বই পড়িবেন নিজেকে বৃহৎ করিতে

0
294


হোসাইন মঈন

কেন বই পড়বেন? যদি এমনটা কারও মনোজিজ্ঞাসা হয়, তাহলে সোজাসাপ্টা উত্তর হলো,
‘বই পড়িবেন নিজেকে বৃহৎ করিতে।’ ভাবছেন, সেটা কি করে হয়! ধরুন, আপনি ক্ষুদ্র
নঘন্য একজন। কিন্তু বিশাল হয়ে ওঠার প্রচন্ড একটা আকাংখা আপনার মধ্যে রয়েছে। আর
আপনার এই আকাক্সক্ষাকে পূরণ করতে পারে বিশাল কিছু একটা। কেননা বিশালের মধ্যেই
নিহিত থাকে ক্ষুদ্রকে বিশাল করে তোলার অপরিসীম ক্ষমতা, এজন্য ক্ষুদ্রকে তাই বিশালের
সম্মুখীন হতে হয়। কারণ, বিশালের সম্মুখীন হলেই কেবল ক্ষুদ্রের বিশাল হওয়ার সকল
আকাক্সক্ষা পূরণ হতে শুরু করে। আর এই বিশালটা হচ্ছে বই। কেবল বইয়ের মধ্যেই নিহিত
রয়েছে মানুষের ব্যক্তিক, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে জীবন রাঙানো, জীবন
সাজানো এবং নিয়ন্ত্রিত ও ভারসাম্যপূর্ণ জীবন গঠনের সমস্ত উপায়-উপকরণ।

