গাজী আবু হানিফ
অনেক দূর পথ হেঁটে স্টেশনে যেতে হয়।উঠতে হয় কাক ডাকা ভোরে।হাঁটতে হয় প্রায় এক ঘন্টা। কাঁচা উঁচুনিচু রাস্তা।আর বাঁশের সাঁকো আছে কয়েকটি।বর্ষা এলে এই কাদামাখা রাস্তায় পথ চলতে কতো কষ্ট তা এ পথের পথিকেরা জানে।থাকে আছাড় খাওয়ার ভয়।কতোজন যে পিছলে পড়ে কাদায় কাপড় চোপর লেপটে গেছে সেদিনগুলোর কথা এমন অনেকেরই জানা।কখনও পান্তা ভাত,কখনও রুটি, কখনও না খেয়ে ছুটতে হয়েছে কলেজে যাওয়ার জন্য।
৭/ ৮ কিমি রাস্তা হাঁটা কেমন কষ্টের তা ভুলার নয়।তারপর ট্রেনে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে যাওয়া। আবার আসা।অনেক ছেলেমেয়ে দলবেঁধে আসাযাওয়া করতো।হাঁটার ছিল প্রতিযোগিতা। ফেরার পথে মহানগর ট্রেন, টানা হতো শিকল।সুবিধা মতো স্থানে সবাই নেমে যেতো।শশীদল,সালদানদী,মন্দভাগ,কসবার অনেক ছাত্র ছাত্রী সে সময় কুমিল্লা কলেজ ও ভিক্টোরিয়া কলেজে পড়তো।টিটি সাহেবরা এসব দেখে হাসতো।ছাত্রদের কিছুই বলতো না।আর টিকেট তো কাটতোই না।দূরে গেলে কাটতো হাফ টিকেট।
সে সময় ও ছাত্র জীবন কি-না দূরন্ত ছিল। সে স্মৃতি মনে হলে আজও অনেকেরই শরীর শিহরে উঠে।
মেধাবী ছাত্র মোমিন। বাবা ছৈয়লের কাজ করে। গ্রামবাংলায় ঘর ও বাঁশের নানা জিনিস তৈরিতে ছৈয়লরা ছিল সিদ্ধ হস্থ।এক সময় তাদের বেশ কদর ছিল।কালের গর্ভে এ পেশার লোক অনেক হারিয়ে গেছে। এখনও অনেক গ্রামে অনেক হিন্দু ও মুসলমান ছৈয়ল তাদের আদি পেশা ধরে রেখেছে।
তৈরি করে আন্তা,খাড়ি,ডুলা,টুকরী,জুহিন,পুরা,ধানের গোলা,ও কচা।ইত্যাদি।এক সময় কুঁড়েঘর বেশ প্রসিদ্ধ ছিল।শন,খড়,গমের আঁটি দিয়ে এসব ঘরের ছাউনি তৈরি করতো।কেউ কেউ শখের বশে বানাতো বেতের আসবাবপত্রও।এখন এসব আসবাবপত্র অটবিসহ বিভিন্ন ফার্ণিচার মার্কেটে দেখা যায়।যা হয়েছে আভিজাত্যের ও শখের।
মোমিন মা- বাবার একমাত্র সন্তান। দেখাশুনায়ও বেশ স্মার্ট আর ফর্সা।কলেজ থেকে এসে প্রাইভেট পড়ায়।পড়াতো তার হাইস্কুলের এসিস্ট্যান্ট মাস্টারের মেয়ে পারুলকেও।এ পড়ানোর মাঝে দু’ জনার হয়ে যায় মন বিনিময়। কথা হয় বি এ পাশ করার পর বিয়ে করবে তারা।
এদিকে পারুলও কলেজে ভর্তি হয়।মোমিন বি এ পাশ করে এম এ ভর্তি হয়ে যায়। পারুলও আই এ পাশ করে ।উভয়েরই বিয়ের বয়েস। আইনেরও প্রতিবন্ধকতা নেই।পারুলকে বিয়ে দিয়ে দেবে এমন আনাগোনা ও পাত্র দেখাদেখিও চলছে তার পরিবারে।মা-বাবার আদরের সন্তান সে। পারুলকে নিয়ে মোমিনের হতাশার যেমন অন্ত নেই তেমনি পাওয়ার জন্যও মন ব্যাকুল। কিন্তু দু’ জন পবিত্র। প্রেম পবিত্র। এ ভালোবাসা নিখাদ ও সুন্দরের,পবিত্র মনের।জোছনা রাতের স্বচ্ছ আকাশের মতো। কাননে ভোরে ফোটা গোলাপটির মতো।এমন প্রেমের বিয়ে কতজনাই করেছে। মনে মনে সৃস্টিকর্তার কাছে দয়া প্রার্থণা করে।তাকে সাহস আর বুদ্ধি দেওয়ার জন্যে মিনতি করে।
