আইনুন নাঈমা
আমার পড়ার টেবিলের জানালা দিয়ে মাঠ ঘাট পেরিয়ে দূরের পাহাড় দেখা যায়। অল্প দূরে মালিনী খালের পাড়ে সাদা বকের উড়াউড়ি আর দুরন্ত হাঁসের জলকেলিও চোখে পড়ে। এই অপ্রশস্ত খালে উপজাতি পুরুষেরা দল বেঁধে আসেন কুইচ্চা মাছ শিকার করতে। জানালার পাশে আরো একটি বিশেষ জিনিস আছে -সেটা হলো দৈত্যাকার আম গাছ। এইবার বর্ষায় গাছে বাসা বেঁধেছে মৌমাছি। রানী মৌমাছির নির্দেশে কর্মী মৌমাছিরা সর্বদা মধু আহরণে ব্যস্ত। গাছের নিচেই গোবর ডোবা। বর্ষাকালে গোবর ফোলে ফেঁপে উঠে। সেখানে জন্ম নেয় বুনো মাশরুম। শীতকালে ডোবা শুকিয়ে যায়। তখন সফুর চাচা ধনুকের মতো পিঠ বাঁকিয়ে গোবর সার সবজি খেতে সরবরাহ করেন। আষাঢ়ের শুরুতে বিলু ভাইয়া এলেন অস্ট্রেলিয়া থেকে। মাথা তার সাহারা মরুভূমি। নিউরন উর্বর করতে গিয়ে তিনি মাথার স্কিন ঊষর করে ফেলেছেন। দাদির দেয়া বিশেষ উপহার – কাশ্মীরি তৈল ,দিনে দু বেলা নিয়ম করে মাথায় মাখেন। টাক টুকু ঢাকবার চেষ্টায় অবশিষ্ট চুল গুলো সরিষার খড়ের মতো বিছিয়ে রাখেন। একদিন ঘুরতে ঘুরতে আম গাছের তলায় গিয়ে চিৎকার চেঁচামিচি শুরু করলেন। আমি তখন বহিপীর নাটকের খোদেজার পার্ট রপ্ত করছিলাম। অবস্থা আন্দাজ করার জন্য জানালা দিয়ে উঁকি দিলাম -মৌচাকের দিকে তাকিয়ে পিউর হানি পিউর হানি বলে লাফাচ্ছে।এমন ভাবে লাফাচ্ছেন -যেন দ্বিতীয় আমেরিকা আবিষ্কার করেছেন! কান্ড দেখে মিটিমিটি হাসছি। ভাইয়া ভৎসনার সহিত ধমক দিলেন -হাসছিস কেন ?বাবার ছুরিটা আন দেখি
হৈ হৈ করে ছুটলাম -বার্তা পেশ করলাম উঠোনে। মধু সংগ্রহের কথা শুনে আবাল বৃদ্ধ জনতা জড়ো হলো গাছের নিচে। কোনো জনতাই খালি হাতে আসে নাই। সবার হাতে ঘটি বাটি। বাকবিতণ্ড শুরু হয়ে গেলো মধু ভাগাভাগি নিয়ে। বড় ভাবি পানের পিক ফেলে বললেন -ও বিলু আমায় একটু বেশি করে দিস,মিতুলের সর্দি জ্বর,ডাক্তার তুলসী পাতার সাথে মধু খেতে বলেছে।
আমি মিতুলের দিকে তাকালাম-মেয়েটা দু দিন থেকে নাকের নুনতা মধু গিলছে। ভাইয়া হাতে পায়ে মোজা পরে নিলেন। গায়ে মোটা শীতের কাপড় ,তার উপর পাটের বস্তা -কি বিদঘুটেই না দেখাচ্ছে ! এত পোশাকেও স্বস্তি পাচ্ছেন না তিনি।
-ইমা দৌড় দিয়ে আমার রেইন কোর্ট টা আনতো
খোঁজাখোঁজি করে রেইন কোর্ট টা এনে দিলাম তাকে। পাটের বস্তার উপর কোর্ট পড়ে মাথাটা ঢেকে নিলেন জাল দিয়ে। পেটে যতো দু আ দরূদ আছে সব আউড়ে ফু দিলেন গাছে -তরতর করে উঠে গেলেন মগ ডালে। লাঠি দিয়ে দিলেন খোঁচা।ভুঁ ভুঁ শব্দে ভরে গেলো চারপাশ -যেন মেঘ ফোঁড়ে প্লেন যাচ্ছে। ফোঁটা ফোঁটা মধু পড়ছে। বড় ভাবি বাটি ধরলেন নিচে। চাকু দিয়ে চাক কাটার আগেই ভাইয়া চোখ মুখ কচলে ধপাস করে পড়ে গেলেন গোবর ডোবায়।
বড় ভাবি বাটি ফেলে বাবা গো মা গো বলে ছুটলেন তাল পুকুরের দিকে।
আমিও ‘পা -লা-ও -ও ‘বলে ছুটলাম ঘরের দিকে। দরজা জানালা এঁটে মশারি খাটিয়ে শুয়ে পড়লাম।মিনিট পাঁচেক পর জানালা খোলে উঁকি দিলাম। দেখি -গোবর ডোবায় বিলু ভাইয়া কোনো রকমে নাক বের করে দাঁড়িয়ে আছেন। অজস্র মাশরুমের আড়ালে তাকে ঠাহর করা মুশকিল। তার টাক মাথাটা ব্যাঙেরা দ্বীপ মনে করে
সেখানে বসে মনের সুখে বর্ষা সংগীত সাধনা করছে। একটু পরেই ডোবা হতে উঠে মালিনী খালের দিকে দিলেন দৌড়।সফুর চাচা গরু দিয়ে জমিতে মই দিচ্ছিলেন। ভাইয়ার দৌড়ানি দেখে গরু জোড়া ঘাবড়ে গেলো। তাড়া খেয়ে ভাইয়ার আগে আগে ছুটলো মালিনী খালের দিকে। সফুর চাচা চিৎপটাং হয়ে পড়ে গেলেন কাদায়। পুরু শরীল কাদায় মাখামাখি হয়ে গেলো। বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যা নামার আগে আগে ভাইয়া ফিরলেন বড় চাচার সাথে। বড় চাচা যা বর্ণনা করলেন তার জন্য আমরা মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। তিনি খাল পেরিয়ে হাটে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ দেখতে পান কয়েক জন উপজাতি পুরুষ ভাইয়া কে জোর পূর্বক বেঁধে নিয়ে যাচ্ছেন। তিনি বাঁচার জন্য হাত পা ছুড়াছুড়ি করছেন। গলা দিয়ে চিঁচিঁ শব্দ বেরুচ্ছে। ওরা নাকি ভেবে নিয়েছে তাদের জাতের কেউ কুইচ্চা শিকার করতে এসে অজ্ঞান হয়ে পানিতে পরে গেছে। এমনই বীভৎস হয়েছে চেহারা -দেখে কে বলবে এ আমার সমতলের টেকো ভাই ?