Thursday, January 30, 2025
Homeসাহিত্যলেখকের ভাবনাগোধূলির রাঙা আকাশে হারিয়ে যাওয়া

গোধূলির রাঙা আকাশে হারিয়ে যাওয়া

মোহাম্মদ মোশাররফ হুসাইন

মোহাম্মদ মোশাররফ হুসাইন

গোধূলি—দিনের শেষ এবং রাতের শুরুর একটি মুগ্ধকর মুহূর্ত। এই সময় আকাশ রাঙা হয়ে ওঠে সূর্যের বিদায় সম্ভাষণে, যেন প্রকৃতির এক অসাধারণ শিল্পকর্ম। গোধূলির আকাশ কেবলমাত্র একটি দৃশ্য নয়; এটি আমাদের জীবনের একটি প্রতীক, যা সময়ের অস্থায়িত্ব, সৌন্দর্য এবং পরিবর্তনের গল্প বলে। দিগন্ত জুড়ে সোনালি রঙয়ের মাঝে, স্তব্ধ নিঃশ্বাস দূরে ঠেলে ফিরে আসি বারেবার। ছুঁয়ে যাই, আবার-ও হারাই। আমারি জন্যে সহস্র সূর্য দেবে একই আলো চিরকাল। এক-ই আকাশে গোধূলি . . . দিনের শেষ প্রহর, যখন সূর্য তার লালচে রঙের আভা ছড়িয়ে দিয়ে আকাশকে রাঙা করে তোলে, তখন মনটা এক অন্যরকম শান্তিতে ভরে ওঠে। গোধূলির এই মায়াবী সময়টা আমার খুব প্রিয়। আকাশের রং ক্রমশ পরিবর্তন হতে থাকে। গোলাপি, বেগুনি, নীল – একে একে সব রং মিশে মিশে এক অদ্ভুত সৌন্দর্য তৈরি করে। মনে হয়, আকাশ যেন একজন চিত্রকরের ক্যানভাস, যেখানে প্রতিদিন নতুন করে ছবি আঁকা হচ্ছে। পড়ন্ত বিকেল, রক্তিম আলোর আভা আকাশে বিস্তার করেছে চারিদিকে। কর্মজীবী মানুষ কাজ শেষ করে তার গৃহে ফেরার জন্য সকল প্রস্তুতি নিচ্ছে, সেই সাথে গবাদিপশু পশু উদগ্রিব তার নিজের গোয়ালে যাওয়ার জন্য। শিশুরা তাদের খেলা শেষ করে দলবেঁধে পুকুরে নেমে গোসল করছে। পাখিরা কিচিরমিচির শব্দে উড়ে উড়ে তাদের নিড়ে ফিরছে। সব মিলিয়ে প্রকৃতি খুবই ব্যস্ত এই সময় পার করছে। সবাই সবার নিজস্ব কাজে ব্যস্ত। আসলে এই গোধূলি সময়টা অনেক ব্যস্ততার সময়।

ছোট বেলার এই পড়ন্ত বিকেলটা অনেক বেশি মিস করি৷ কতই না চঞ্চল ছিলাম তখন, ছিল কত উন্মাদনা, ছিল উচ্ছাস, অনাবিল হাসি আনন্দ, ছিল দুরন্তপনা। সব মিলিয়ে খুবই মনোমুগ্ধকর সময় পার করে এসেছি যা এখন সবই কাল্পনিক।এভাবেই প্রকৃতির মাঝে বেড়ে ওঠা। তারপর আস্তে আস্তে তুমি নামক শব্দটা ভীষন ভাবে পাওয়া। কল্পনার জগৎ সাজিয়ে পায়ে পা মিলিয়ে তোমার সাথে পথ চলা, বিশুদ্ধতার সকল ভালবাসা নিয়ে। এমন পড়ন্ত বিকেলে পাশে বসে হাজারো স্বপ্নের বীজ বুনা, মন খুলে হাসিতে মেতে উঠা, সে যেন ছিল কি এক অনাবিল সুখ, আর সীমাহীন আনন্দ। কিন্তু সূর্যের আলো আর কত সময় কিরণ দিবে, অতঃপর বেলা শেষ হয় এক সময় এবং বেলা শেষের গল্প শুরু হয় সেখান থেকে। আর অবশেষে তুমি নামক তুমি আর এখন পাশে নেই, বাস্তবতার মাঝে তুমি হারিয়ে গেছো। এখনও গোধূলি বেলায় তোমার খুজি, খুজে বেড়াই তোমার সত্তাকে কিন্তু বেলাশেষে যা হারিয়ে যায়, মহাকাল তা আর কখনো ফিরিয়ে দেয় না।