নিজেকে জানতে শেখায় বই, নিজেকে বুঝতে শেখায় বই, নিজেকে খুঁজতে ও বড় কিংবা বৃহৎ করে তুলতেও
শেখায় বই; বই আমাদের নানাভাবে জাগিয়ে তোলে। মোদ্দাকথা, জ্ঞান ও সত্যের আলোয় আলোকিত হয়ে
নিজেকে বিশুদ্ধ করে গড়ে তোলার মধ্যে দিয়ে উন্নত এক আমি গঠনে সহায়তা করে বই। মানুষের মননশীল,
সৃষ্টিশীল চিন্তার যাবতীয় সূচনার বিষ্ফোরণও একমাত্র বইয়ের মাধ্যমেই হতে পারে।
‘ভালো খাদ্যে যেমন পেট ভরে, ভালো বই তেমনি মানুষের আত্মাকে পরিতৃপ্ত করে।’ কথাটি সপ্তদশ শতকের
দার্শনিক ও বিখ্যাত কথাসাহিত্যিক বারুখ স্পিনোজা’র। সত্যিই তাই; পৃথিবীতে যাঁরা সফল হয়েছেন
তাঁদের বৃহৎ একটা অংশ বই পড়েছেন এবং নিয়মিত তাঁরা বই পড়েন। বই পড়ে পড়েই তাঁরা নিজেদের
দুর্বলতাকে চিহ্নিত করেছেন, ভেতরে আত্মবিশ্বাস তৈরি ও মজবুত করেছেন, সঠিক পরিকল্পনা সঠিক সময়ে
মাথায় আনতে পেরেছেন এবং সঠিক সময়ে যথোপযুক্ত পরিকল্পনার মাধ্যমে তা বাস্তবায়ন ঘটাতে সক্ষম হয়েছেন।
আর এভাবেই তাঁরা নিজেকে উন্নতির সোপানে তুলে ধরতে পেরেছেন। তাঁরা গভীরভাবে উপলব্ধি করে দেখেছেন
যে, বই পাঠ কল্পনাশক্তি ও সৃজনশীলতা বৃদ্ধি করে; একমাত্র বই-ই দেখাতে পারে জীবনে কোনো কিছুই অসম্ভব
নয়। পড়ার মাধ্যমেই অনেক জানা জিনিস বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে আবিষ্কার করা যায়; জানতে পারা যায়
কীভাবে আচরণের ভিন্নতায় ফলাফলেরও পরিবর্তন আসে। তাঁরা বলেন, ‘মানুষ যত বই পড়বে, তত বদলে যাবে তার
দেখার চোখ, তত বেড়ে যাবে তার বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা। বড় হতে হলে স্বপ্ন দেখতে হবে, আর স্বপ্ন দেখা এবং তা
পুরণের জন্য বই পড়ার গুরুত্ব অপরিসীম। কেননা জ্ঞান দানের পাশাপাশি বই মানুষের চিন্তাশক্তি বৃদ্ধি করে, যুক্তি ও
বুদ্ধির জাগরণ ঘটায়।’
বই হলো বিশাল মাকড়শার জাল, যা সবকিছুকেই একসূত্রে গেঁথে দেয়। আমাদের জানা বিষয়ের সঙ্গে অজানা
বিষয়গুলোকে জোড়া লাগিয়ে নতুন এক উত্তর কিংবা সমাধান আমাদের সম্মুখে উন্মোচন করে দেয়। বই পড়ার
মধ্যে দিয়েই আমরা নতুন কোনো বিষয়, নতুন কোনো তথ্য, সমস্যার নতুন কোনো সমাধান, নতুন কিছু
অর্জন ও নতুন কোনো মাধ্যম আবিষ্কার করতে পারি। কে জানে হয়তো বই পড়ার সুবাধে আপনার পছন্দের
তালিকায় নতুন কোনো শখ কিংবা পেশা যুক্ত হয়ে যেতে পারে এবং সেই পেশা আপনি বেছে নিয়েছেন আর
সফলতা অর্জন করেছেন। অন্বেষণের শুরুও কিন্তু বই পড়া এবং তার উপলব্ধির মাধ্যমেই। বলা হয়ে থাকে, যখনই আপনি
একটি ভালো বই পড়েন, বিশ্বের কোথাও না কোথাও একটি দরজা খুলে যায়, যাতে আরও আলো আসে, যে আলো
তেজোদ্দীপ্ত সূর্যের মতো স্ব-মহিমায় উদ্ভাসিত।
আমাদের জীবনের অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্র হচ্ছে যোগাযোগ। সমাজে চলতে গেলে যোগাযোগের
কোনো বিকল্প নেই। বই পড়া একদিকে যেমন মানুষের জ্ঞানের পরিধি বিস্তার করবে, তেমনি অন্যদিকে এটি
মানুষকে একজন ভালো সংবাদদাতা হতেও সহায়তা করে। এই মন্ত্রটির যথার্থ প্রয়োগ ঘটানো সম্ভব হয় কেবল
বই পড়ার মাধ্যমেই। যারা বই পড়ে তারা খুব সহজেই অন্যের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারে। তারা জানে
কোন পরিস্থিতিতে কী ধরনের কথা বলতে হয়। শুধু তাই নয়, যারা বই পড়ে তারা অনেক বেশি সচেতন বই না পড়া
মানুষের চেয়ে। তার চেয়ে বড় কথা হলো যারা কিছুই জানে না, তাদের আসলে অন্যকে বলার মতো কিছু থাকেও
না।
বইপাঠ আমাদের শব্দভাÐার বৃদ্ধিতে জোরালো ভূমিকা রাখে। যত বেশি বই পড়া হবে, তত বেশি আমাদের
শব্দভাÐারে নতুন নতুন শব্দ যোগ হতে থাকবে। একসময় লক্ষ্য করলে দেখবেন যে, আপনি আপনার বিভিন্ন
কথাবার্তা বা লেখালেখিতে প্রায়ই এই শব্দগুলো ব্যবহার করছেন। এসব বৈচিত্র্যপূর্ণ শব্দ ব্যবহার করে আপনি খুব
সহজেই এবং স্পষ্টভাবে নিজেকে অন্যের কাছে তুলে ধরতে সক্ষম হচ্ছেন। নিজেকে স্পষ্টভাবে তুলে ধরতে বা
প্রকাশ করতে পারাটা আপনার চাকরি কিংবা ব্যক্তিগত জীবনে কী পরিমাণ যে সহায়ক হবে, তা নিশ্চয়ই আপনার
অজানা নয়। এমনকি এটি আপনার আত্মবিশ্বাস জোগাতেও অনেক সাহায্য করবে। নতুন কোনো ভাষা শিখতেও
বই পড়ার কোনো বিকল্প নেই; এটি মানুষকে খুবই দ্রæত নতুন কোনো ভাষা আয়ত্ব করতে সহায়তা করবে।

