লেখকঃ আলী আসগর স্বপন
খ্যাতিমান বাউল লালন শাহকে নিয়ে গবেষনার অন্ত নেই। তাকে নিয়ে বিভিন্ন তথ্য উপাদ্য দিন দিনেই বৃদ্ধি পাচ্ছে।তাকে নিয়ে কিছু লেখা আমার মতো নগ্য লোকের কম্ম নয়।কুড়িয়ে পাওয়া কিছু নিয়ে ফেইসবুকে ভারী করার একটা প্রয়াস ছাড়া কিছু নয়।
বাংলার বাউলদের মধ্যে যিনি ছিলেন সবচেয়ে খ্যাতিমান ও অসাধারণ best replica watches uk প্রতিভার অধিকারী তিনি হচ্ছেন লালন সাঁই বা লালন ফকির। বিস্ময়কর প্রতিভা এই লালন ফকিরের জন্ম হয়েছিল অত্যন্ত সাধারণ পরিবারে। তবে তার জন্ম এবং বংশপরিচয় দুটোই এক রহস্যের অন্তরালে লুকিয়ে আছে।
লালন নিজেও এই রহস্যের কোনো সমাধান replica watches দিয়ে যাননি। তার নিজেরই কিছু গান ব্যাপারটিকে আরো রহস্যময় করে তুলেছে। যেমন একটি গানে তিনি তার আত্মপরিচয় দিতে গিয়ে বলেছেন-‘সবে বলে লালন ফকির হিন্দু কি যবন?/লালন বলে আমার আমি না জানি সন্ধান।’
ভারতীয় উপমহাদেশের সবচেয়ে প্রভাবশালী আধ্যাত্মিক সাধকদের মধ্যে অন্যতম বাউল কবি লালন শাহের জন্মদিন আজ ১লা কার্তিক আজকের এই দিনে তিনি বর্তমান regwatches replica watches বাংলাদেশের যশোর জেলার ঝিনাইদহ মহকুমার হারিশপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।
যদিও লালন শাহের জন্ম তারিখ ও সাল এবং জাতি বা সম্প্রদায় নিয়ে অনেক মতভেদ আছে।কারো মতে তিনি ১৭৭২ সালে আবার কেউ কেউ কেউ বলেন ১৭৭৪ সালে তার জন্ম হয়।
লালন ফকিরের জীবন সম্পর্কে বিশদ বিবরণ পাওয়া যায় না। তার সবচেয়ে অবিকৃত তথ্যসুত্র তার নিজের রচিত অসংখ্য গান। লালনের কোন গানে তার জীবন সম্পর্কে কোন তথ্য দেয়া নেই বলে জানা যায়। এই প্রশ্ন তাঁর জীবদ্দশায়ও বিদ্যমান ছিল।
অধিকাংশ গবেষকের মতে লালন ছিলেন হিন্দু ঘরের সন্তান। তার পিতার নাম মাধব কর আর মায়ের নাম পদ্মাবতী। লালনের জন্ম হয়েছিল ১৭৭৪ সালে বর্তমান কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালি থানার চাপড়া ইউনিয়নের অন্তর্গত ভাড়ারা গ্রামের এক হিন্দু কায়স্থ পরিবারে।
লালনের প্রকৃত নাম ছিল ললিতনারায়ণ কর। ডাক নাম লালু। এই লালু থেকেই পরবর্তীকালে তার নাম হয় লালন—লালন সাঁই বা লালন ফকির। কেউ কেউ বলেন তার লালন সাঁই নামটি দিয়েছিলেন তার গুরু সিরাজ সাঁই। তবে নিশ্চিত করে কোনোকিছুই জানা নেই কারুরই।
জন্ম-অনাথ লালন বাবাকে চোখেই দেখেননি। জন্মের পাঁচ কি ছয় বছর বয়সে তার মায়েরও মৃত্যু হয়। এদেশের পিতৃমাতৃহীন গরিব ছেলেমেয়েদের জীবন যেভাবে কাটে, তেমনি হয়তো অবহেলা আর অনাদরে কোনো আত্মীয়ের আশ্রয়ে কেটেছিল লালনের শৈশব-কৈশোর।
যৌবনে লালন ভাড়ারা গ্রামের একদল তীর্থযাত্রীর সঙ্গে নবদ্বীপে যাত্রা করেন। পতিমধ্যে লালন বসন্তরোগে আক্রান্ত হলে সঙ্গীরা তাকে ফেলে রেখে চলে যায়। ওই অবস্থায় মৃত্যুপথযাত্রী লালনকে তুলে নিয়ে যান মলম কারিগর নামে ছেঁউড়িয়া গ্রামের জনৈক মুসলমান ব্যক্তি।