কিন্তু মোমিন গরীবের সন্তান। তাকে তারা মেনে নিবে না।পারুলের বড় দুই ভাই। একজন থাকে ফ্রান্স অন্যজন জাপান।অনেক প্রতিপত্তি মালেক মাস্টার সাহেবের। এ কিছুতেই মিল হতে পারে না।হতাশা সাগরে ডুবছে পারুল আর মোমিন। দেখছে অন্ধকার।চোখে ঘুম নেই। চরম উৎকন্ঠায় কাটছে দিন-রাত। মনে হয় বাদল রাতের সে বিরহী প্রেমিক প্রেমিকার মতো।কবি নজরুলের শিউলী মালার মতো।
তখন উপন্যাস পড়ার প্রতিযোগিতাও ছিল।প্রেমের রোমান্টিক উপন্যাস পড়তে কার না ভালো লাগতো? উপন্যাস ছিল অবসর সময়ের বন্ধু। কলেজ পড়ুয়া ছাত্র-ছাত্রীরা উপন্যাস নিয়ে করতো টানাটানি। উপন্যাস না পড়লে তাকে সবাই অবহেলা করতো।
আর সিনেমা সেতো ছিল বিরাট কিছু। পর্দায় সিনেমা হলে চলচ্চিত্র বা বায়স্কোপ দেখার জন্য লোকজনের ভিড় জমতো। পাগলের মতো দেখতো তখনকার ছেলেমেয়েরা।সিনেমা দেখা মানে বিরাট ব্যাপার ছিল।টেলিভিশন দেখার জন্যও ভিড় জমাতো।বিদ্যুৎ ছিল কেবল শহরে। হারিকেন,কুপি,লন্ঠন আর চেরাগবাতি জ্বালিয়ে ঘর আলো করা হতো।।আর শীতের রাতে চলতো যাত্রা ও পালাগানের আসর।এখন আর সেসব তেমন দেখা যায় না।
কিন্তু পারুল ও মোমিন এমন প্রতিজ্ঞাবদ্ধ তারা বিয়ে করবেই। তাই একরাতে পালিয়ে গেল তারা।পরদিন পড়ে গেলো জনরব।সমালোচনার ঝড় উঠলো স্কুলসহ পুরো এলাকায়। আর তখন এটা ছিল চরম অপমানের। শিক্ষকের মেয়ে বলে কথা। তা ও ধনী পরিবারের। আর ছেলে একেবারে গরীব ঘরের। কোনোমতেই মেনে নিতে পারেনি মাস্টার সাহেব।লোকলজ্জার ভয়ে হয়ে গেলেন জ্যান্ত লাশ।স্কুলেও যায় না।
এভাবে কয়েকটা দিন চলে গেলো। দিনরাত যাচ্ছে দুশ্চিন্তায়। কতো আশা ভরসা ছিলো, মেয়েকে উচ্চ ঘরে বিয়ে দিবে। আত্মীয় স্বজন আসবে,কতো আনন্দ ধুমধাম হবে।আজ এতো আদরের মেয়ে এরূপ করতে পারলো।এ কথা সে কিছুতেই মানতে পারে না।পারে না মনকে প্রবোধ দিতে।ভাবতে ভাবতে বড় বড় দীর্ঘশ্বাস ফেলছে।আর হাউমাউ করে ঘরে কাঁদছে।সব যেনো এলোমেলো হয়ে গেলো।একটা প্রভাবশালী ভদ্র মাস্টার হয়ে গেলো অসহায়।কিছুতেই নিজ ও স্ত্রী এবং ছেলেরা এ বিষয় মেনে নিতে পারছে না। কী করবে স্থিরও করতে পারলেন না।
তাই বাধ্য হয়ে থানায় মামলা করতে গেলেন।
তখন ঐ থানার ওসি ছিলেন মুকসেদুর রহমান। বেশ বয়সও হয়ে গেছে।লোকটা পুলিশ হলেও ধার্মিক এবং সামাজিক সচেতন এক সৌহার্দপূর্ণ মানুষ। বেশ মিশুক।
তিনি বিষয়টি ভালো করে জানলেন।
