আইনুন নাঈমা
মধু মাসের ছুটি চলছে।চারদিক আম কাঁঠালের মৌ ঘ্রাণে মুখরিত। বৃষ্টির পানিতে আম কাঁঠালের অর্ধেক গলে যাওয়া খোসাতে মাছি ভনভন করছে। বৃষ্টির বিরাম নেই। বন্ধু নেই। নয়নদের বাড়ির ত্রিসীমায় আম কাঁঠালের কোনো গাছ ও নেই । গাছ বলতে দুটি পেঁপের গাছ আর এক ফালি উঠোনের শেষে পাটখড় বিছানো মাচায় ঝুলন্ত পুঁইগাছ ।স্থাবর সম্পত্তি বলতে আছে শুধু চার শতাংশ জমির উপর একটি ছুট্ট বারান্দাসহ দুচালা টিনের ঘর।তারই নিচে নয়নের মা এই বৃষ্টিমুখর অবসন্ন বিকেলে ছেঁড়া চাটাই বিছিয়ে কাঁথা সেলাই করছে। আর তার পাশেই বেতের বুননে সদ্য গড়া পাটিতে বসে নয়ন মাথা দুলিয়ে আওড়াচ্ছে -শত্রুরা মদিনায় দুই দুই বার হামলা করলো ……
খানিকটা দূরে হিমেলদের সিঁদুরে আম গাছটা হতে টুপ্ টুপ্ করে পর পর লাল টুক টুকে দুটি আম পড়লো।নয়ন চোখ তুলে তাকালো সেদিকে। রাহেলা বানুর কড়া শাসন -ঐদিকে তাকাইয়া লাভ নাই। মাথা নিছু কইরা পড়ো।
-আচ্ছা
নয়ন গড় গড় করে পড়ে যায়। পড়াতে মন নেই। মন পড়ে আছে সিঁদুরে আম গাছের নিচে। কখন মা ঘুমুতে যাবে ?এই সুযোগে-ভাবতেই তার মনে অপরিমেয় আনন্দ ঢেউ খেলে যায়। হিমেলের বাবা নয়নের আপন চাচা। আম কাঁঠাল সহ আরো কিছু ফলের গাছ নয়নের দাদির হাতের লাগানো হলেও তা এখন হিমেলের বাবার দখলে। যতদিন তার দাদি বেঁচে ছিল ততদিন অল্প কিছু হলেও ভাগে পাওয়া যেতো। কিন্তু এখন তা অসম্ভব। হিমেলের মা দিনের আলোতে কি রাতের অন্ধকারে -কাউকেই আম গাছের তলা ঘেঁষতে দেন না। গাছ তলায় কেউ থাকুক আর না থাকুক কিছুক্ষণ অন্তর হিমেলের মায়ের রূঢ় উচ্চকণ্ঠ শোনা যেতো -কে … কে … কে গাছ তলায় ?
এমন কর্কশ শব্দে গাছে যদি ফল আহারী পাখিও থাকতো ,সেটাও উড়ে যেতো অভিশাপ দিতে দিতে।
কিছুক্ষণ পর নয়ন পেটের ভিতর ক্ষুধার যাতনা অনুভব করে।
-ওমা, ভুখ লাগছে। খাওন দাও।
রাহেলা সেলাইয়ের কাজ থামায়
-হ বাপ্ ,আমার ও ভুখ লাগছে। তোর বাপ্ যে কই গেলো এই মেঘ বাদলার দিনে ?সকালে না খাইয়া বাইর হইয়া গেলো গা। আইজ আর ফিরবোনা। মাছের আড়তে কাজ জুটেছে নিশ্চয়। চল বাপ্ ঘরে চল।খাওন দিতাছি।
নয়ন বাড়ান্দার দুয়ারের কাছের ভাঙা বালতিতে জমা পানি দিয়ে হাত মুখ ধুয়ে নেয়। চোখ দুটো আপনা হতেই চলে যায় আম গাছের নিচে। ছ সাতেক আম পড়ে আছে। হিমেলের মা নিশ্চয় ঘুমিয়ে গেছে। লাল টুকটুকে আম গুলো চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে। জিভে জল নেমে আসে। সাথে চোখেও।
-কই গেলি বাপ্। আয়। খাইতে আয়।
