যখন ছোট ছিলাম, টিভি চ্যানেল ছিলো একটাই- বিটিভি৷ সেই একই জিনিস দিনভর দেখতে দেখতে মুখস্ত হয়ে গিয়েছিল বিজ্ঞাপনের নানা জিঙ্গেলও৷ এখন মনে পড়ে, পড়াশোনা শুরু করার পর বাবা বিশাল একটা হরলিকসের বয়াম নিয়ে এলেন, বুদ্ধি বাড়াতে৷
আমার আশেপাশের অনেক মানুষকেই দেখেছি জীবনে কখনও হরলিকস না খাওয়ার পরও আমার চেয়ে টলার, স্ট্রংগ্রার এবং শার্পার হয়েছেন৷ আমার বুদ্ধি যে খুব একটা বাড়েনি, সেটা জীবনের নানা অভিজ্ঞতা থেকে ভালোই উপলব্ধি করতে পেরেছি৷ হরলিকস না খেলেও যে এর চেয়ে কম বুদ্ধি হতে পারতো, তা মনে হয় না৷
মায়ের মুখে শুনেছি, আমার সবচেয়ে পছন্দ ছিল চান্দা ব্যাটারির বিজ্ঞাপন৷ অনেক ছোট ছিলাম, বোঝার বয়স ছিল না৷ তাই যখনই ব্যাটারির বিজ্ঞাপন দেখাতো, টিভির সামনে গিয়ে নাচতে শুরু করতাম, ‘‘তান্দা তান্দা’ বলে৷ এরপর বাসায় ব্যাটারির কোনো প্রয়োজন না থাকলেও নাকি রীতিমতো শিশুসুলভ চাপ প্রয়োগ করে, কান্নাকাটির ভয় দেখিয়ে সেই ‘তান্দা’ ব্যাটারি বাবাকে দিয়ে কিনে আনিয়েছিলাম৷
এ তো গেলো শিশুদের কথা৷ বড়দের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা কেমন হয়? কোন পণ্যটা ভালো, কোনটা খারাপ, আমরা কীভাবে নির্ধারণ করি? বিজ্ঞাপন আমাদের কী শেখায়, এর কতোটুকু আমরা বিশ্বাস করি?
এ প্রসঙ্গে একটা গল্পের কথা মনে পড়ছে৷ সত্যি মিথ্যে জানি না৷ কিন্তু আমার ধারণা, এটা গল্প হলেও বাস্তবেই ঠিক এমনটাই ঘটে থাকে৷ গল্পটা এমন:
মার্কেটিং ক্লাসে শিক্ষক একবার ছাত্রদের অ্যাসাইনমেন্ট দিলেন, টুথপেস্টের দাম না কমিয়ে, পরিমাণ একই রেখে, বিজ্ঞাপনে খরচ না করে টুথপেস্টের বিক্রি বাড়াতে হবে৷
কয়েকদিন পর, অনেক গবেষণা করে নানা ধরনের পদ্ধতি কাগজে লিখে জমা দিলেন শিক্ষার্থীরা৷ তবে কেউই বাড়তি খরচ ছাড়া বিক্রি বাড়ানোর কোনো উপায় বাতলাতে পারলেন না৷
শিক্ষক দেখালেন, কিছু না করে, শুধু টুথপেস্টের টিউব তৈরির সময় যদি মুখটা একটু বড় করে দেয়া যায়, তাহলেই বিক্রি বেড়ে যায় প্রায় ২০ শতাংশ৷ যুক্তি হিসেবে তিনি দেখিয়েছিলেন, বিজ্ঞাপন দেখে দেখে মানুষের অভ্যস্ততা হলো টুথব্রাশের পুরোটা জুড়ে পেস্ট নেয়া৷ কিন্তু বিজ্ঞাপনে যে পরিমাণ পুরু করে পেস্ট নেয়া দেখানো হয়, চালাকি করে ভোক্তারা তারচেয়ে কম পুরুত্বের পেস্ট ব্যবহার করেন৷ কিন্তু যদি টিউবের মুখের ব্যাস অল্প বাড়িয়ে দেয়া যায়, তাহলে টিউবে সমান চাপ দিলে পেস্ট বের হবে বেশি৷ ফলে খরচও হবে বেশি৷ আগে যে পেস্ট চলতো এক মাস, নতুন টিউব চলবে ২৫ দিন৷ ফলে বাড়বে টুথপেস্টের বিক্রি৷
