প্রকৃতির লীলা বৈচিত্র্য সবুজ শ্যামল বাংলাদেশ। বিশ্বের সকল দেশের রাণী স্বরূপ অপরূপ শোভা মণ্ডিত আমাদের এ বাংলাদেশ। অপূর্ব সমারোহ নদী আর পর্বতের। বৃক্ষে ভরপুর পাহাড়ে ঘেরা সবুজ বেষ্টনীই সমস্ত প্রাণি জগতের একমাত্র আশ্রয়। এক সময় ছিল বাংলার প্রকৃতি শুধু সবুজ আর সবুজ। সবুজ বনাঞ্চল নিয়ে লেখকের কোনো লেখা, কবির কবিতা, শিল্পির তুলির আঁচড়ে আঁকা ছবি আর চোখে পড়ে না। প্রয়োজনের তাগিদে এমনভাবে বেড়ে গেছে বৃক্ষ নিধনের পালা, আর থামতে চায় না। সৌন্দর্য্যের লীলা নিকেতন বনভূমির বৃক্ষ অবাধে কর্তন করা হচ্ছে প্রতিনিয়ত। চারিদিকে হাহাকার বৃক্ষশূন্য পাহাড়গুলো যেন বিলীন হওয়ার জন্য প্রহর গুনছে। যে পরিমাণ বনভূমি থাকার কথা তাও আজ নেই, তাই এত দুর্দশা আমাদের। খরা,বন্যা,জলোচ্ছাস,অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টিতে জনজীবন দুর্বিসহ হয়ে উঠছে । চাহিদার তুলনায় বৃক্ষরাজি অভাব দেখা দিয়েছে। ব্যাপক বৃক্ষ নিধনের ফলে ঘর -বাড়ি,নৌকার কাঠ,আসবাবপত্র নির্মাণের প্রয়োজনীয় বৃক্ষের অভাব দেখা দিয়েছে। ইতিমধ্যে ফলজ ও ভেষজ উদ্ভিদেরও অভাব দেখা দিয়েছে। শরীরের পুষ্টি সাধনে ফলজ উদ্ভিদ ও রোগমুক্তির জন্য ভেষজ উদ্ভিদের গুরুত্ব অপরিসীম। এ ছাড়াও পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখতে সবুজ বনাঞ্চল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
প্রয়োজনের তুলনায় আমাদের দেশের বনভূমি নিতান্তই অপ্রতুল। প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় রাখতে হলে দেশের মোট ভূ-ভাগের নুন্যতম ২৫ শতাংশ পরিমাণ বন এলাকা থাকা প্রয়োজন। কিন্তু বাংলাদেশে বন এলাকা রয়েছে মাত্র ৮ শতাংশ। তাও প্রতি ঘন্টায় ৪.২ হেক্টর বনভূমি চিরবিলীন হয়ে যাচ্ছে মানুষের প্রয়োজনে। এভাবে চলতে থাকলে আগামী ২৫ বছরে বাংলাদেশ পরিণত হবে বনহীন মরুভূমিতে। বর্তমান বাংলাদেশের মোট এলাকার ৬ শতাংশ অর্থাৎ ৭ লাখ ৬৯ হাজার হেক্টর জমিতে রয়েছে বনভূমি। পারিবেশিক ভারসাম্য রক্ষা করতে এ বনভূমি যথেষ্ট নয়। অস্বাভাবিক জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে চাহিদা মেটাতে নানাভাবে দেশের বৃক্ষ সম্পদ তথা ফলজ ও ভেষজ উদ্ভিদ দ্রুত বিলীন হয়ে যাচ্ছে।
সুস্থ শরীরের জন্য ফলজ ভেষজ উদ্ভিদের গুরুত্ব অপরিসীম। কেননা সুস্থ থাকা ও রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য একজন ব্যাক্তিকে প্রতিনিয়ত ১০০ গ্রাম ফল খেতে হয়। শরীরের রোগ প্রতিরোধ ও প্রয়োজনীয় পুষ্টি যোগাতে ফলের অবদান অনস্বীকার্য। এসব ফল ঋতু ভিত্তিক ফলজ বৃক্ষ থেকে আসে। চাহিদা অনুযায়ী ফলজ বাগান বা বৃক্ষ সৃজন না হওয়ায় আমাদের দেশে প্রয়োজনীয় ফলের অভাব দেখা দিয়েছে। যে সব ফল অন্য দেশ থেকে আমাদানি করা হয় তাও মধ্যবিত্ত ও দরিদ্রদের ক্রয়সীমার বাইরে। ফলে এদেশের অধিকাংশ মানুষ বঞ্চিত হচ্ছে প্রয়োজনীয় ফল থেকে। বর্তমানে যে সব ফলজ বাগান করা হচ্ছে তাতে কৃত্রিম সার প্রয়োগ ও বৈজ্ঞানিক উপায়ে ফলন বৃদ্ধি করা হচ্ছে। এসব ফলে রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করার ফলে বাড়ছে স্বাস্থ্য ঝুঁকি।