মাস্টার সাহেবকে সবকিছু খোলে বলতে বল্লেন।মোমিন মাস্টার সাহেবেরই ছাত্র। ওসি সাহেব উভয়ের বয়েসও জানলেন।অনেক ভেবে চিন্তে মাস্টার সাহেবকে বল্লেন,আপনার কলংক যা হবার হয়ে গেছে। তা আর লাখ টাকায় কেনা যাবে।আর আপনার মেয়েও স্বইচ্ছায় চলে গেছে। আমি না হয় এনে দিলাম।আবার চলে গেলো বা কেউ আত্মহত্যা করলো,তখন কি করবেন? এতে সমস্যা আরও বেড়ে যাবে।আর ছিন্ন হলেও কলংক তো মোছা যাবে না।আমার মতে মেনে নিয়ে ছেলেকে সহযোগিতা করে প্রতিষ্ঠিত করে দেন।অনেক বুঝালো মাস্টার সাহেবকে।
অনেক ভাবনাচিন্তার পর বিষয়টি ওসি সাহেবের উপর ছেড়ে দেয় মালেক মাস্টার সাহেব। ওসি ছেলের অভিভাবকদেরও থানায় ডেকে আনেন।
এদিকে এ কথা শোনে পারুল ও মোমিন ভয়ে থ হয়ে যায়। পরস্পর পরস্পরের দিকে তাকিয়ে থাকে চাতক পাখির মতো।না,জানি কি হয়।পরে জানতে পারে ওসি সাহেব মাস্টার সাহেবকে বুঝিয়ে মানিয়েছেন। এ সংবাদ শোনে কষ্টের বোঝা কিছুটা হালকা হয়ে গেলো।তবু বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে তাদের। ফাঁকি দেয় কিনা?না,সব ঠিক ঠাক আছে।হালকা হয়ে গেলো ভারাক্রান্ত মন।
এই কয়েকটা দিনকে এদের মনে হতো কয়েক বছর। আজ পুবের আকাশে কোমল সূর্য হাসছে।ফুল ফোটছে।পাখি গাইছে।নির্মল হাওয়া বইছে।শীত চলে গিয়ে বসন্ত এসেছে। সে দিকে দৃষ্টি পড়লো পারুল ও মোমিনের।বুকের মাঝে আঁধার ঘূচে নৈসর্গিক আলো হাসলো।ওসি সাহেবের ডাকে তারা রাজী হয়ে গেলো।
ছেলেমেয়েকেও থানায় হাজির করেন।তারপর মেয়ের বাবাকে বলেন,থানায় বিয়ে হবে।আমি নিজে বিয়ে দেবো।আর এ খরচ আমি বহন করবো।মেয়ের বাবা তখন স্তব্ধ হয়ে যায়, এ কি বলছেন,ওসি সাহেব।
হ্যা,আমি নিজেই উকিল হবো।
মাস্টার সাহেব – না,না, এ কি বলছেন,ওসি সাহেব।
এই নিন বিশ হাজার টাকা।
ওসি সাহেব তখন এই টাকা ছেলেমেয়ের হাতে দেয়।আর বলে- উভয়ের মা-বাবা ও তোমাদের জন্য পায়জামা পাঞ্জাবি জুতা মৌজা কিনে আনো।ওসি সাহেবের জন্যেও একটা পাঞ্জাবি কিনে তারা।
তারপর কাজী ডেকে থানায় বিয়ে পড়ানো হয়,কাবিননামা হয়।মুহুর্তে থানা প্রাঙ্গন হয়ে উঠে আনন্দে মুখরিত। অন্যান্য পুলিশেরাও নতুন জামাতা বউকে সেলামি দিলো খুশী মনে।আর প্রাণ ভরে দোয়া করলো।
চারদিকে সে ওসির সুনামের ঢল নামে।গণ্যমান্য ব্যক্তিগণ তাকে অভিনন্দন জানায়।
ওসি সাহেব বলেন,বেয়াই সাহেবরা এখন কি করবেন? মাস্টার সাহেব বলেন,ছেলেকে জাপান পাঠিয়ে দেবো।জামাতাকে বাড়ি নিয়ে যাবো।
কয়েক মাসের মধ্যেই জাপান চলে যায় মোমিন। বাবা ছৈয়ল এর কাজ ছেড়ে দেয়।দু’ বছর পর বাড়িতে সুন্দর ইটের পাকাঘর তৈরি করে।জমিজমা ক্রয় করে।ক্রমান্বয়ে বেড়ে যায় সম্পদ।শ্বশুর বাড়ি থেকে দ্বিগুণ ধনী হয়ে যায় মোমিনের পরিবার।
সুখের সংসার চলতে থাকে তাদের। পারুলকেও নিয়ে যায় জাপানে।দুই পরিবার হয়ে যায় এক সুতায় গাঁথা।