বিজ্ঞাপন ছাড়া আমরা জানতে পারি না, কোন পণ্য ভালো, কোনটা খারাপ৷ কিন্তু সেই বিজ্ঞাপনই আবার আমাদের নিজেদের পণ্য গছিয়ে দেয়ার জন্য গালভরা মিথ্যা প্রলোভনও দেখিয়ে থাকে৷ আমরা বিশ্বাস করতে না চাইলেও, মনস্তত্ত্বের কারণে শেষ পর্যন্ত তাতে প্রাভাবিত হয়ে যাই৷
আমাদের কাছে তখন মনে হয় কালো মেয়েদের যেহেতু ভালো বর পাওয়া যাবে না, ফেয়ার অ্যান্ড লাভলি দিয়ে তাকে ফরসা বানিয়ে বিয়ে দিতে হবে৷ সেই কালো মেয়ে সাত দিনে ফর্সা হওয়ার আশায় এই ফেয়ারনেস ক্রিম মেখে, প্রতিদিন একবার আয়নার দিকে তাকিয়ে পরে হাল ছেড়ে দেয়৷ এরপর একসময় গরীবের মেয়ে ভালো কোম্পানির ট্যালকম পাউডার, আর বড় লোকের মেয়ে ম্যাক কোম্পানির মেকআপ মেখে মুখ চুনকাম করে বিয়ে করে ফেলে৷
ছেলেরাও গন্ধ যাই হোক, ব্যবহার করা চাই সবচেয়ে ভালো ব্র্যান্ডের পারফিউম৷ শেভ করার জন্য ক্রিম যথেষ্ট হলেও ‘ম্যানলি এবং মাচো’ ভাব আনার জন্য জিলেটের ‘কুল’ জেল, ‘ম্যাক থ্রি’ রেজর আর ব্লেড ব্যবহার করতে হয়৷
বিজ্ঞাপনের কারণেই আমরা এখনও বিশ্বাস করি কোকাকোলা ‘জিরো’তে আসলে কোনো চিনি নেই৷ অথবা, বাজারের বিভিন্ন ফ্রুট জুসে আসলেই ফ্রুট আছে, কোনো কৃত্রিম খাদ্যদ্রব্য নেই৷
২০০৯ সালে ভারতে ঘটেছিল মজার এক ঘটনা৷ বৈভব বেদী নামের ২৬ বছরের এক যুবক আদালতে মামলা করে দেন বিখ্যাত ডিওডরেন্ট ব্র্যান্ড ‘এইক্স’-এর বিরুদ্ধে৷ তাঁর অভিযোগ ছিল, এইক্স-এর বিজ্ঞাপনে দেখা হয়, কোনো এক পুরুষ গায়ে এই ব্র্যান্ডের বডি স্প্রে দেয়ার পর অর্ধনগ্ন নারীরা ছুটে আসেন৷
কিন্তু বৈভবের অভিযোগ, সাত বছর ধরে তিনি এইক্স ব্যবহার করছেন, কিন্তু তার কোনো বান্ধবীই নেই৷
শেষ পর্যন্ত সে মামলার ফল কী হয়েছে, জানি না৷ কিন্তু দিনের পর দিন হরলিকস খাওয়ার পরও আমার যে বুদ্ধি অন্যদের চেয়ে তেমন একটা বাড়েনি, এজন্য কি একটা মামলা করা উচিত?
–অনুপম দেব কানুনজ্ঞ, ডয়চে ভেলে