কৃত্রিম ভাবে উৎপাদিত ফলে প্রয়োজনীয় পুষ্টি না থাকায় পুষ্টিহীনতার শিকার হচ্ছে সাধারণ মানুষ। আবার এসব ফলে ক্যালসিয়াম কার্বাইড সহ বিভিন্ন ধরনের ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ মিশিয়ে অকালে পাকানো হচ্ছে ফল। এ ছাড়াও পঁচন রোধক ফরমালডিহাইড ব্যবহার করে বিক্রয় করা হচ্ছে বিভিন্ন রকমের ফল। এতে বিভিন্ন ধরণের জটিল রোগ-ব্যাধি সৃষ্টি হচ্ছে। জনসংখ্যা অস্বাভাবিক বৃদ্ধির ফলে প্রতিনিয়ত ঘর-বাড়ি ,আসবাবপত্র, নৌকা তৈরি করার জন্য ধ্বংস করা হচ্ছে বনজ সম্পদ। যে হারে বৃক্ষ নিধন করা হচ্ছে সে হারে বৃক্ষের চারা রোপন করা হচ্ছে না। ফলে সমতা বিধান না হওয়ার দরুন দ্রুত পরিবেশ বিনষ্ট হচ্ছে। পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার মূল কারণ বনাঞ্চল ধ্বংস। বর্তমানে বৈশ্বিক জলবায়ুর পরিবর্তন পরিলক্ষিত হচ্ছে। বৈশ্বিক উষ্ণতায় ছয় ঋতুর দেশ বাংলাদেশে এখন ছয় ঋতুর বৈশিষ্ট্য নেই। প্রতি দুই মাস নিয়ে ঋতু হলেও শীত,গ্রীষ্ম,বর্ষা ছাড়া বাকী তিন ঋতু দৃষ্টিগোচর হয় না।
খরা,বন্যা,জলোচ্ছ্বাস, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগের একমাত্র কারণ বনাঞ্চল ধ্বংস। জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে ব্যাপক নিত্য পণ্যের চাহিদাও বেড়ে গেছে। এসব ভোগ্য পণ্যের উৎপাদনের উৎস মূলত উদ্ভিদ থেকে।
প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য বজায় না থাকায় বর্তমানে বিভিন্ন প্রজাতির পশুপাখি যেমন-বুনোমহিষ,নীলগাই, লালশির হাঁস, ময়ূর,ঘুঘু ইত্যাদি বিলুপ্তির পথে। বনাঞ্চল আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ তা বলার অপেক্ষা রাখে না। অবাধে বৃক্ষ নিধনে একদিকে যেমন প্রাকৃতিক পরিবেশ মারাত্বক হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে, তেমনি ঘর-বাড়ি নির্মাণে বৃক্ষের অভাব দেখা দিয়েছে।
এদিকে চিকিৎসা বিজ্ঞানে ভেষজ উদ্ভিদ অন্যতম স্থান দখল করে আছে। চিকিৎসা ও ঔষধ শিল্পে ঔষধ প্রস্তুতির কাজে ব্যবহার করা পৃথিবীতে এমন অসংখ্য উদ্ভিদ ও লতা গুল্ম রয়েছে। বাংলাদেশের ঔষধ শিল্পে ঔষধ প্রস্তুতির কাজে ব্যবহার উপযোগি গাছ ও লতাগুল্ম রয়েছে প্রায় ৫’শ প্রজাতির। এসবের মধ্যে প্রায় ২৭ প্রজাতির উদ্ভিদ লুপ্ত হতে চলছে।
সর্পগন্ধা,কালোমেঘ,সোমরাজ,বহেড়া,চালমুগড়া ও বিষাঙ্গুলি ইত্যাদি ভেষজ উদ্ভিদ বিলুপ্তির পথে।
দেশে বর্তমানে প্রায় ২৬৬টি ইউনানী,২০৬টি আয়ুর্বেদিক, ৩২টি হার্বাল ও ৭৯টি হোমিওপ্যাথিক ঔষধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠান বছরে প্রায় ৫শ কোটি টাকার ভেষজ ঔষধ উৎপাদনে যোগান দিচ্ছে উদ্ভিদ জগৎ। সুতরাং আমাদের জীবন রক্ষায়ও বৃক্ষের ভূমিকা তুলনাহীন।