লিখুন প্রতিধ্বনিতেলিখুন প্রতিধ্বনিতে

অন্য সব সাধারণ মানুষের চেয়ে আলাদা হয়ে বড় হতে শেখায় বই। যারা বই পড়ে তারা অন্য রকম মানুষ, তারা
মানুষের মতো মানুষ। কারণ, বই একজন মানুষের মনোজাগতিক পরিবর্তনে ব্যাপক সাহায্য করে। বই থেকে
মানুষ পায় জীবন গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা। এই যে নিজেদের আমরা মানুষ বলি, নিজেদের
আমরা মানুষ ভাবি, এটা হলো জৈবিক মানুষ। কিন্তু এই পরিচয়কে অতিক্রম করে আত্মিকভাবে মানুষ হয়ে উঠতে
গেলে নৈতিকতা, মানবিক মূল্যবোধ ও সৎ মানসিকতাসম্পন্ন হয়ে উঠার পাশাপাশি নানামুখী লোভ, রিপু,
রিয়া, দ্বম্ভ-অহম থেকে নিজেকে মুক্ত হতে হয়। বই এসব বদগুণ থেকে নিজেকে পরিশুদ্ধ করার উপায় খুঁজে দেয়
এবং পরিশুদ্ধ করে তোলে। বই মানুষের মনের মধ্যে এমন এক নির্মোহ ভাবের জন্ম দেয়, তাতে সকল প্রকার রিপু-
রিয়া তথা দ্বম্ভ-অহম, লোভ-লালসা, হিংসা-বিদ্বেষের অনেক ঊর্ধ্বে থাকেন তিনি। বই মানুষকে সহানুভূতিশীল
করে তোলে, দান করে সুশৃঙ্খল জীবন। পরীক্ষা দ্বারা প্রমাণিত যে, যারা নিয়মিত বই পড়ে, তারা উদারমনা হন। আর
একজন উদারমনা মানুষ যে সর্বজন-শ্রদ্ধেয়, এটা নিশ্চয়ই কারও অজানা নয়?
বই মানুষকে বাস্তবতার নানাবিধ কঠিন জটিলতা থেকে রেহাই দেওয়ার পাশাপাশি মানুষকে আত্মবিশ্বাস
জোগাতেও অনেক সাহায্য করে। বই মানুষের সামাজিক যোগাযোগ-দক্ষতা, শব্দভাÐার, চিন্তা করার ক্ষমতা,
বিশ্লেষণী জ্ঞান, আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা, মনোযোগ ধরে রাখা, যেকোনো বিষয় নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করা এবং
জ্ঞানের কাছাকাছি থাকার ক্ষমতা বাড়িয়ে তোলে বহুগুণ। আর এসব বৈচিত্র্যপূর্ণ শব্দ ও গুণগুলো ব্যবহার করে একজন
মানুষ চাকরি, ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে খুব সহজেই এবং স্পষ্টভাবে নিজেকে অন্যের কাছে তুলে ধরতে বা
প্রকাশ করতে সক্ষম হন। উদ্যোক্তা হওয়া, বিসিএস প্রস্তুতি, ভালো লেখক কিংবা ভালো শিক্ষক হতে চাইলে,
বিদেশে পড়তে গেলে, গবেষণায়, বিভিন্ন চাকরি ও ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়াসহ আরও যত আঙ্গিক থেকেই
চিন্তা করা হোক না কেন, নানামুখী লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সাধনে কিংবা সফল হতে চাইলে সবার আগে প্রয়োজন
উদ্ভাবনী চিন্তা আর সৃজনশীলতা। বই পড়ার অভ্যাস মানুষকে এই গুণ দুটি রপ্ত করতে সাহায্য করে। তাই বই পড়ার
অভ্যাস থাকা ও বইয়ের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখাটা খুবই জরুরি।
একজন মানুষ যে কাজই করুক না কেন, তাতে সেরাটা করতে পারার ক্ষমতা লাভ করে সে বই থেকে। বই পড়লে
অন্যের সমীহ অর্জনের অতি চমৎকার গুণাবলী অর্জিত হয়, অর্জিত হয় সব সময় শতধাপ এগিয়ে থাকার ক্ষমতা।
বই মানুষকে এমন এক স্মার্টনেস উপহার দেয়, বিশ্বসেরা ডিজাইনারের পোশাকও তা কখনো কাউকে দিতে
পারে না।
জীবনকে সুন্দর, সুশোভিত ও সাচ্ছন্দ্যময় করে তোলে বই; এর ফলে আমরা অমরত্ব লাভ করতে পারি। কেননা সুন্দর ও
মহত্তের কোনো মৃত্যু নেই। ‘পৃথিবীতে একজনকে আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার যতগুলো উপায় আছে,
তন্মধ্যে সবচেয়ে সহজ আর চমকপ্রদ উপায় হলো বই পড়া। পৃথিবীতে বই পড়ে এখনও কেউ নষ্ট হয়নি, কিন্তু বই
না পড়ে পুরোপুরি অপদার্থ হয়ে গেছে সেরকম অসংখ্য উদাহরণ চারপাশে আছে।’ বলেছেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও
প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও লেখক ড. জাফর ইকবাল।
একজন বিদগ্ধ কিংবা সফল মানুষদের অভিজ্ঞতা থেকে জ্ঞানার্জন করতে চান? এর একটি সহজতম উপায় হচ্ছে
বই পড়া। আপনি বইয়ে যা পড়ছেন তা মূলত কারও বিশেষ জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা থেকেই লেখা; এই অর্জিত জ্ঞানই
আপনাকে ত্বরান্বিত করবে একটি বিশেষ লক্ষ্যের দিকে। বই সঠিক পথ অবলম্বন করার উপদেশ দেয়, জীবনের ভুলগুলোকে
চিহ্নিত করে দেয়; জীবনের নানাবিধ ব্যর্থতা থেকে উত্ধসঢ়;রে ওপরে ওঠার বিভিন্ন উপদেশ দেয়। বই পড়লেই জানা
যায় কোন পথে গেলে সফলতা নিশ্চিত, জীবনে কমে আসে ভুলের সম্ভাবনাসমূহ। বইয়ের মাঝেই নিহিত থাকে
ব্যর্থতাকে সফলতায় রূপান্তর করে সগৌরবে সম্মুখে এগিয়ে যাবার মন্ত্র। বহুযুগ ধরে যে কথাটি প্রমাণিত
সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত, তা হলোÑ যে যত বেশি জানে সে তত বেশি সমৃদ্ধ, সে তত বেশি শক্তিশালী। অর্থাৎ
যে তার জ্ঞানের পরিধিকে বড় করলো, সে আসলে তার যোগ্যতা ও ক্ষমতার পরিসরকে বিস্তার করলো।
জীবন খুবই ছোট. তাই ভুলের পুনরাবৃত্তি না করে সফল এবং জ্ঞানীদের একজন হতে চাইলে শিক্ষা নিতে হবে।
শিক্ষা নেওয়াটা সকলের জন্য অতি আবশ্যক। আর সেজন্য বইয়ের দ্বারস্থ হতে হবে। কারণ, ক্ষুদ্রকে বৃহৎ হয়ে উঠতে
শেখায় বই। দেশের-বিশ্বের যত বড় বড় জ্ঞানী-মনীষী, খ্যাতিমান কিংবা বিখ্যাত মানুষের নাম আপনি শুনে
থাকবেন, দেখবেন তাঁদের জীবনের অনেকটা অংশ জুড়েই রয়েছে বই। অতএব, বই পড়িবেন নিজেকে বৃহৎ
করিতে।
লেখক: শিক্ষা সাহিত্য ও সংবাদকর্মী।