মলম শাহ এবং তার স্ত্রী মতিজান তাঁকে আশ্রয় দেন এবং সুস্থ করে তোলেন। মলম সাহ তাকে কুর’আন ও হাদিস শিক্ষা দেন এবং ধর্মীয় শিক্ষার জন্য ফকির সিরাজ সাঁই নামের একজন ফকিরের কাছে পাঠান। মলম কারিগর ছিলেন সিরাজ সাঁইয়ের শিষ্য।
এই মলম কারিগরই একদিন লালনকে নিয়ে যান সিরাজ সাঁইয়ের কাছে। তখন থেকেই লালন কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার ছেঁউড়িয়াতে একটি আখড়া তৈরি করেন, যেখানে তিনি তাঁর শিষ্যদের শিক্ষা দিতেন,যা মূলত ইসলাম ধর্মীয়।
তিনি একাধারে ফকির (বাঙালী মুসলমান সাধক), দার্শনিক, অসংখ্য অসাধারণ গানের গীতিকার, সুরকার ও গায়ক। মহাত্মা গান্ধীরও ২৫ বছর আগে, ভারত উপমহাদেশে সর্বপ্রথম, তাকে ‘মহাত্মা’ উপাধি দেয়া হয়েছিল।
১৮৯০ সালের ১৭ই অক্টোবর লালন ১১৬ বছর বয়সে কুষ্টিয়ার ছেউড়িয়াতে নিজ আখড়ায় মৃত্যুবরণ করেন। আজও সারা দেশ থেকে বাউলেরা অক্টোবর মাসে ছেউড়িয়ায় মিলিত হয়ে লালন শাহের প্রতি তাদের শ্রদ্ধা নিবেদন করে।
তাঁর মৃত্যুর ১২ দিন পর তৎকালীন পাক্ষিক পত্রিকা মীর মশাররফ হোসেন সম্পাদিত হিতকরীতে” প্রকাশিত একটি রচনায় সর্বপ্রথম তাঁকে “মহাত্মা” হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। রচনার লেখকের নাম রাইচরণ।
লালনের বেশ কিছু রচনাবলী থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে তিনি ধর্ম-গোত্র-বর্ণ-সম্প্রদায় সম্পর্কে অতীব সংবেদনশীল ছিলেন। ব্রিটিশ আমলে যখন হিন্দু ও মুসলিম মধ্যে জাতিগত বিভেধ-সংঘাত বাড়ছিল তখন লালন ছিলেন এর বিরূদ্ধে প্রতিবাদী কন্ঠস্বর।
তিনি মানুষে-মানুষে কোনও ভেদাভেদে বিশ্বাস করতেন না। লালনের প্রতিটি গানে তিনি নিজেকে ফকির ( আরবি “সাধু”) হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। তিনি ছিলেন মানবতাবাদী। একটি গানে তিনি বলেছেনঃ
“সব লোকে কয়
লালন কি জাত সংসারে।
লালন বলে জাতের কি রূপ
দেখলাম না তা-নজরে।।”
আরেকটি গানে লালন বলেছেন
জাত গেলো জাত গেলো বলে
“সব লোকে কয়, লালন ফকির হিন্দু কি যবন।
লালন বলে, আমার আমি না জানি সন্ধান।”
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেনঃ “লালন ফকির নামে একজন বাউল সাধক হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, জৈন ধর্মের সমন্বয় করে কী যেন একটা বলতে চেয়েছেন – আমাদের সবারই সেদিকেই মনোযোগ দেওয়া উচিৎ।” যদিও তিনি একবার লালন ‘ফকির’ বলেছেন,এরপরই তাকে আবার ‘বাউল’ বলেছেন, যেখানে বাউল এবং ফকিরের অর্থ পারস্পরিক সংঘর্ষপ্রবণ।”
লালন ফকিরের গান “লালন গীতি” বা কখনও “লালন সংগীত” হিসেবে প্রসিদ্ধ। বাউলদের জন্য তিনি যেসব গান রচনা করেন, তা কালে-কালে এত জনপ্রিয়তা লাভ করে যে মানুষ এর মুখে মুখে তা পুরো বাংলায় ছড়িয়ে পড়ে।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও লালনের গানে প্রভাবিত হয়েছিলেন। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে তাঁর প্রায় সহস্রাধিক গান সংগৃহীত হয়েছে। মুহম্মদ মনসুরউদ্দিন একাই তিন শতাধিক লালন গীতি সংগ্রহ করেছেন যা তাঁর হারামণি গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে।