নয়ন ও তার মা ছোট মাছের চর্চরি আর ডাল দিয়ে ভাত মাখায়। থালা চেটে পুঁটে খেয়ে কলসি থেকে পানি খেয়ে অবশিষ্ট ভাতে পানি ঢেলে রেখে দেয়।
-আয় বাপ্ ,শুয়ে পর দেহি। আইজ আর পড়া দরকার নাই। এই সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো বলে।
রাহেলা বালিশে মাথা ঠেকায়। নয়ন ঘুমুবার ভান করে মরার মতো পড়ে থাকে। অল্প ক্ষণ পরেই রাহেলার নাক ডাকার শব্দ পাওয়া যায়।
নয়ন সন্তপর্নে উঠে আসে বাড়ান্দায়। ইশ লাল টুক টুকে আম গুলো এখনো পইড়া আছে -নয়ন মনে মনে আওড়ায়। বৃষ্টি থামেনি ,তবে বেগটা ধরে এসেছে। শেওলা জমা উঠোনটা পেরুতে হয় সাবধানে -পা টিপে টিপে।সে খুশিতে আত্মহারা -এতো গুলো আম ! ইশ …সব শুধু আমার। শুধু আমার।
সে কয়েকটা আম গেঞ্জির পুটুলিতে জমায়। একটি আম গড়িয়ে গড়িয়ে বাড়ির গেট ছুঁয়েছে। যখনি আমটা টুকাতে যাবে অমনি গেটে হেলান দেওয়া আম পাড়া মোটা কঞ্চিটা ধপাস করে পড়ে গেলো মুরগির টিনের ঘরটার উপর। এতে ঘুমের ব্যাঘাত ঘটলো গৃহবন্দি মুরগির।ঘুমের ব্যাঘাত ঘটলো হিমেলের মায়ের ও।
-কে …কে ..কে আম পাড়ে ?ধর ধর ধর ব্যাটাকে।
কোথা হতে উড়ে এলো গোয়াল ঘরের কাজের ছেলেটি। আচ্ছা করে কান চেপে ধরলো নয়নের।
ততক্ষণে হিমেলের মা ও এসে হাজির গাছের নিচে।
নয়নের চোখের পানি যেন কোনো বাধাই মানতে চায়না। ঝর ঝর করে অনবরত ঝরছে চোখের কোণ বেয়ে।
-আঃ আঃ আঃ লাগছে। ছাইড়া দাও। আমি আম পারি নাই। ও কাকি পায়ে পড়ি। লাগছে।। ছাইড়া দিতে কও
-হারামজাদা। আম পারিসনি তবে কাঁচা পাতা পাতা পড়ে আছে কেমনে হুম।
- না কাকি ,সত্যি বলছি। আমি আম পারি নাই। কানটা ছিঁড়ে গেলো। বড্ডো লাগছে। ছাড়ো।
আরো কয়েকটা ঘাঁ পিঠে বসিয়ে দিয়ে নয়নকে ছেড়ে দেয়া হলো।
বাড়ান্দায় দাঁড়িয়ে সবটা দেখছিলো রাহেলা বানু। এর চেয়ে করুণ দৃশ্য আর কি হতে পারে ? শৈশব দারিদ্র বুঝেনা ,শৈশব আইন বুঝেনা।যেখানে জমির সীমানা সেখানে মনের অদৃশ্য সীমানা -এই চিরন্তন সত্য শৈশব মানতে চায়না।
রাত প্রায় দুইটা বাজে। মতি মিয়া ফিরেছে। সাথে মোষের দুধ ,রুপালি আম। রাহেলা গুন্ গুনিয়ে কাঁদেন। আঁচলে চোখ মুছেন। নয়নের শরীলে প্রচন্ড জ্বর। মাথায় পানি ঢালতে ঢালতে সবটা খুলে বলেন মতি মিয়াকে। মতি মিয়া আস্তে আস্তে ডাকেন -নয়ন ,ও নয়ন চোখ খোল বাপ্।চাইয়া দেখ ,আম আনছি। তুই খাবিনা ?চোখ খোল বাপ্
“আমি আম পারি নাই কাকি ,আমি আম পারি নাই ,বিশ্বাস করো -আমি আম পারি নাই “-নয়নের অচেতন আর্তনাদ।