মোঃ আসিফুর রহমান
গ্রামের কোলঘেঁষা এক দুরন্ত বালক জয়। তার শৈশবের সবটুকু রাঙা হয়েছে গ্রামের চিরসবুজ প্রকৃতির মাঝে। গ্রামের চারপাশে সবুজের সমারোহ, আর পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে কুমার নদীর নির্মল স্রোত। ছোট্ট বয়স থেকেই জয়ের হৃদয়ে খেলাধুলার প্রতি ছিল অপার আকর্ষণ। পাড়ার বন্ধুদের সঙ্গে মিলেমিশে মাঠে-ঘাটে ছুটে বেড়ানো, খেলার আমেজে মেতে ওঠা—এই ছিল তার নিত্যদিনের আনন্দ।
জয় ছিল মেধাবী, পড়াশোনায় অত্যন্ত নিষ্ঠাবান। তার পরিবার ছিল শিক্ষিত, শৃঙ্খলার প্রতি যত্নশীল। পড়াশোনার প্রতি তাদের কঠোর নির্দেশ ছিল—জয়কে অবশ্যই সুশিক্ষায় নিজেকে গড়ে তুলতে হবে। পাড়ার বন্ধুদের পড়াশোনার প্রতি উদাসীনতা থাকলেও জয়ের জন্য তা ছিল অগ্রাধিকার। তাই পরিবার তাকে খেলাধুলোর বন্ধুদের সঙ্গে অতিরিক্ত মেলামেশার সুযোগ দিত না। তবু জয় মায়ের কাছে আবদার করে বিকেলের কিছু সময় খেলার জন্য ছিনিয়ে নিত। কখনো অনুমতি নিয়ে, কখনো গোপনে পালিয়ে, সে মেতে উঠত খেলার আনন্দে।
জয়ের প্রতি পরিবারের সচেতনতা ছিল অপরিসীম। সকালে মক্তবের পড়া, দিনভর স্কুল, প্রাইভেট পড়া—এসবের ফাঁকে তার সময় কেটে যেত। পড়াশোনার চাপে খেলাধুলার জন্য খুব কম সময়ই মিলত। তবু ফাঁকফোকরে যে কিছু মুহূর্ত পেত, তাতেই সে বন্ধুদের সঙ্গে মাঠে ছুটে যেত। শুক্রবার এলেই জয়ের মন উৎফুল্ল হয়ে উঠত। এই দিনটি ছিল তার স্বাধীনতার দিন—পড়াশোনার চাপ থেকে মুক্তি, শুধু খেলাধুলো আর আনন্দের পালা।
জয়ের বাবা, তার পড়াশোনা নষ্ট হওয়ার আশঙ্কায়, প্রতিটি খেলার সামগ্রী কিনে দিয়েছিলেন—ফুটবল, ক্রিকেটের ব্যাট-বল, ব্যাডমিন্টন, ক্যারামবোর্ড—সবই। অবসরে জয় আর তার ভাই মিলে ঘরের আঙিনায় খেলায় মেতে উঠত। কুমার নদীতে গোসলের সময় জয় শিখে ফেলেছিল সাঁতার। নদীর এপার থেকে ওপারে সাঁতার কেটে যাওয়া তার কাছে ছিল রোমাঞ্চকর অভিযান। চাচাদের সঙ্গে মাঠে-ঘাটে ঘুরে বেড়ানো, তাদের কাজে হাত লাগানো, নদীতে বা বিলে মাছ ধরতে যাওয়া, কখনো পুকুরে মাছ ধরার আনন্দ—এসবই ছিল জয়ের শৈশবের অমূল্য স্মৃতি।
জয়ের স্বভাবে ছিল এক অদম্য জেদ। একবার এক বন্ধু তাকে তুলনা করে বলেছিল, “তুই কখনো ওর আগে ক্লাসে রোল আনতে পারবি না।” এই কথা জয়ের মনে গেঁথে যায়। পরবর্তী বার্ষিক পরীক্ষায় সে সেই বন্ধুকে পেছনে ফেলে প্রথম স্থান অর্জন করে। জয় প্রমাণ করে দিয়েছিল—সে হার মানে না, লড়াই করতে জানে। পড়াশোনায় তার কখনো পিছু হটতে হয়নি। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সে ছিল স্কুলের শীর্ষে, হাইস্কুলেও তাই। মেধাবী, নম্র ও ভদ্র জয় ছিল শিক্ষকদের প্রিয়পাত্র। সবাই তাকে স্নেহ করত, তার প্রশংসায় মুখরিত হত। বন্ধুরাও তাকে ভালোবাসত। সকলের ভালোবাসায় সিক্ত ছিল জয়ের শৈশব।
পড়াশোনার জন্য জয় নানাবাড়ি বা আত্মীয়দের বাড়িতে খুব কমই যেত। পরিবারের একমাত্র ধ্যান ছিল তার পড়াশোনা। ইসলামিক শিক্ষার প্রতিও জয় ছিল সচেতন। আজানের ধ্বনি শুনলেই মসজিদে ছুটে যেত নামাজ আদায় করতে। মসজিদের কাজ থেকে শুরু করে সামাজিক কাজে অংশ নিতে ভালোবাসত সে। শৃঙ্খলা ও নিয়মানুবর্তিতার সঙ্গে জীবনযাপন করত ছোটবেলা থেকেই।
এভাবেই কেটে যায় জয়ের শৈশব—প্রকৃতির কোলে, খেলার আমেজে, পড়াশোনার নিষ্ঠায়, আর সকলের ভালোবাসায় মোড়া এক অপূর্ব সময়।