তুমি কি আমারই ছিলে?

0
198

ইয়াছিন ইবনে ফিরোজ 

তুষারের হাতে এখনো কফির কাপটা গরম। শীতের সন্ধ্যায় কফিশপের জানালার বাইরে তাকিয়ে আছে সে। রাস্তার ওপারে মেয়েটা দাঁড়িয়ে, লাল শালের ভাঁজে মুখ ঢেকে রেখেছে। নিঃসন্দেহে তৃষা! তুষার উঠে দাঁড়াল, কিন্তু ঠিক তখনই মেয়েটি ঘুরে গেল অন্যদিকে।চার বছর আগের সেই বিকেলটা মনে পড়ে যায় তুষারের,যেদিন তৃষা হুট করে হারিয়ে গিয়েছিল! তাদের প্রেমের গল্পটা ছিল সহজ, কিন্তু বাস্তবতা সহজ ছিল না। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় দুজন একসঙ্গে স্বপ্ন দেখত একটা ছোট্ট বাড়ি, জানালার পাশে বসে চায়ের কাপ হাতে গল্প বলা। কিন্তু তৃষার পরিবার ছিল প্রভাবশালী, আর তুষার ছিল সাধারণ পরিবারের ছেলে। সমাজের চোখে তাদের সম্পর্ক টিকবে না।একদিন তৃষা হঠাৎ করে উধাও হয়ে যায়। কোনো চিঠি, কোনো বিদায়বাণী নয়,শুধু শূন্যতা। তুষার অনেক খুঁজেছে, তৃষার বন্ধুদের জিজ্ঞেস করেছে,কিন্তু কেউ কিছু জানত না। আজ এতদিন পর, তৃষাকে দেখে মনে হলো, সময় যেন থমকে গেছে। কিন্তু সে কি তৃষাকেই দেখল? যদি তৃষা হয়, তাহলে এত বছর পর সে ফিরে এলো কেন?তুষার সিদ্ধান্ত নিল, সে এই রহস্যের শেষ পর্যন্ত যাবে। তৃষা কি সত্যিই ফিরে এসেছে? নাকি এটা কোনো ছায়া মাত্র? আর যদি ফিরে এসে থাকে, তাহলে কেন? ভালোবাসা কি শেষ পর্যন্ত টিকে থাকবে, নাকি অতীতের অন্ধকার সবকিছু গ্রাস করবে? তুষার দাঁড়িয়ে আছে রাস্তার ধারে, তার চোখ এখনো মেয়েটার দিকে। মনে হচ্ছে, তৃষা তাকে দেখেছে, কিন্তু কিছু না বলেই ভিড়ের মধ্যে মিলিয়ে গেল। তুষারের বুক ধুকপুক করতে লাগল। এত বছর পর হঠাৎ তৃষার ফিরে আসার মানে কী? তুষার ছুটে গেল রাস্তা পার হয়ে, কিন্তু মেয়েটিকে খুঁজে পেল না। হতাশ হয়ে সে ফিরতে লাগল, ঠিক তখনই মোবাইলে একটা মেসেজ এল, “আমাকে খুঁজো না, তুষার! সবকিছু যেমন আছে, তেমনই থাক।” নাম নেই, নম্বরও অপরিচিত! তুষার চমকে গেল। এই ভাষা, এই কথার ধরন এটা তৃষা ছাড়া আর কেউ হতে পারে না! সে এবার ঠিক করল, হারিয়ে যাওয়া মেয়েটার পেছনে না ছুটে বরং সত্যিটা খুঁজবে।

তৃষা তার বাবার অফিস কক্ষে বসে ছিল। তার সামনে বিশাল ডেস্কের ওপাশে বসা মধ্যবয়সী পুরুষটি তার বাবা, নাম মাহতাব চৌধুরী শহরের প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ। “তুমি কি জানো, তুমি কার সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করেছ?” “বাবা, আমি তুষারকে ভালোবাসি।” “ভালোবাসা?এই শহরের ক্ষমতার খেলায় ভালোবাসার কোনো জায়গা নেই, তৃষা।” তৃষা চুপ। কিন্তু তার ভেতরটা তোলপাড় হচ্ছিল। মাহতাব চৌধুরী উঠে দাঁড়ালেন, তার গলায় হালকা শীতলতা।”তোমাকে এই শহর থেকে চলে যেতে হবে, আজ রাতেই। নয়তো তুষার আর কখনো এই পৃথিবীর আলো দেখতে পাবে না!” তৃষা ভয়ে কেঁপে উঠল। তুষারকে হারানোর ভয় তার সবকিছু এলোমেলো করে দিল।

তুষার বন্ধু রাহাতকে ফোন দিল।”ভাই, তৃষাকে দেখেছি!” “কি?! তুই নিশ্চিত?” হ্যাঁ! কিন্তু সে আমাকে খুঁজতে নিষেধ করেছে!” রাহাত একটু থেমে বলল, “তাহলে ব্যাপারটা সহজ নয়। তুই সাবধানে থাক।” তুষার এবার সত্য জানার জন্য প্রস্তুত। কিন্তু সে জানে না, এই রহস্যের পেছনে এমন কিছু লুকিয়ে আছে, যা তার জীবন পুরোপুরি বদলে দিতে পারে! তুষার জানে, তৃষা ফিরে এসেছে।কিন্তু কেন লুকিয়ে আছে? কীসের ভয় তাকে তুষারের কাছে আসতে দিচ্ছে না? সে এবার সিদ্ধান্ত নিল, তৃষার পরিবারের অতীত ঘাঁটতে হবে। রাহাতকে নিয়ে সে গোপনে কিছু তথ্য জোগাড় করল। জানতে পারল, তৃষার বাবা মাহতাব চৌধুরীর ব্যবসা শুধু রাজনীতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়।তার সঙ্গে আন্ডারওয়ার্ল্ডেরও সম্পর্ক রয়েছে। শহরের অনেক ব্যবসায়ী এবং রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হয়েছে, আর সবকিছুর পেছনে গুঞ্জন রয়েছে তার নাম! তুষারের মনে পড়ে গেল তিন বছর আগে তৃষা হঠাৎ উধাও হয়ে যাওয়ার পর, তার বাবা তাকে কিছু একটা বোঝাতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তখন সে বুঝতে পারেনি। এবার তুষার সরাসরি মাহতাব চৌধুরীর অফিসের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। তৃষা জানে, তুষার তার খোঁজ করছে। সে জানে, তুষার সহজে ছেড়ে দেবে না। তৃষা একটা পার্কে এসে দাঁড়াল। পাশ থেকে একটা কণ্ঠ শোনা গেল।”তুমি ফিরে এসেছ, কিন্তু তুষারকে জানাতে চাইছ না কেন?” তৃষা ধাক্কা খেল। পেছন ফিরে দেখল, একজন মাঝবয়সী লোক দাঁড়িয়ে আছে, তার বাবার ডান হাত বলা হয় যাকে,রফিক চৌধুরী। “তুষার যদি সত্যিটা জানতে পারে, সে আর বেঁচে থাকবে না!” রফিক ধীর হেসে বলল, “তাহলে তুমি নিজেই কেন তাকে মেরে ফেলো না?” তৃষা শিউরে উঠল! এই মুহূর্তে তার সামনে দুটো পথ এক, তুষারকে সত্যি জানিয়ে পালিয়ে যাওয়া। দুই, তুষারকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে দূরে সরিয়ে রাখা। কিন্তু সত্য কি চিরকাল লুকানো যায়?

তুষার মাহতাব চৌধুরীর অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। রাত গভীর, চারপাশ নিস্তব্ধ। সে ভেতরে যাওয়ার আগেই একটা অচেনা নম্বর থেকে ফোন এলো। “তুষার, ফিরে যাও! দয়া করে আর খোঁজ করো না!”তুষারের বুক ধক করে উঠল। “তৃষা! তুমি কোথায়?” “আমি তোমার জন্য বিপদ ডেকে আনতে চাই না। দয়া করে ফিরে যাও!” “তুমি কি সত্যিই আমাকে ভালোবেসেছিলে?” ওপাশে কিছুক্ষণ নীরবতা। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস “আমি এখনো ভালোবাসি, কিন্তু ভালোবাসলেই সব পাওয়া যায় না, তুষার!”তুষার আর এক মুহূর্তও অপেক্ষা করল না। সে ধীরে ধীরে অফিসের দিকে এগোল। ভেতরে ঢুকে দেখল, রুমের এক কোণে রফিক চৌধুরী বসে আছে। তার সামনে বেশ কয়েকটা ফাইল।রফিক তাকিয়ে হাসল। “তুষার আহমেদ! অবশেষে এলে?” “তৃষা কোথায়?” রফিক হেসে বলল, “তুমি কি জানো, তুমি আসার আগেই সে আমাদের একটা প্রস্তাব দিয়েছে?” তুষার অবাক হয়ে গেল। “প্রস্তাব?” “তোমাকে জীবন থেকে সরিয়ে দিতে বলেছে!”

তুষারের গলা শুকিয়ে এলো। সে বিশ্বাস করতে পারছে না, তৃষা কি সত্যিই এটা করতে পারে? “তুমি মিথ্যা বলছো!” রফিক একটা ফোন বের করল। স্ক্রিনে একটা ভিডিও চালু করল। সেখানে তুষার দেখল তৃষা বসে আছে, তার চোখ বিষণ্ন, কিন্তু সে স্পষ্ট বলছে,”তুষার যতদিন বেঁচে থাকবে, আমার পরিবার শান্তিতে থাকবে না। তাকে দূর করাই ভালো।”

তুষার যেন পাথর হয়ে গেল! তৃষা দ্রুত গাড়ি চালিয়ে একটা পরিত্যক্ত বাড়ির দিকে যাচ্ছে। সে জানে, রফিক যা করেছে, তা মিথ্যা। ভিডিওটা সম্পাদিত, বিকৃত!

