-তায়েব বিল্লাহ মুবাশ্বির
আবির আমার ছোট সময়ের একমাত্র বন্ধু।
দশ বছর বয়সে আমি যখন কিতাব বিভাগে পড়ি ও তখন হিফয বিভাগে পড়ে। ওর বাবা সেনাবাহিনীর একজন উচ্চতর সদস্য, তা সত্ত্বেও তার একমাত্র স্বপ্ন ছিল ছেলেটাকে হাফেজে কোরআন বানাবেন, আর এজন্যই ওকে ভর্তি করে দেন শরীয়তপুরের দারুল উলূম মাদরাসায়।
ওর সাথে আমার বন্ধুত্ব কিভাবে গড়ে উঠেছিল তা ঠিক মনে না পড়লেও একটি ঘটনা কিছুতেই ভুলতে পারিনি, একবার শরীয়তপুর ইঁট ভাটার মাঠে ছোটদের একটি ক্রিকেট টুনামেন্টের আয়োজন করা হয়, আমরা মাদরাসার ছেলেপুলেরা যখন সেই টুনামেন্টের ফাইনাল ম্যাচে উঠি তখন পাঁচ ওভারে পয়তাল্লিশ রানের একটি টার্গেট নিয়ে তিন ও চার নাম্বার ব্যাচম্যান হিসেবে মাঠে নামি আবির ও আমি, দীর্ঘ বিয়াল্লিশ রানের একটি জুড়ি নিয়ে যখন আমরা ছোট্ট এ দু’জন পুরো ম্যাচটিকে জিতিয়ে আনি তখন অবাক হয়ে যায় মাঠের সকল দর্শক! আনন্দ উল্লাসে মেতে উঠে মাদরাসার সকল ছাত্র ভাইয়েরা!
এ ঘটনার পর আবিরের সাথে আমার বন্ধুত্বের সম্পর্ক আরও দৃঢ় হয়ে উঠে, খেলাধুলা থেকে শুরু করে ঘুরাফেরা সবখানেই আমাকে ছাড়া কিছুই বুঝত না আবির।
দীর্ঘদিন ডিউটি আর কর্মব্যস্ততার পর আবিরের বাবা যখন মাদরাসায় এসে ওর চোখে মুখে চুমু খেতো আরা ওকে নিয়ে বাড়ির পথে রওনা হতো তখন এক কাঙ্ক্ষিত চাহনি নিয়ে বারবার ঘুরে তাকাত আমার দিকে, ওর বাবাও তখন বুঝতে পারতেন যে ওর হয়তো আরও একজন আছে, তখন ওর বাবা এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে আপন সন্তানের মতোই ভালোবেসে নিয়ে যেতেন আবিরদের বাড়িতে, এভাবেই আবিরের সাথে আমার বন্ধুত্বের সম্পর্ক আরও গভীর হয়ে উঠে।
আবির ছিল অন্যান্য ছাত্রদের থেকে একটু ভিন্ন ধরনের, চলনে-বলনে সবদিক থেকেই ছিল সদাসর্বদা বিনয়ী, অসাধারণ মেধা শক্তি সম্পন্ন ছিল আবির, মাত্র একবছর যেতে না-যেতেই অর্ধ কোরআন মুখস্ত করে ফেলেছিল।
আর ওর শারীরিক সৌন্দর্যতার কথ কী বলবো!পুরো এলাকাবাসীই ছিল ওর সৌন্দর্যতায় বিমুগ্ধ! সুন্দর গোলাকৃতির কোমল মুখ, তার মাঝে দু একটি তিলক রেখা, ডাগর নয়ন, এককথায় অতুলনীয় রূপ রৌশনের অধিকারী ছিল আবির! ওর সুন্দর মায়াবী চেহারা দেখে দুষ্টমি করে হলেও কেউ কখনো আঘাত করতে সাহস পেত না, সবসময় ছোট্ট একটি মুচকি হাসি ওর ঠোঁটে লেগেই থাকতো, ও যখন দু-হাত নাড়িয়ে চমৎকার ভঙ্গিতে কোনো কথা বলতো তখন আশেপাশের ছাত্র ভাইয়েরা ওর কথা শুনার জন্য ছিল উদগ্রীব, সবারই একটি কামনা ছিল- আবির যদি আমার ছোটো ভাই হতো, অথবা ভাতিজা হতো কিংবা হতো ভাগিনা!
কিন্তু খুশির বিষয় হল- সে আবিরই ছিল আমার একমাত্র বন্ধু!
শারীরিক গঠন আর বয়সে পিঠাপিঠি হওয়ায় আমাদের এসম্পর্ক নিয়ে কেউ কখনো মন্দ ভাবেনি।
হিফয খানায় যখন ঘুমের ছুটি হতো তখন আবির এসে আমাদের রুমের জানালার গ্রিল ধরে দাড়িয়ে থকতো, জামাতের বড় ভাইয়েরা ওকে দেখে দুষ্টমি করে আমাকে খোঁচা মেরে বলতো- তায়েব! তোর দোস্ত এসেছে, আমি যখন ফিরে তাকাতাম তখন ও একটু মুচকি হেসে ইশারায় কী যেন বলে চলে যেতো! ক্লাস শেষে আমি গিয়ে ওকে পেতাম হয়তো পাশের রুমে বিড়াল নিয়ে খেলা করছে নয়তো অযু খানায় আমার অপেক্ষায় দাড়িয়ে আছে।
এভাবেই খেলাধুলা- ঘুরাফেরা আর হাসি আনন্দের মাঝেই পেরিয়ে গেল দীর্ঘ একটি বছর।
এরপর হঠাৎ একদিন বেজে ওঠে বিদায়ের করুন সুর, আবির আর আমার মাঝে বন্ধুত্বের এক ছোট্ট সুনিবিড় বন্ধন তৈরী হলেও আমি আমার উদ্দেশ্য সম্পর্কে সম্পূর্ণ গাফেল হয়ে যাইনি, আমাকে যে আরও দীর্ঘ আট নয়টি বছর পেরুতে হবে এটা আমার ঠিকই স্মরণে ছিল।
___একদিন বিকেলবেলা আবির আর আমি দারুল উলূম মসজিদের পশ্চিম দিকের সিডিতে বসে গল্প করছিলাম, ছাত্র ভাইয়েরা এখনো মাঠ জুড়ে খেলায় ব্যাস্ত, ঐদিন কেন যেন আমরা খেলায় মগ্ন হতে ভুলে গিয়েছিলাম, হয়তো জীবনের বাস্তবতা নিয়ে একটু ভাবতে বসেছিলাম, অথবা নির্মল অনুভূতির স্নিগ্ধ দহনে অবগাহনের জন্য! চারদিকের পরিবেশ কেমন যেন আমার হৃদয়কে গলিয়ে দিচ্ছিল, সূর্য তখন রক্তিম হয়ে চোখের সামনে ধীরে ধীরে পশ্চিমে ঢলে পড়ছে, সামনে নারিকেল পাতার ফাঁক বেয়ে সূর্যের সোনালী কিরণ এসে লাগছে আমাদের গায়ে, মাথার উপর উড়ে যাচ্ছে সাদাকালো পাখিদের ঝাঁক, দিন শেষে গোধূলি লগ্নে ফিরে যাচ্ছে ওরা ওদের নীড়ে।
চারিদিকে কেমন যেন বিদায়ী পরিবেশ ছেয়ে আছে, আবির লক্ষ করল আমার মুখটা কেমন যেন মলিন হয়ে আছে, কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে কিছুক্ষণ নিরবে কী যেন ভাবছি, কিন্তু কখনো ওকে বুঝতে দিইনি ওর আমার মাঝে বিদায় বিচ্ছেদের সেই চিরসত্য ভাবনাটুকু, তবুও চারদিকের পরিবেশ কেমন যেন নিরবে জানিয়ে দিচ্ছিল সেই অজানা সত্য কথাটি, কিন্তু সেটা জিজ্ঞেস করতে যেন আবির অপারগ ছিল!
আমি তখন জল ছল ছল চোখে রক্তিম সূর্যের দিকে ধ্যানমগ্ন হয়ে তাকিয়ে আছি, অনেক্ক্ষণ হল, এবার আবির আমার কাঁধে একটি হাত রেখে মাথাটা একটু নিচে ঝুঁকিয়ে জিজ্ঞেস করেই ফেললো- তায়েব! তুমি কী চিন্তা করছ? তুমি কি চলে যাওয়ার কথা ভাবছ? আমি কিছুক্ষণ নিরব রইলাম, এরপর ওর দিকে ফিরে তাকালাম, কিন্তু আবিরের মুখে বিদায়ের এই বিষাদিত কথাটি শুনে উত্তর দেওয়ার কোনো ভাষা খুঁজে পেলাম না! অতিকষ্টেও সংবরণ করতে পারলাম না চোখের পানিকে,
এবার আবির আর বুঝতে ভুল করল না জীবনের এ তিক্ত সত্য বিষয়টিকে, আমি দেখলাম- মুহূর্তের মাঝেই আবিরের চেহারার রং পাল্টে যাচ্ছে, কিছুটা জোরে সোরে ভিতর থেকে শ্বাস ফেলছে, কিছুক্ষণ অন্যদিকে ফিরে চেয়ে কী যেন ভাবছিল! এরপর জল ছল ছল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে, আমারও কপোল বেয়ে অনবরত ঝরে যাচ্ছিল বিরহের অশ্রু মালা, পৃথিবী তখন অবাক নয়নে তাকিয়ে দেখছিল আমাদের এই বেদনা বিধুর মুহুর্তটিকে, আকাশে বাতাসে বেজে উঠেছিল বিদায়ের বিষাদিত সুর, আমি আবিরকে শান্তনা দেওয়ার মতো আপাতত কোনো বাণী খুঁজে পেলাম না, শুধু একটি কথাই বলেছিলাম, আবির! তোমার আমার এ বিচ্ছেদ চিরদিনের জন্য নয়, আমাদের দুজনের স্বপ্ন-উদ্দেশ্য এক ও অভিন্ন, দিনশেষে আবার দেখা হবে।
__এরপর ২০১৫ সাল, আমার স্বপ্ন আমাকে তাড়িয়ে আনে ঢাকার ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপীঠ- জামিয়া ইসলামিয়া চর ওয়াশপুর মাদরাসায়, এখানে ভর্তি হয়ে যাই নাহবেমীর জামাতে, জীবনে এই প্রথম শহরের মাদরাসায় আমার পড়াশুনার সূচনা, এখানে আসার পর দীর্ঘদিন পর্যন্ত নিজেকে বড়ই একাকী মনে হয়েছিল, চোখের সামনে ভেসে উঠেছিল অতীতের সব স্মৃতিগুলো, বারবার মনে পড়েছিল প্রিয় বন্ধু আবিরের কথা, কতবার ওর কথা স্মরণ করে অশ্রু ঝরিয়েছি তার কোনো হিসেব নেই! নিজেকে বহুবার প্রশ্ন করেছি- আবির কি পারবে একাকিত্বকে আমার মতো সঙ্গী করে নিতে? সুন্দর ভাবে কাটবে কি ওর আগামী দিনগুলো? নাকি কোনো অশুভ দৃষ্টি এসে পড়বে ওর পবিত্র বদনে! পাল্টে দিবে ওর ভুবন মোহনীয় চরিত্র! ভেঙে দিবে ওর স্বপনীল চেতনা! এসব ভাবনায় বারবার নিজেকে ভাসিয়ে দিচ্ছিলাম চিন্তার গহীন সাগরে, এভাবে ধীরে ধীরে ভাবনাগুলো একদিন ফুরিয়ে যেতে শুরু করলো, স্মৃতিগুলো মলিন হতে লাগলো, পড়াশুনার চাপ, প্রাতিষ্ঠানিক বন্ধন আর নানা মাত্রিক টেনশনের ভীড়ে হারিয়ে যেতে লাগলো অতীতের সব স্মৃতি, ভুলে যেতে শুরু করি অতীতের সব কথা, হয়তোবা আমারই মতো আবিরও ভুলে গিয়েছে সকল ভাবনা, শুকিয়ে গিয়েছে চোখের অশ্রু! দুজনই আপন গতিতে চলছি আপন আপন ঠিকানায়, কিন্তু কারো কাছে কারো খোঁজ নেই, নেই কোনো সন্ধান! এভাবে দীর্ঘ আট বছর পেরিয়ে গেল, কারো সাথে কারো দেখা নেই, সম্পূর্ণ ভুলে গিয়েছি একে অপরকে! মাঝে মাঝে হঠাত কখনো ওর কথা মনে হলে নিজেকে অনেক নিষ্ঠুর মনে হতো, পাষাণ মনে হতো, এখন আর মনে হয় না, এখন আর আগের মতো ভাবনা নেই, আবেগ নেই, বিষাদ বেদনা নেই! কখনো শহরের মাদরাসার ছুটি হলে যখন সেই ছোট সময়ের গ্রামের মাদ্রাসার নিকট দিয়ে চলে যাই তখন হঠাত ভেসে উঠে অতীতের সেই স্মৃতিগুলো, তখন শুধু চেয়ে চেয়ে দেখি আর মনে পড়তে শুরু করে- এইতো সেই মাঠঘাট যেখানে আবির আর আমি খেলেছি গল্প করেছি, এইতো সেই নদী যেখানে একই সাথে গোসল করেছি, এইতো সেই রোড যেখানে একই সাথে সাইকেল চালিয়ে সময় কাটিয়েছি। ধীরে ধীরে সবকিছু মনে পড়তে শুরু করে, কিন্তু এখনে কি আর পাবো প্রিয় বন্ধু আবিরকে!? এতোটা সহজেই কি আমি ওকে ভুলে গেলাম!? বিনা সন্ধানেই চলে যেতে পারলাম এ গ্রাম ছেড়ে!? ভাবতেই যেনো ভিতরটা ধড়পড় করে উঠে, নিজেকে বারবার খামচে ধরি, এভাবেই একজন অপরাধীর মতো নিজেকে সংকুচিত করে ফিরে আসি বাড়িতে, পুনরায় ভুলে যাই হঠাৎ জেগে উঠা অতীতের কথা, ফিরে আসি মাদরাসায়, মগ্ন হয়ে যাই পড়াশুনায়।
___এরপর ২০২২ সাল, একদিন মাদরাসার বার্ষিক পরীক্ষার ছুটি হল, পুরোনো সে রোড বেয়ে বাস এসে থামলো ঐতিহাসিক মাওয়ার ঘাটে, সেখান থেকে লঞ্চে উঠে কাঁঠালবাড়ি ঘাটে এসে অবতরণ করলাম, এদিকে আসরের আযান হয়ে গিয়েছে, পূর্বদিকের একটি টিনের মসজিদে নামাজ শেষ করে বেরিয়ে আসলাম, সামনে বাসস্ট্যান্ড, বরিশাল ফরিদপুর মাদারীপুর একেক জেলার জন্য সারিবদ্ধ ভাবে বাস রাখা, কোনোটি বন্ধ আবার কোনোটি চালু রাখা, ইঞ্জিনগুলো থরথর কাঁপছে, কালো ধোঁয়া আর অসহনীয় গন্ধে আচ্ছন্ন হয়ে আছে পুরো পরিবেশ, সেখানে উসকো খুসকো চুল- জীর্ণ শীর্ণ পোষাক আর ময়লার বোঝা পিঠে নিয়ে দাড়িয়ে আছে কতগুলো পাগল, এদের অনেকেই একা একা কথা বলছে, এখানে বেশিক্ষণ দাড়িয়ে থাকা গেল না, পাশে একটু প্রশস্ত যায়গায় গিয়ে দাড়ালাম, এখানে এসে কি জন্য যেন এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখছিলাম! হয়তোবা বাড়ি ফেরার সহজ কোনো পন্থা খুজছিলাম, হঠাত আমার দৃষ্টিতে পড়ল অদুরে সামনের একটি টিলার উপর, তাতে বসে আছে তরুন বয়সের একজন বালক, এলোমেলো কেশ, ধুলোমলিন চেহারা, কিছুটা ময়লা যুক্ত পোশাক, পেন্টের একটি সাইট উপরে উঠানো আরেক সাইট একটু নামানো, খালি পায়ে মাথা নিচু করে বসে আছে এ ছেলেটি! দেখতে কিছুটা আধ পাগল মনে হলেও চেহারায় আভিজাত্যের ছাপও পরিস্ফুট রয়েছে! কিছুক্ষণের জন্য আমি দাড়িয়ে ওকে নিয়ে ভাবতে লাগলাম, সে-কি কোনো পাগল, না-কি পাগলের বেশে কোনো গোয়েন্দা, না-কি দুঃখ ক্লিষ্টে ভেঙে পড়া কোনো গরিবানা ঘরের ছেলে!? তাকে নিয়ে আমার ভাবনার অন্ত ছিল না, একের পর এক প্রশ্ন তৈরি হচ্ছে মনের মাঝে,
আমি লক্ষ করলাম- কিছুক্ষণ পরপর ছেলটা একটু উপরে তাকিয়ে কী যেনো ভাবছে- এরপর আবার মাথা নিচু করে কাঁদছে! আমার কৌতুহল আরো বেড়ে গেল, আমি আরেকটু সামনে এগিয়ে প্রায় তার কাছাকাছি এসে দাড়ালাম, এবার ছেলটা মাথাটা একটু উপরে উঠিয়ে আমার দিকে ফিরে তাকাল, আমি দেখলাম সে আনমনে আমার দিকে তাকিয়েই আছে, আর মনে মনে কী যেনো ভাবছে! আমি তখন তাকে বুঝতে না দিয়ে অন্য কিছু একটা খোঁজার ভান ধরে নিরবে দাড়িয়ে রইলাম! কিছুক্ষণ পর সে একটু উঠে দাড়ালো, এরপর আমার সামনে এসে দাড়াতে উদ্যত হলো, তার চেহারা দেখে আমার কেমন যেনো মায়া মায়া লাগছে, বড় বড় দুটি অশ্রুসজল চোখে তাকিয়ে আছে আমার দিকে, চেহারার অবকাঠামো অনেকটা ভাল মনে হল, কিন্তু কালো দাগ যুক্ত ধুলোমলিন হয়ে আছে তার চেহারা, চোখ দুটো গর্তে চলে গিয়েছে, হাত পায়ের রগগুলো গ্রীষ্মের পাতা ঝরা বৃক্ষের মতো হাহাকার করছে, মনে হয় বহুদিন ধরে কিছু খায়না- নায়না! আমার দিকে তার এমন অবাক চাহনি দেখে প্রথমে একটু আঁতকে উঠেছিলাম, এরপর জিজ্ঞেস করলাম- ভাই! কিছুকি বলতে চাচ্ছেন?
আমি তার উত্তর শোনার অপেক্ষায় ছিলাম,
কিছুক্ষণ পর সে হ্যা সূচক মাথা নাড়িয়ে বলে উঠলো- ভাই! আপনাকে না কেমন যেনো আমার চেনা চেনা লাগছে! আমি একটু অবাক হলাম, মনে মনে ভাবলাম কী বলছে এই পাগলটা!?
জিজ্ঞেস করলাম, কিভাবে? সে আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে আবার জিজ্ঞেস করলো- তুমিকি এইযে এখানকার একটা মাদরাসায় পড়েছ না? আমি বললাম হুম্ম, একসময় পড়েছি, তা আপনি জানেন কিভাবে!? এবারও সে আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে পুনরায় জিজ্ঞেস করল- তোমার নামকি তায়েব? আমি বললাম হুম্ম, আপনি দেখি আমার নামটিও সঠিক বলে দিলেন! কিন্তু আমি তো আপনাকে চিনতে পারিনি!
আমি দেখলাম সে চুপকরে আমার দিকে আনমনে তাকিয়ে আছে, আর তার দুচোখে অশ্রু টলমল করছে, সামনের দাঁত দ্বারা ঠোঁট কেটে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে, কেমন যেনো আমাকে জড়িয়ে ধরার ইচ্ছে তার, কিন্তু আমি যে এখনো তাকে চিনতে পারিনি তাই নিজেকে দমিয়ে রেখেছে। আমি আবার তাকে জিজ্ঞেস করলাম- কে আপনি ভাই, পরিচয় দিচ্ছেন না কেন!? আমার প্রশ্ন শুনে এবার সে কান্না জড়িত কন্ঠে বলে উঠলো- তায়েব, তুমিকি আমাকে চিনতে পারোনি? আমিতো তোমার সেই ছোট্ট সময়ের প্রিয় বন্ধু আবির!
তার উত্তর শুনে আমি হঠাৎ চমকে উঠলাম! কেমন যেন আসমান ভেঙে আমার মাথায় এসে পড়লো! তার চেহারার অবয়ব দেখে কিছুটা চিনতে পেরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলাম, এবার আমি ওকে চিনতে পেরেছি ভেবে আমাকে জড়িয়ে ধরে আরও জোরে কান্না শুরু করে দিল, কাঁদতে কাঁদতে বুকে ঢেকুর উঠে গেল আবিরের, আমিও অনবরত কেদেই যাচ্ছি, পুরো পৃথিবীই যেনো আমাদের দু’জনের সাথে কাঁদছে! কিন্তু আমি নিজেকে মানিয়ে নিতে পারছিলাম না, কিভাবে আবিরের এহেন দশা হলো! কি করে এমন পরিনতি ঘটলো! এমনকি ওকে জিজ্ঞেস করার ভাষাও হারিয়ে ফেললাম! অনেক্ক্ষণ পর শুধু এতটুকুই বলতে পেরেছিলাম- আবির! আমিতো কিছুই বুঝতে পারছি না, কি করে তোমার এমন দশা হলো? কিন্তু আবির কিছুই বলতে পারছে না, অনবরত ফুপিয়ে ফুপিয়ে কেঁদেই যাচ্ছে, সূর্য তখন পশ্চিমে ডুবে যাওয়ার কাছাকাছি, রক্তিম রঙে ছেয়ে আছে পুরো আকাশটা, আমার মনে পড়ে গেল আজ থেকে দীর্ঘ আট বছর আগের কথা, যখন এমনি একটি মুহূর্তে আমি ও আবির দারুল উলূম মসজিদের সিডিতে বসে বিদায় বিরহে কাঁদছিলাম আর ভাবছিলাম- আর কোনদিন দেখা হবে কি প্রিয় বন্ধু আবিরের সাথে? আর কোনদিন গল্প হবে কি? খেলা হবেকি একই সাথে? হ্যা সে আবির আজ পুনরায় আমার সামনে দাড়িয়ে আছে, কিন্তু আমি বিশ্বাস করতে পারছি না, এই কি সে আবির? যার শারীরিক সৌন্দর্যতায় মুগ্ধ হয়ে একসময় বনের পরিরাও থমকে দাঁড়াতো! যার ভুবন মোহনীয় চরিত্রে গোটা এলাকাই ছিল মাতোয়ারা! যাকে একনজর দেখার জন্য কতো লোকই ছিল পাগলপারা! তার আজ এমন পরিনতি হলো কিভাবে? আবির নিজেও ভাবতে পারছে না এসব! বুঝতে পারছে না কিছুই!
কিন্তু আমি তো ঠিকই অনুমান করে নিয়েছি এর বাস্তবতা, নিঃসন্দেহে কোনো অশুভ দৃষ্টিতে পড়েছে প্রিয় বন্ধু আবির! হয়তোবা কোনো অভিশপ্ত চাহনির কাছে বিলীন হয়ে গিয়েছে ওর স্বপ্ন, মলিন হয়ে গিয়েছে ওর চরিত্র, তবুও কোনো বুঝমান হৃদয়ে তার জন্য হাহাকার উঠেনি, কারো কাছ বলতে পারেনি ওর সুখ দুঃখের টুকরো টুকরো স্মৃতি কথন, কেউ কখনো নিঃস্বার্থ ভাবে ওর ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করেনি, এটাইতো এ সমাজের অপ্রিয় সত্য কথা, যেখানে বুঝমানদের কাছেই পরাজিত হয় অসংখ্য অবুঝমানদের স্বপ্ন!
এখন হয়তোবা আবির বুঝতে শিখেছে, কিন্তু এ বুঝ ওর আফসোস আর পরিতাপ বৃদ্ধি ছাড়া
এখন আর কোনো কাজে আসে না, হয়তোবা জীবনে ওর আর কোনো স্বপ্ন নেই, বেচে থাকার ইচ্ছেও নেই, আত্নহত্যা যদি পাপ না হয়ে কোনো পুণ্যেময়ী কাজ হতো তবে সেটাই হতো ওর স্বপ্ন!
__চারিদিকে পূর্ণতায় ছেয়ে আছে বিদায়ী পরিবেশ, বারবার শুধু অতীতের কথা মনে পড়ছে, মনে পড়ছে বিষাক্ত অনুভূতির ছোবলে বিলীন হয়ে যাওয়া একটি জীবনের কথা, যাকে ছাড়া একসময়ে আমার খাওয়া দাওয়া ঘুরাফিরা সবকিছুই পড়ে থাকতো, এখন তার বেহাল দশা দেখে নিজেকে একজন মস্ত বড় অপরাধী মনে হচ্ছে, অসহনীয় আত্মপীড়ায় জর্জরিত হয়ে নিজেকে শুধুই প্রশ্ন করে যাচ্ছিলাম- কিভাবে আপন স্বপ্ন পুরোনের জন্য বন্ধুকে রেখে এভাবে চলে যেতে পেরেছিলাম! যেখানে স্বল্প সময়ের ব্যাবধানে বিলীন হয়ে গেল আরেকটি স্বপ্ন! প্রকৃত বন্ধুতো দুটি হৃদয়ের একটি অভিন্ন মনের নাম, তাহলে এই কি ছিল বন্ধুত্বের অমর বন্ধন? এইকি ছিল কাঙ্ক্ষিত জীবনের পরাজয়? প্রশ্নগুলো আজীবন থেকেই যাবে- যার কোনো সমাধান আজও খুঁজে পাওয়া যায় না।