পরিশ্রমের, স্বপ্নের বিনাশকারী হবে।

জগতে সবকিছু কেবল নিক্তির ওপর চলে না। মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি থাকাটাও জরুরি। ভাইভাকে অবমূল্যায়ন করছি না। ভাইভার দরকার আছে। তবে বিসিএস পরীক্ষা যেহেতু একটা মহাকাব্যিক যাত্রা, মহাকাব্যিক যুদ্ধের মতো তুমুল প্রতিযোগিতাপূর্ণ পরীক্ষা, দীর্ঘদিনের লড়াই, কাজেই এখানে বাস্তবিকতার পাশাপাশি মানবিকতাকেও ঠাঁই দেওয়া উচিত। বিসিএস ভাইভা কোনো প্রার্থীকে ফেল করানোর জন্য নয় বরং তুলনামূলক মেধা যাচাই ও তাঁর ভিত্তিতে ক্যাডার কিংবা নন–ক্যাডার দেওয়ার একটা পরীক্ষা হলে খুব ভালো হতো। আবার যাঁরা নন–ক্যাডার হবেন, তাঁদেরও যেন সবার চাকরি হয়, এ নিশ্চয়তাও থাকলে খুব ভালো হতো। সে ক্ষেত্রে প্রয়োজনে বিসিএস লিখিত পরীক্ষায় কম প্রার্থীকে টেকানো হবে ভাইভার জন্য। যেন সব প্রার্থী, যাঁরা বিসিএস ভাইভা দেবেন, কমপক্ষে একটা চাকরির নিশ্চয়তা পান। তাহলে কেউ হয়তো তাঁর ভাগ্যকে দোষারোপ করতে পারবেন না। কেউ হয়তো সাপলুডুর ৯৮–এর ঘরে গিয়ে সাপের মুখে পড়ে মুহূর্তে নিচে চলে আসবেন না।

লেখক: শিক্ষার্থী

Facebook Comments Box
প্রতিধ্বনি
প্রতিধ্বনিhttps://protiddhonii.com
প্রতিধ্বনি একটি অনলাইন ম্যাগাজিন। শিল্প,সাহিত্য,রাজনীতি,অর্থনীতি,ইতিহাস ঐতিহ্য সহ নানা বিষয়ে বিভিন্ন প্রজন্ম কী ভাবছে তা এখানে প্রকাশ করা হয়। নবীন প্রবীণ লেখকদের কাছে প্রতিধ্বনি একটি দারুণ প্ল্যাটফর্ম রুপে আবির্ভূত হয়েছে। সব বয়সী লেখক ও পাঠকদের জন্য নানা ভাবে প্রতিধ্বনি প্রতিনিয়ত কাজ করে চলেছে। অনেক প্রতিভাবান লেখক আড়ালেই থেকে যায় তাদের লেখা প্রকাশের প্ল্যাটফর্মের অভাবে। আমরা সেই সব প্রতিভাবান লেখকদের লেখা সবার সামনে তুলে ধরতে চাই। আমরা চাই ন্যায়সঙ্গত প্রতিটি বিষয় দ্বিধাহীনচিত্ত্বে তুলে ধরতে। আপনিও যদি একজন সাহসী কলম সৈনিক হয়ে থাকেন তবে আপনাকে স্বাগতম। প্রতিধ্বনিতে যুক্ত হয়ে আওয়াজ তুলুন।
RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments