লাল মোরগ ও ফকিরের কেরামতি

0
74

অলিউর রহমান ফিরোজ


একটি লাল মোরগের রক্ত। দু’টি লুঙ্গি এবং একটি গামছা। তাবিজ-কবজ লিখতে মেশকো জাফরান কালি।
এমনই কয়েকটি জিনিসের লিস্ট ধরিয়ে দিলেন ওয়াজেদ ফকিরের কাছে তদবির নিতে আসা চম্পা
বেগমকে। তখকার সময়ে ১ তোলা জাফরানের দাম ছিল এক হাজার সাতশত টাকা। চম্পা বেগম জিনিস
পত্রের তাগাদা পেয়ে লুঙ্গি আর গামছা কিনে বিরস বদনে ফিরে এলেন। তিনি লাল মোরগের দেখা পাননি।
তদবির নিতে আসা চম্পা বেগম সারা বাজার ঘুরেছেন একটি লাল মোরগের জন্য। কিন্তু না। বাজারের
অলিগলিতে ঘুরেও লাল মোরগের দেখা তিনি পাননি। তাই তো বিরস মুখে তিনি ফিরে এসেছেন। আর
মেশকো জাফরান ওয়াজেদ ফকির নিজে আনবেন বলেছেন। তদবির নিতে আসা চম্পা আসল মেশকো-
জাফরান চিনবেন না বলে ওয়াজেদ ফকির নিজেই কিনে দিবেন বলেছেন। তাকে শুধু এক হাজার সাতশত
টাকা পরিশোধ করলেই হবে।
ওয়াজেদ ফকির মিরাপাড়া এলাকার নামকরা একজন ফকির। বাঁশ ঝাড়ের নীচে একটি ঘুপড়ি ঘরে বসে
তিনি মানুষের বিভিন্ন অধ্যাত্মিক চিকিৎসা দিয়ে থাকেন। তার জলসা ঘরে সব সময়ই জম-জমাট
একটা ভাব থাকে। তার কিছু সাঙ্গ-পাঙ্গ রয়েছে। তারাই মজমা মিলায়। আর ওয়াজেদ ফকির লাল কালিতে
তাবিজ-কবজ লিখে থাকেন। তার কবিরাজী করার জন্য তাবিজ কবজের নকশা আঁকা বই রয়েছে। তিনি
কোন ধরনের পড়াশোনা করেননি। নকশাই তার একমাত্র সম্বল। যে কোন রোগেরই তিনি চিকিৎসা দিয়ে
থাকেন। মাঝে মাঝে কেউ যদি ভালো হাদিয়া দিতে পারে তার জন্য তিনি জিন হাজির করে থাকেন। তার
কাছ থেকে রোগের বর্ণনা শুনে চিকিৎসা দেন। তবে তিনি এবার তার প্রতারণার কৌশল একটু আলাদা
করেছেন। গ্রাম থেকে তার পিতা এসেছেন। তাকে ইরি ধানের বøক করার জন্য টাকা দিতে হবে। লুঙ্গি-
গামছা দিতে হবে। আর তাকে পোলাও-মাংস খাওয়াতে হবে। তাই তদবির নিতে আসা চম্পা বেগমকে লাল
মোরগ, লুঙ্গি আর গামছা আনতে বলেছেন। আর কালির জন্য যে এক হাজার সাতশত টাকা দিতে বলেছেন
তাকে। সেই টাকার কালি তিনি কিনবেন না। তিনি কিনে আনবেন ১০ টাকার লাল রং। বাকী টাকা
তিনি মেরে দিয়ে তার বাবাকে ইরির বøক করতে দিয়ে দিবেন। কিন্তু যখনই তদবির কারী চম্পা বেগম
বাজারে লাল মোরগের দেখা পাননি তখন আবার তাকে কললেন, মোরগের গায়ে একটু লাল রং হলেই হবে।
এভাবেই ওয়াজেদ ফকিরের প্রতারণা চলছিল অবলীলায়।
তবে তিনি যে চম্পা বেগমের কাছ থেকে এতো কিছু আদায় করলেন এখন তার কি হবে? তিনি কি ফল
পাবেন? এখানেও ওয়াজেদ ফকিরেরবড় ধরনের তেলেসমাতি রয়েছে। এতো এতো টাকা তার গাঢ থেকে
খসালেন। আর ওয়াজেদ ফকিরের কোন তদবির কাজে লাগবে না তা তো হতে পারে না। তবিরকারী চম্পা বেগম ছিলেন একটি চাতাল কলের শ্রমিক। সেখানকার তাগড়া জোয়ান একজন পুরষ চম্পা বেগমের মনে
ধরেছে। যে করেই হোক সে জোয়ানকে চম্পা বেগমের চা-ই চাই। তাই তো তাকে তাবিজ করে বস
করানোর জন্য ওয়াজেদ ফকিরের দরবারের হাজির হয়েছেন। তার জমানো অনেক গুলো টাকা তিনি খরচের জন্য
দ্বিধা করেননি। ওয়াজেদ ফকির চম্পা বেগমকে একটি তাবিজ আর কিছু পড়া পানি দিয়ে বললেন এটি
আপনি একটি গাছে বাঁধবেন। যেখানে বাতাস চলাচল করে ঠিক সেখানে। বাতাসে তাবিজ নড়বে আর
সে তাকড়া জোয়ানের মনও আপনার জন্য ব্যাকুল হবে। আর পানি পড়া তার আশপাশে ছিটিয়ে দিতে
বলেছেন।
এবার ওয়াজেদ ফকিরের তো কেরামতি দেখানোর পালা। তিনি তার আস্তানার একজকে ডেকে আনতে বললেন।
তিনি হলেন, বিউটি রাইস মিলের জমির। জমিরকে ডেকে আনা হলো। জমির কিছুই বুঁজে উঠতে
পারছেন না। এসে চুপচাপ বসে আছে। ওয়াজেদ ফকিরের বুদ্ধিমতেই সে তাগড়া জোয়ান জমিরকে ডেকে আনা হলো। তাকে যে চম্পা বেগমের মনে ধরেছে সে সব ঘটনা খুঁলে বললো। তবে এতোদিন
চম্পা বেগমের কাছ থেকে ইশারা-ইঙ্গিত পেলে সে কখনোই ভয়ে তাকে পেতে চায়নি জমির। তাছাড়া তার
সংসার রয়েছে। সেখানে স্ত্রী-বাচ্চা রয়েছে। কিন্তু চম্পার এমন ভাবে চাওয়াকে তিনি ফেলেও দিতে
পারেননি। তাই তিনি চম্পা বেগমের সাথে ভাব লীলায় জড়িয়ে পড়লেন।


ওয়াজেদ ফকিরের তাবিজের কেরামতি এভাবেই ফলল। চম্পা খুশির চোটে ফকিরের দরবারে মিষ্টি নিয়ে এসে
হাজির হলো। ফকির তখন জিন নামাচ্ছেন। অন্য একজনের জন্য। ফকির আওড়াচ্ছেন দেও কাটি, বাতাস
কাটি,কাইটা করলাম খান খান, আমার কথা যদি না শুনোস, কামরুক কামাঙ্খার মাথা খাস। ওয়াজেদ ফকির
অবসর হলে তাকে মিষ্টির বাক্স দিয়ে তৃপ্তির একটা হাসি দিলেন চম্পা বেগম। তার তাবিজ কবজে কাজ
হয়েছে। তাই তো তিনি ওয়াজেদ ফকিরের জন্য মিষ্টি নিয়ে এসেছেন। এভাবেই ওয়াজেদ ফকির তার
প্রতারণার লীলা অপকটে চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু প্রকৃতি কোন প্রতারককে কখনোই গ্রহন করেন না।
ওয়াজেদ ফকিরকেও না। একে একে ওয়াজেদ ফকির নির্বংস হতে শুরু করলো। প্রথমে মারা গেল একটি ছেলে।
পরে একটা মেয়ে। তার পরের বছর শেষে মেয়েটিও মারা গেল। তিনি একা হয়ে পড়লেন। তার অপকর্ম যতোক্ষনে তিনি বুজলেন তখন আর কিছুই করার ছিল না। তার সবই শেষ হলো। এভাবেই একজন ওয়াজেদ ফকির ভিটে
বাড়ী ছাড়া হয়ে একেবারে কপর্দকহীন হয়ে পড়লেন। জীবন যন্ত্রণায় তাকে তিলে তিলে কূড়ে কেতে
লাগলো। প্রকৃতি তার আপন মাহিমায় প্রতিশোধ নিলেন। চম্পা বেগমেরা হয়তো সমাজে এভাবেই
অসঙ্গতি ডেকে আনবে একজন ওয়াজেদ ফকিরের মাধ্যমে। আর তার গভীর নিঃশ্বাস ফেলবে সে তাগড়া
জোয়ান জমিরের ঘরের নিরীহ স্ত্রী আর সন্তানেরা।

লিখুন প্রতিধ্বনিতেলিখুন প্রতিধ্বনিতে

Previous articleভিটেমাটি
Next articleফরমান
প্রতিধ্বনি
প্রতিধ্বনি একটি অনলাইন ম্যাগাজিন। শিল্প,সাহিত্য,রাজনীতি,অর্থনীতি,ইতিহাস ঐতিহ্য সহ নানা বিষয়ে বিভিন্ন প্রজন্ম কী ভাবছে তা এখানে প্রকাশ করা হয়। নবীন প্রবীণ লেখকদের কাছে প্রতিধ্বনি একটি দারুণ প্ল্যাটফর্ম রুপে আবির্ভূত হয়েছে। সব বয়সী লেখক ও পাঠকদের জন্য নানা ভাবে প্রতিধ্বনি প্রতিনিয়ত কাজ করে চলেছে। অনেক প্রতিভাবান লেখক আড়ালেই থেকে যায় তাদের লেখা প্রকাশের প্ল্যাটফর্মের অভাবে। আমরা সেই সব প্রতিভাবান লেখকদের লেখা সবার সামনে তুলে ধরতে চাই। আমরা চাই ন্যায়সঙ্গত প্রতিটি বিষয় দ্বিধাহীনচিত্ত্বে তুলে ধরতে। আপনিও যদি একজন সাহসী কলম সৈনিক হয়ে থাকেন তবে আপনাকে স্বাগতম। প্রতিধ্বনিতে যুক্ত হয়ে আওয়াজ তুলুন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here