গাছ কার্বন-ডাইঅক্সাইড গ্রহণ করে অক্সিজেন ত্যাগ করে । অন্যদিকে মানুষ কার্বন-ডাই অক্সাইড ত্যাগ করে ও অক্সিজেন গ্রহণ করে বেঁচে থাকে। ফলে মানুষ প্রয়োজনীয় অক্সিজেন উদ্ভিদ থেকে পেয়ে থাকে। কল-কারখানা,গাড়ি ও ইটভাটা থেকে প্রতিদিন প্রচুর পরিমাণ ধোঁয়াসহ কার্বনডাই-অক্সাইড ও ক্লোরোফ্লোরো কার্বন(CFC) নির্গত হচ্ছে। অধিকাংশ কার্বনডাই-অক্সাইড উদ্ভিদ শোষন করে নেয়। দেশে বৃক্ষের হার কমে যাওয়ায় বা প্রয়োজনীয় বনাঞ্চল না থাকায় বাতাসে বিষাক্ত সীসার পরিমান দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে বায়ুমন্ডলের ওজোনস্তর ধ্বংস হতে চলছে। এ ওজোনস্তর পৃথিবী পৃষ্ঠ থেকে ২৫ কিলোমিটার উচ্চতায় অবস্থিত একটি স্তর যা পৃথিবীকে সূর্য থেকে নির্গত অতি বেগুনী রশ্মি অর্থাৎ আলফা রশ্মি নামক ক্ষতিকর আলোক রশ্মি থেকে পৃথিবীতে বসবাসকারী জীবকূলকে বাঁচিয়ে রাখছে। ওজোন গ্যাস মূলত অতিবেগুনী রশ্মির হাত থেকে আমাদেরকে রক্ষা করে।
ওজোন স্তরের ওজন গ্যাস ও কার্বনডাই-অক্সাইড বিক্রিয়া করে ওজোন নামক গ্যাস বিনষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এতে সূর্য থেকে নির্গত হওয়া অতিবেগুনী রশ্মি সহজেই পৃথিবী পৃষ্ঠে চলে আসায় বৈশ্বিক উষ্ণতা বেড়ে যাচ্ছে। বিশ্বে সলফার ডাই অক্সাইড,নাইট্রোজেন অক্সাইড,কার্বন মনো-অক্সাইড,কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ায় ওজোন স্তর ধ্বংস হওয়ার একমাত্র কারণ বলে পরিবেশ বিজ্ঞানীদের ধারণা । এ সব বিষাক্ত গ্যাসের দরুন বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বন নিধন না করে বন সৃজন করতে পারলে অনেকটা প্রাকৃতিক পরিবেশের বিপর্যয় স্বাভাবিকতা বজায় রাখা যেতো । উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে মেরু অঞ্চলের বরফ গলে সমুদ্রের পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করতে না পারলে আগামী অল্প সময়ে পৃথিবীর নিম্নাঞ্চল মালদ্বীপ, বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চল ,ভূটানসহ বিশ্বের বিভিন্ন উপকূলীয় অঞ্চল সাগর জলে তলিয়ে যাবে বলে বিশেষজ্ঞ মহল ধারণা করছেন। অন্যদিকে আলট্রাভায়োলেন্ট রশ্মি যা অতিবেগুনী রশ্মি নামে পরিচিত সূর্য রশ্মি পৃথিবী পৃষ্ঠে পতিত হতে থাকলে নদী ও সাগরের জুয়োপ্লাংটন, ফাইটোপ্লাংটন নামক প্রাণি কণা ও উদ্ভিদ কণা বিনষ্ট হয়ে যাবে।
এদের অভাবে নদী ও সাগরের মৎস সম্পদ বিলুপ্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।কারণ এসব ক্ষুদ্র উদ্ভিদ ও প্রাণি কণা প্রাথমিক স্তরের প্রাণিরা খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে। এসব ক্ষুদ্র উদ্ভিদ ও প্রাণি কণা বিলীন হলে পর্যায়ক্রমে সকল স্তরের জলজ প্রাণি বিলুপ্ত হবে অচিরেই। পরিবেশ বিজ্ঞানীদের ধারণা,প্রাথমিক স্তরের খাদক বিলুপ্ত হতে থাকলে ধীরে ধীরে প্রাণি জগতের অস্থিত্ব টিকিয়ে রাখা অসম্ভব হয়ে পড়বে। যেহেতু প্রাণি উদ্ভিদের উপর নির্ভরশীল সেহেতু মানব জীবনে উদ্ভিদের ভূমিকা অপরিসীম। সে প্রেক্ষিতে “বৃক্ষরোপণ কর্মসূচী” সরকারের পরিকল্পনাকে সমর্থন জানিয়ে প্রতিনিয়ত বৃক্ষ রোপণ করা প্রত্যেকের নৈতিক দায়িত্ব ও কর্তব্য হওয়া উচিত।
লেখকঃ জেপুলিয়ান দত্ত জেপু
শিক্ষক ও সাংবাদিক