জাদুঘর আমাদের সবার কাছেই সুপরিচিত একটি দর্শনীয় স্থান। জাদুঘর কেবল দর্শনীয় স্থান ই নয় বরং প্রতিটি জাতির জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে বিবেচনা করা যায়। কারণ, কোনো দেশের জাদুঘর সেই দেশের মানুষকে তার শিকড়ের সন্ধান দিয়ে থাকে। মূলত এটি একটি জাতির ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে তুলে ধরার পাশাপাশি প্রতিনিধিত্ব ও করে। যে জাতি তার ইতিহাস জানে না সেই জাতি সেই নিছক পাতার মতো যে জানে ই না যে সে একসময় একটি সুবৃহত গাছ ছিলো।
অর্থাৎ, বলা যায়, নিজের অস্তিত্বের প্রতি উদাসীন থাকা।একটি আদর্শ জাতির অন্যতম গুণ হচ্ছে তার দেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে ভালোভাবে জানা ও তা চেতনায় লালন করা। তাছাড়া, জাদুঘরের অন্যতম উদ্দেশ্য হলো বর্তমান প্রজন্মকে তার ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়া।ইতিহাস বিভাগের শিক্ষার্থী হিসেবে আমার জন্য জাদুঘর আমার জন্য পাঠ্যোদ্ধারের অন্যতম সহায়ক উপাদআনবলা যায়। কাজেই একদিন বন্ধুরা মিলে মনস্থির করলাম যে জাদুঘরে যাবো।যেই কথা সেই কাজ। একদিন সুন্দর সকালে সকলে মিলে রওনা হলাম জাদুঘরের উদ্দেশ্যে। বেলা ১১ টার দিকে আমরা আমাদের গন্তব্যে পৌঁছালাম।টিকিট কেটে ভিতরে ঢুকলাম।
তারপর আমাদের ব্যাগপত্র রেখে জাদুঘরের ভিতরে প্রবেশ করলাম। দোতলায় উঠতেই আমদের হাতের টিকিট চেক করে একটা অংশ ছিড়ে দিলো।এছাড়া, এই চেকিং প্রক্রিয়া ঢোকার শুরুতে ও হয়েছিলো। জাদুঘরের মূল সংগ্রহশালা শুরু হয়েছে দোতলা থেকে। কিছু দর্শনার্থী নিচে সোফায় বসে বিশ্রাম নিচ্ছেন। যাই হোক, আমরা আমাদের মূল অভিযানে নেমে পড়লাম।ঢুকেই দেখতে পেলাম বাংলাদেশের বিশাল একটা মানচিত্র। একজন লোক বসে ছিলো দর্শনার্থীদের তাদের চাহিদামতো জায়গার সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য। আমরাও পরিচিত হলাম আমাদের নিজ নিজ জেলার সাথে। এরপর আমরা দেখলাম আমাদের দেশের গর্ব ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন। জাতীয় পশু রয়্যাল বেঙগল টাইগার , নানা ধরনের হরিন,পাখির কুজন ও গহিন অরন্যের রহস্যময়তার মাঝে আমরা হারিয়ে গেলাম।
এরপর একের পর এক আবিষ্কার করলাম বাংলার ইতিহাস ও ঐতিহ্যের এক একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। যেমন -বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু বিলুপ্ত প্রায় কিছু বৃক্ষ, ফুল, ফল,শস্য, মসলা ইত্যাদি। আবার দেখতে পেলাম বাংলাদেশের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃতি ওবিভিন্ন রাজবংশের ইতিহাস জানলাম যারা একসময় এই অঞ্চল শাসন করেছেন।তখনকার আমলে প্রাপ্ত বিভিন্ন মুদ্রা থেকে মূলত এইসব তথ্য পাওয়া যায়। এছাড়াও প্রাচীনকালে রাজা বাদশাহ দের ব্যবহৃত বিভিন্ন দ্রব্যাদি ও অনেক যত্ন সহকারে সংরক্ষন করা হয়েছে। এইভাবে কোনো টাইমমেশিন ছাড়াই আমরা পৌছে গেলাম সুদূর প্রাচীন আমলে।এরপর আমরা পরিচিত হলাম কিছু ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর সমাজব্যবস্থা ও সংস্কৃতির সাথে। এছাড়া, আমাদের দেশীয় লোকজ ঐতিহ্যের নানা উপাদান প্রতিযোগিতামূলকভাবে আমাদের অভিভূত করতে লাগলো।
এভাবে জাদুঘর দেখতে দেখতে আমরা হারিয়ে গেলাম ইতিহাস ও ঐতিহ্যের মাঝে। এত আনন্দ হচ্ছিল তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না।এতকিছুর মধ্যে ওজাদুঘরের অন্যতম একটি দিক আমাদেরকে ভারাক্রান্ত করে তুললো সেটা হলো- বর্তমান এই সভ্যতার আগ্রাসনের যুগে আমাদের অনেক দেশীয় ও লোকজ ঐতিহ্য, সংস্কৃতি,শিল্প, সাহিত্য বিলুপ্তির পথে। এগুলো আমদের গর্ব,আমদের অহংকার।বাঙালি জাতিসত্তার প্রধান ধারক ও বাহক।যাইহোক, এবার চলে আসলাম সেই মাহেন্দ্রক্ষণে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে এটা বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস। যেখানে অত্যন্ত নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে বাঙালির প্রতিটি আন্দোলন ও সংগ্রামের ধারাবাহিক ও বস্তুনিষঠ বিবরণী।
আমদের মহান স্বাধীনতার রুপকার জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যবহ্রত বিভিন্ন জিনিসপত্র অনেক যত্নসহকারে সংরক্ষিত রয়েছে। এসব দেখতে দেখতে আমাদের মিশ্র অনুভূতি হলো।একদিকে, মাতৃভাষা ও স্বাধীন ভূখন্ড পাওয়ার আনন্দ, অন্যদিকে বাংলার সূর্য সন্তানদের হারানোর বেদনা। এমন রোমাঞ্চোকর সময় কাটাতে কাটাতে কখন যে বিকাল ৪ টা বেজে গেলো টেরই পেলাম না। এরপর একবুক ভরা সাহস আর দেশপ্রেমের চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে আমরা জাদুঘর ত্যাগ করলাম।দিনটি স্মৃতির পাতায় চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবে।।।।