মো.আসিফুর রহমান
সায়ানের ঘরের এক কোণে ছোট্ট টেবিলে জ্বলছে ম্লান আলোর বাতি। টেবিলে ছড়িয়ে আছে কিছু পুরনো চিঠি, একটা শুকনো গোলাপের পাপড়ি, আর সানিয়ার একটি ছবি। সায়ান কলম হাতে বসে আছে, তার চোখে অশ্রু আর হৃদয়ে অসমাপ্ত ভালোবাসার যন্ত্রণা।
সানিয়া, তুমি আমার জীবনে এসেছিলে এক বসন্তের হাওয়ার মতো। তোমার হাসি, তোমার মায়াবী চোখ, আর তোমার মিষ্টি কণ্ঠ আমার পৃথিবীকে রাঙিয়ে দিয়েছিল। আমি ভেবেছিলাম, এই পৃথিবীর নক্ষত্র, আকাশ, নদী, পাহাড়—সব বদলে গেলেও তুমি কখনো বদলাবে না। তুমি বলেছিলে, “সায়ান, আমি সবার মতো নই। আমি থেকে গিয়ে আমাদের ভালোবাসাকে পূর্ণতা দেব।” সেই কথাগুলো আমার হৃদয়ে গেঁথে গেছে। কিন্তু আজ তুমি নেই। নিয়তি আমাদের দু’জনকে দু’দিকে টেনে নিয়েছে।
মনে পড়ে, সানিয়া, আমরা একসঙ্গে কত স্বপ্ন দেখতাম। নদীর ধারে বসে তুমি বলতে, “সায়ান, আমরা একটা ছোট্ট বাড়ি বানাব, যেখানে শুধু আমাদের হাসি আর ভালোবাসা থাকবে।” আমি তোমার চোখে তাকিয়ে সব বিশ্বাস করতাম। তোমার নিষ্পাপ দৃষ্টিতে এমন জাদু ছিল, যা আমাকে অন্ধের মতো তোমার প্রতিটি কথায় ভাসিয়ে নিত। তোমার বুকে মাথা রেখে আমি পৃথিবীর সব দুঃখ ভুলে যেতাম। তুমি আমার মনের সব কথা বুঝতে, আমাকে কিছু বলতে হতো না। কিন্তু আজ, আমার সব ভাবনাকে তুচ্ছ করে তুমি চলে গেলে। আমার স্বপ্নগুলো ভেঙে চুরমার হয়ে গেল।
“হৃদয় ছোঁয়া মানুষটিকে ভুলে থাকা যায়,
ভুলে যেতে চাইলে মনে পড়ে যায়।
সব স্মৃতি গেঁথে আছে মনের কোঠায়।”
ফুল শুকিয়ে গেলে মানুষ ফেলে দেয়, কিন্তু তোমার স্মৃতি, সানিয়া, আমি কীভাবে ফেলব? তুমি আমার হৃদয়ে ফোটা এক অমলিন ফুল। আমি তোমাকে বড্ড ভালোবাসি। তোমার দেওয়া স্মৃতিগুলো আজও আমার কাছে জীবন্ত। আমাদের আর দেখা হয় না, কথা হয় না। দূরত্ব বেড়ে গেছে। হয়তো তুমি ভাবো, আমি তোমাকে ভুলে গেছি। কিন্তু তুমি ভুল ভাবছ, সানিয়া। তোমার স্মৃতিগুলো আমাকে প্রতিনিয়ত কুরে কুরে খায়। আমাদের এক আকাশ ভালোবাসা ছিল। সেই হাসি, সেই স্বপ্ন, সেই মুহূর্তগুলো এখন অতীত। নিয়তির খেলায় আমরা দু’জন দু’দিকে।
তোমার মিষ্টি কণ্ঠ আজও আমার কানে বাজে। কোনো কোকিলের সুর শুনলে মনে হয়, তুমি আমাকে ডাকছ। তোমাকে একপলক দেখার তৃষ্ণায় আমি হাঁপিয়ে উঠি। আমার বুকের মাঝে কালো মেঘের আনাগোনা, চোখে মুশলধারে বৃষ্টি। চোখের নিচে কালো দাগ বলে দেয়, ঘুম ছাড়া কাটছে আমার প্রহর। তোমার অনুপস্থিতিতে আমার হৃদয় কেঁপে ওঠে, যেন ভূমিকম্পে ধরিত্রী। আমার বুক মরুভূমির মতো খাঁ খাঁ করে, ইটের ভাটার মতো জ্বলে। আমি চিৎকার করেও এই যন্ত্রণা কাউকে বোঝাতে পারি না।
আমি তিলে তিলে শেষ হয়ে যাচ্ছি, সানিয়া। তুমি জেনেও নিজেকে আড়ালে রেখেছ। জীবনে কত ঘটনা ঘটছে, কিন্তু কিছুই তোমাকে ভোলাতে পারেনি। পৃথিবীতে এমন কোনো ঔষধ নেই, যা আমাকে তোমাকে ভুলিয়ে দেবে। তোমাকে ভুলবই বা কীভাবে? তোমাকে আমি কখনো ঘৃণা করতে পারি না। মরণের পরেও হয়তো তোমাকে ভুলতে পারব না। পরকালে, হাশরের ময়দানে আমি তোমাকে চাই। আমি তোমাকে ভালোবাসি, পাগলের মতো ভালোবাসি। তুমি আমার অসমাপ্ত ভালোবাসা, যা যুগে যুগে অবিনাশী।
“তুমি আমার মস্তিষ্কে বাঁধা একগুচ্ছ ভালোবাসা,
তোমাকে কখনো যাবে না ভুলা।
হৃদয়ের গহিনে থেকে যাবে সারাজীবন,
এই পারে পাই বা না পাই, ঐ পারে তোমাকে চাই।”
বিষণ্ণ দিনগুলো কাটাতে কাটাতে আমি দিশেহারা। প্রতি সেকেন্ড যেন একেকটা যুগ। কাজে, পড়াশোনায় মন বসে না। আমি পৃথিবীর সবকিছু থেকে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন। আমার পৃথিবীটাই ছিলে তুমি। তোমার অনুপস্থিতিতে এই জগৎ অন্ধকারে ছেয়ে গেছে। আমি হাঁপিয়ে উঠি, যেন এক অসহায় পথিক। তোমাকে ফিরে পাওয়ার তীব্র বাসনা আমার হৃদয়ে। পথের পানে চেয়ে অপেক্ষার প্রহর গুনি। কল্পনায় তোমার ছবি আঁকি, রূপকথার রাজ্য সাজাই। বাস্তবে তুমি ধরা না দিলেও, আমার কল্পনায় তুমি রানি। স্বপ্নে তোমাকে দেখি, ঘুম ভাঙে, চোখ থেকে ঢল নামে, বালিশ ভিজে যায়। আমি ব্যর্থ, সানিয়া, তোমার জীবনে জায়গা করতে পারিনি।
“পাখিটির অপেক্ষায় পথের পানে চেয়ে,
কবে ফিরবে তুমি আপন নীড়ে?”
সানিয়া, তুমি কেমন আছো? কোথায় আছো, জানি না। তুমি যোগাযোগের সব পথ বন্ধ করে দিয়েছ। হয়তো তুমি ভালো আছো। ভালো থাকার জন্যই আমাকে এভাবে রেখে গেছ। কিন্তু যদি মনে হয় আমি ভালো নেই, ফিরে আসো। আমি সব ব্যথা ভুলে তোমাকে বুকে জড়াব। আমার বুকের সব জায়গা তোমার। কেউ তা দখল করতে পারবে না। তুমি আমার অসমাপ্ত ভালোবাসার সমাপ্তি হতে পারতে। কী এমন ক্ষতি হতো?
“আমি তোমাকে নিয়ে মধুময় স্বপ্ন
দেখতাম, যার দিগন্ত ছিল বহুদূর।
প্রেম? সে তো না পাওয়াতে মধুর,
আর ভালোবাসা? সে তো পেয়ে সুমধুর।”
সায়ান কলম থামাল। তার চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। টেবিলের ওপর সানিয়ার ছবিটির দিকে তাকিয়ে সে ফিসফিস করে, “তুমি আমার অসমাপ্ত গল্প, সানিয়া। যার শুরু আছে, শেষ নেই।” বাইরে বৃষ্টি নেমেছে। সায়ানের হৃদয়ের মতোই আকাশ কাঁদছে।