গোধূলি আমার কাছে এক নিঃশব্দ কবিতা। দিনের শেষ আলো আর রাতের আগমনের মধ্যবর্তী এই ক্ষণ যেন এক অলৌকিক মায়াজাল। সূর্যের সোনালি আভা যখন ধীরে ধীরে লাল-কমলায় রূপ নেয়, তখন মনে হয় প্রকৃতি তার নিজস্ব রঙে ছবি আঁকছে। এই সময়ে চারপাশটা এক অদ্ভুত নীরবতায় ভরে যায়, যেন প্রকৃতি নিজেই গভীর কোনো চিন্তায় মগ্ন। পাখিরা বাসায় ফিরে যায়, নদীর জলে সূর্যের প্রতিফলন অসীম শান্তির অনুভূতি এনে দেয়। আর মানুষের মনেও একধরনের প্রশান্তি বয়ে যায়, যেন দিনের ক্লান্তি মুছে গিয়ে নতুন করে ভাবার সুযোগ করে দেয়। গোধূলি আমাকে জীবনের অন্তিম আরম্ভের কথা মনে করিয়ে দেয়। শেষ যেমন অনিবার্য, তেমনি তার পরেই এক নতুন শুরু অপেক্ষা করে। এই সময়টা কেবল দিনের শেষ নয়; এটি আশা, প্রতীক্ষা এবং পুনর্জন্মের এক প্রতীক। তাই, গোধূলি আমার কাছে শুধু প্রকৃতির সৌন্দর্য নয়, এটি জীবনের গভীর দর্শন।আমি হেরে গেছি সেই বাস্তবতার মাঝে। আসলে জীবন এখন বাস্তবতার সাথে মিশে যাচ্ছে, যা হারিয়ে ফেলেছি তা আর কখনো ফিরে আসবে না। ফিরবে না কখনো সেই সময়, ফিরবে না আর তুমি নামক শব্দটা। হারিয়ে গেছে আমার সব কিছু কালের অতল গর্ভে। মিশে যাচ্ছি আমি কোনো এক অবলীলায়, হারিয়ে গেছি তোমাত্ব নামক জায়গা থেকে। শেষ বিকেলের মায়ার আলোয় হারিয়ে গেছি তুমি আমি।