রবীন্দ্রনাথ যখন শিলাইদহে জমিদারি দেখাশোনার দায়িত্ব নিয়ে আসেন, তখন আর লালন ফকির বেঁচে নেই। রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহে এসে লালনের সাক্ষাত্ না পেলেও তার গানের সন্ধান পেয়েছিলেন।
তিনি অনেক খোঁজাখুঁজি করে কোনো ভক্তের হাতের লেখা লালনের একটি গানের খাতা উদ্ধার করেছিলেন। সেখানে অনেকগুলো গান ছিল। এরপরও তিনি বহু ভক্ত-শিষ্যের কাছ থেকে লালনের আরও বহু গান সংগ্রহ করেছিলেন।
তারপর সেগুলো প্রকাশ করেছিলেন ‘প্রবাসী’ পত্রিকায়। এভাবেই লালনের গানের সঙ্গে প্রথম পরিচয় ঘটে সভ্যসমাজের মানুষের। কুষ্টিয়া জেলার সীমাবদ্ধ গণ্ডি ছাড়িয়ে লালনের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে সমগ্র বঙ্গদেশে।
লালনের গান রবীন্দ্রনাথকে দারুণভাবে আকৃষ্ট ও প্রভাবিত করেছিল। রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলি পর্বে (গীতাঞ্জলি, গীতালী, গীতিমাল্য ও খেয়াকাব্য) তার যে আধ্যাত্মিকতার ছাপ, সেক্ষেত্রে বৈষ্ণব সাহিত্য এবং উপনিষদের পাশাপাশি লালনের গানও তাকে সমানভাবে প্রভাবিত করেছিল।
লালন ছিলেন নিরক্ষর মানুষ অথচ তার গানের ভাব-ভাষা কী চমত্কার! আজও তার আবেদন এতটুকু কমেনি। সে আবেদন সদ্য প্রস্ফুটিত ফুলের মতোই। ১৮৯০ সালের ১৬ অক্টোবর আজকের এইদিনে ১১৬ বছর বয়সে এই মরমী ভাবসাধক মৃত্যুবরণ করেন।
ছেঁউড়িয়ার আখড়াতেই তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়। শীতকালে প্রতিবছর তার আখড়ায় বিশেষ উত্সব হতো। দেশের নানা জায়গা থেকে আসতো ভক্তরা, আসতো বাউলেরা। সেখানে কয়েকদিন ধরে বাউলেরা দলবেঁধে গান করতো।
এখানে অন্য কোনো গান হতো না, শুধু লালনগীতি। তবে লালনের খ্যাতি ও পরিচিতি থাকলেও তার জীবিতকাল পর্যন্ত তা ছিল সীমাবদ্ধ ক্ষুদ্র গণ্ডির মধ্যেই। শুধু কুষ্টিয়া এবং আশপাশের আরও কয়েকটি অঞ্চলের লোকজন কেবল তার নাম জানতো। সভ্যসমাজের লোকজন তার নাম জানতে পারে আরও অনেক পরে।
শিল্প-সাহিত্যাঙ্গনে তাকে প্রথম সম্মানের আসনে প্রতিষ্ঠিত করেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে অবশ্য লালনের সাক্ষাত্ হয়নি।
তবে রবীন্দ্রনাথের বড় ভাই জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সঙ্গে লালনের দেখা হয়েছিল। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ তখন শিলাইদহের জমিদারি দেখাশোনার দায়িত্বে ছিলেন। তার কাছেই রবীন্দ্রনাথ প্রথম লালন ফকিরের নাম শোনেন।
আজ লালন সাইয়ের জন্ম ও মৃত্যু দিবস। আজকের দিনে এই মহান ব্যাক্তিকে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা ও গভীর ভালোবাসা।