Previous articleশ্মশান নগর
Next articleছন্দের কথা 
প্রতিধ্বনি
প্রতিধ্বনি একটি অনলাইন ম্যাগাজিন। শিল্প,সাহিত্য,রাজনীতি,অর্থনীতি,ইতিহাস ঐতিহ্য সহ নানা বিষয়ে বিভিন্ন প্রজন্ম কী ভাবছে তা এখানে প্রকাশ করা হয়। নবীন প্রবীণ লেখকদের কাছে প্রতিধ্বনি একটি দারুণ প্ল্যাটফর্ম রুপে আবির্ভূত হয়েছে। সব বয়সী লেখক ও পাঠকদের জন্য নানা ভাবে প্রতিধ্বনি প্রতিনিয়ত কাজ করে চলেছে। অনেক প্রতিভাবান লেখক আড়ালেই থেকে যায় তাদের লেখা প্রকাশের প্ল্যাটফর্মের অভাবে। আমরা সেই সব প্রতিভাবান লেখকদের লেখা সবার সামনে তুলে ধরতে চাই। আমরা চাই ন্যায়সঙ্গত প্রতিটি বিষয় দ্বিধাহীনচিত্ত্বে তুলে ধরতে। আপনিও যদি একজন সাহসী কলম সৈনিক হয়ে থাকেন তবে আপনাকে স্বাগতম। প্রতিধ্বনিতে যুক্ত হয়ে আওয়াজ তুলুন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here