লিখুন প্রতিধ্বনিতেলিখুন প্রতিধ্বনিতে

মানবজীবনও একপ্রকার গোধূলির মতো। শৈশব থেকে যৌবন, তারপর বার্ধক্য—জীবনের এই পর্যায়গুলো ঠিক দিনের সময়ের মতোই। শৈশব হলো প্রভাত, যৌবন হলো মধ্যাহ্ন, আর বার্ধক্য হলো সেই গোধূলি। জীবনের এই গোধূলি ক্ষণ অনেকের জন্যই একধরনের মধুর বিষাদ নিয়ে আসে। এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় সময়ের অনিবার্যতা এবং অমূল্যতা। গোধূলি যেমন দিনের পরিশ্রমের সমাপ্তি ও বিশ্রামের আহ্বান, তেমনই জীবনের শেষ প্রান্ত আমাদেরকে শেখায় আত্মসমীক্ষা। এই সময়টিতে আমরা যা কিছু অর্জন করেছি, যা কিছু হারিয়েছি, তার সবটুকুকে মেনে নিয়ে জীবনের সৌন্দর্য উপলব্ধি করি। গোধূলির রঙ যেমন সূর্যাস্তের পর ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায়, তেমনি জীবনের শেষ প্রান্তও একসময় মিশে যায় চিরন্তন অন্ধকারে।তবে গোধূলির একটি দিক আছে, যা আমাদের আশা জাগায়। এটি সূর্যাস্তের গল্প বললেও, নতুন দিনের সূচনা ঘটানোর প্রতিশ্রুতি দেয়। জীবনের শেষ প্রান্তও নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করতে পারে। যেমন সূর্য ডুবে গেলে রাতের আকাশে নক্ষত্ররা আলো ছড়ায়, তেমনি জীবনের গোধূলির পর নতুন এক দিগন্তের প্রতিশ্রুতি থাকতে পারে। গোধূলির রাঙা আকাশ আমাদের শেখায়, জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত মূল্যবান। সময় থেমে থাকে না, আর সৌন্দর্যও চিরস্থায়ী নয়। তাই জীবনের প্রতিটি অধ্যায়কে উদযাপন করা উচিত। সুখ-দুঃখ, আলো-অন্ধকারের এই মিশ্রণে জীবন পূর্ণতা পায়। গোধূলি আমাদের জানিয়ে দেয় যে, শেষের মধ্যেও এক ধরণের সৌন্দর্য আছে, যা নতুন কিছুর সূচনা করে।

গোধূলিবেলায় বাতাসে একটা আলাদা সুর থাকে। হালকা হাওয়া যেন মনের সব দুঃখ-কষ্টকে বইয়ে নিয়ে যায়। চারদিকে একটা নিরিবিলি পরিবেশ তৈরি হয়। এই সময়টা নিজেকে একটু সময় দিয়ে চিন্তা করার জন্য খুবই উপযুক্ত। গোধূলির এই সুন্দর দৃশ্য দেখতে দেখতে মনে হয়, সময় যেন থেমে গেছে। কিন্তু এই মুহূর্তটাও তো চিরস্থায়ী নয়। অন্ধকার আস্তে আস্তে আচ্ছন্ন করে ফেলবে আকাশকে। তবুও এই মুহূর্তটাকে মনে রাখতে চাই সারাজীবন।

Facebook Comments Box
প্রতিধ্বনি
প্রতিধ্বনিhttps://protiddhonii.com
প্রতিধ্বনি একটি অনলাইন ম্যাগাজিন। শিল্প,সাহিত্য,রাজনীতি,অর্থনীতি,ইতিহাস ঐতিহ্য সহ নানা বিষয়ে বিভিন্ন প্রজন্ম কী ভাবছে তা এখানে প্রকাশ করা হয়। নবীন প্রবীণ লেখকদের কাছে প্রতিধ্বনি একটি দারুণ প্ল্যাটফর্ম রুপে আবির্ভূত হয়েছে। সব বয়সী লেখক ও পাঠকদের জন্য নানা ভাবে প্রতিধ্বনি প্রতিনিয়ত কাজ করে চলেছে। অনেক প্রতিভাবান লেখক আড়ালেই থেকে যায় তাদের লেখা প্রকাশের প্ল্যাটফর্মের অভাবে। আমরা সেই সব প্রতিভাবান লেখকদের লেখা সবার সামনে তুলে ধরতে চাই। আমরা চাই ন্যায়সঙ্গত প্রতিটি বিষয় দ্বিধাহীনচিত্ত্বে তুলে ধরতে। আপনিও যদি একজন সাহসী কলম সৈনিক হয়ে থাকেন তবে আপনাকে স্বাগতম। প্রতিধ্বনিতে যুক্ত হয়ে আওয়াজ তুলুন।
এই ধরণের আরো লেখা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -
Google search engine

সাম্প্রতিক লেখা

Recent Comments