সে জানে, তুষার যদি রফিকের ফাঁদে পা দেয়, তবে সে আর বেঁচে ফিরতে পারবে না। কিন্তু সে কি সময়মতো পৌঁছাতে পারবে? তুষার বিশ্বাস করতে পারছে না,তৃষা কি সত্যিই তার মৃত্যুর ফাঁদ তৈরি করেছে? তার মাথার ভেতর আগুন জ্বলছে, কিন্তু হৃদয়ের গভীরে কোথাও একটা বিশ্বাস বলছে,এটা তৃষা হতে পারে না! রফিক চৌধুরী ঠোঁটের কোণে একচিলতে হাসি নিয়ে বলল, “কী করবা তুষার? তুমি কি তৃষাকে বিশ্বাস করবে, নাকি নিজের চোখে দেখা সত্যকে?” তুষার ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল। চোখ দুটো কঠিন, কিন্তু কণ্ঠ স্থির— “তৃষাকে বিশ্বাস করি কি না, সেটা সময় বলবে। কিন্তু তোদের মতো মানুষের ফাঁদে পা দেব না!”রফিক হাততালি দিল। “বাহ! কিন্তু তুই আসলে অনেক দেরি করে ফেলেছিস, ভাই! কারণ…”

ঠিক তখনই দরজা খুলে গেল। তৃষা ছুটে ঢুকে পড়ল। নিঃশ্বাস কাঁপছে তার।”তুষার, এটা একটা ফাঁদ! তুমি আমার কথায় বিশ্বাস করো!”তুষার স্তব্ধ হয়ে গেল। কিন্তু রফিক তখনই পিস্তল বের করে তুষারের দিকে তাক করল! “দুজনকে একসঙ্গে শেষ করাই ভালো।” গোলাগুলির শব্দ বাতাস কাঁপিয়ে দিল। তুষার চোখ খুলতে পারল না। শরীরে যন্ত্রণা টের পাচ্ছে। কিন্তু সে শুনতে পেল তৃষার ফিসফিসে কণ্ঠ, “তুষার, প্লিজ বেঁচে থাকো…” তৃষা তার সামনে বসে আছে, চোখে পানি। তার হাতে রক্ত, আর মাটিতে পড়ে আছে রফিক চৌধুরীর নিথর দেহ! তুষার তখনই বুঝতে পারল—তৃষা সব ছেড়ে এসেছে, শুধু তাকে বাঁচানোর জন্য! তৃষা ফিসফিস করে বলল, “আমি যদি তোমাকে মেরে ফেলতে চাইতাম, তাহলে কি নিজের জীবন ঝুঁকিতে ফেলতাম?” তুষারের চোখ থেকে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল। সে তৃষার হাত শক্ত করে ধরল। “তুমি কি আমারই ছিলে?” তৃষা হাসল। চোখের জল মোছে নিয়ে বলল, “আমি ছিলাম, আছি,আর থাকব।” তুষার আর তৃষা শহর ছেড়ে চলে গেল। নতুন এক জীবন শুরু করল, যেখানে ক্ষমতা বা প্রতিশোধের কোনো জায়গা নেই।শুধু ভালোবাসা আছে। কিন্তু সত্যি কি সব শেষ? অজানা নম্বর থেকে একটা মেসেজ এলো— “খেলা এখনো শেষ হয়নি!”

সমাপ্ত

Previous articleঈদের একগুচ্ছ ছড়া-কবিতা
Next articleআদর্শ পুলিশ 
প্রতিধ্বনি
প্রতিধ্বনি একটি অনলাইন ম্যাগাজিন। শিল্প,সাহিত্য,রাজনীতি,অর্থনীতি,ইতিহাস ঐতিহ্য সহ নানা বিষয়ে বিভিন্ন প্রজন্ম কী ভাবছে তা এখানে প্রকাশ করা হয়। নবীন প্রবীণ লেখকদের কাছে প্রতিধ্বনি একটি দারুণ প্ল্যাটফর্ম রুপে আবির্ভূত হয়েছে। সব বয়সী লেখক ও পাঠকদের জন্য নানা ভাবে প্রতিধ্বনি প্রতিনিয়ত কাজ করে চলেছে। অনেক প্রতিভাবান লেখক আড়ালেই থেকে যায় তাদের লেখা প্রকাশের প্ল্যাটফর্মের অভাবে। আমরা সেই সব প্রতিভাবান লেখকদের লেখা সবার সামনে তুলে ধরতে চাই। আমরা চাই ন্যায়সঙ্গত প্রতিটি বিষয় দ্বিধাহীনচিত্ত্বে তুলে ধরতে। আপনিও যদি একজন সাহসী কলম সৈনিক হয়ে থাকেন তবে আপনাকে স্বাগতম। প্রতিধ্বনিতে যুক্ত হয়ে আওয়াজ তুলুন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here