গাজী আবু হানিফ
বিহানবেলা।
আবছায়া লালি আন্ধা শীতের কুয়াশাচ্ছন্ন চারদিক ।পাখির কুজন নেই। নিরব নিস্তব্ধ পথঘাট,মাঠমাঠালি,বাড়িঘর।এমন বিহান বেলায় দৌড়াতে ও হাঁটতে অনেকেই পছন্দ করে। আর স্বাস্থ্যের জন্যে এ মুক্ত হাওয়া আনন্দদায়ক।ঘাসের উপর শিশির জলে রূপার মতো শুভ্র দেখায়।কাঁচা ও পাকা রাস্তার পাশে, লতাপাতায় শিশির জমে ফোটা ফোটা জলও পড়তে থাকে।কীটপতঙ্গের সাড়াশব্দ নেই। নেই জনমানবের কোনো রা শব্দ। ভূতুড়ে একটা ভাব আছে।
প্রতিদিনকার মত বদরুল চৌধুরী ওরফে মনা মিয়া ডাক্তার সাহেব আজও কাপড়ের শো জুতো আর টাওজার জাম্পার, মাথায় মোটা কান টুপি পড়ে বেরিয়ে পড়ল।
আজান পড়লে কোথাও পথের পাশে মসজিদে নামাজ পড়ে ফেলবে।
স্ত্রীকে জাগিয়ে বের হচ্ছি বলে বিসমিল্লাহ বলে বেরিয়ে পড়ল।ভালো করে নিজ আঙিনায় চোখ বুলিয়ে দেখে নিল।কেউ আছে কিনা?
থমথমে বাড়িঘর।পুকুর ও গাছপালা। কুকুর ও বিড়ালেরও ঘেউঘেউ মিউমিউ নেই।
বাড়ির আঙিনা থেকেই খু়ঁছি দৌড় দিলো।আজ যাবে কুড়ের পাড় ও ঈদগাহ মাঠ হয়ে ফিরবে বাড়িতে। যেভাবে দৌড়াচ্ছে মিনিট বিশেক লাগবে বাড়ি পৌঁছাতে। আর তখনি পড়বে আজান।না হয় পথের পাশে ভুইয়া বাড়ি মসজিদে পড়ে নেবে ফজর নামাজ।
যেই কল্পনা সেই চলা।
আঁকাবাঁকা গাঁয়ের পথ।এক পাশে বাড়ি ও অন্য পাশে ধানের মাঠ। কোনো কোনো বাড়ি আবার রাস্তা থেকে এক’শ দেড়’শ মিটার দূরে। আনুমানিক এক কি:মি: যেতেই একটি বরই গাছের নীচে একটি শিশুর ওয়া ওয়া চিৎকার শুনতে পায়। সে থেমে গেল,ভূতের কান্না নাকি?দেখে আবার চিৎকার করে কিনা?টর্চ লাইট মারলো,মারতেই দেখে কাপড়ে কি যেন পেঁচানো? একটু পর আবার চিৎকার করলো।এবার কাছে এগিয়ে গেল,আর কাপড়টা সরাতেই চোখে পড়লো একটি ফুটফুটে নবজাতক।রক্তের দাগও লেগে আছে। মনে হচ্ছে কতক্ষণ আগে জন্মগ্রহণ করেছে।
কি দুর্ভাগা জন্ম তার।হয়তো পিতার স্বীকৃতি নেই। তাই লোকচক্ষুর অগোচরে এ স্থানে রেখে চলে গেছে। কুকুর অথবা শিয়াল দেখলেতো কামড়ে মেরে ফেলতো।না,দূরে থেকে তার নজরদারি করছে কে জানে,নানা জল্পনাকল্পনা মনে করছে সে।আর এমনি পেচানো কাপড়েই কোলে করে বাড়িতে চলে এলো।স্ত্রী ডাক দিলো,বল্ল দরজা খোলো,একটি ছেলে বাচ্চা পেয়েছি।
স্ত্রী মাহফুজা বেগম বাচ্চা পেয়ে আহ্লাদে আটখানা। কেননা,বিয়ের পর চলে গেছে আট বছর।বাচ্চা কাচ্চা হয়নি তাদের। বহু পরীক্ষা নীরিক্ষা ও তদবীর করে যাচ্ছে। কোনো সমস্যাও নেই।
জটপট জল গরম করলো আর ডেটল মিশিয়ে বাচ্চাটিকে ধোয়েমোছে গরম ছেক দিলো।বুকে ঠান্ডা লেগে গেছে। ডাক্তার ড্রপ খাইয়ে দিলো।দূরের একটি মসজিদে আজান পড়লো। সাথে সাথে সব গ্রামের মাইক আজানের সুর লহরীতে জেগে উঠছে।মুসুল্লিরা গা ঝাড়া দিয়ে ফজর পড়তে বিছানা ছেড়ে উঠলো।ঠান্ডা জলে ওজু করতে অনেকের কষ্ট হয়।তাই গ্যাসের চুলোতে একটু জল গরম করে ঠান্ডা জলে মিশিয়ে ওজুর পানি তৈরি করে নেয়।মনা মিয়া ডাক্তারও সেই জলে ওজু করে। আজ আর তা হলো না।ঠান্ডা জলে ওজু সেরে মসজিদে চলে যায়। আর আল্লাহর কাছে শোকরানা আদায় করে।
সকাল হতেই চারদিকে রব পড়ে গেল।মনা মিয়া ডাক্তার একটি বাচ্চা পেয়েছে। দেখতে বাড়িতে নারী শিশু আর পুরুষদের ভীড় জমে গেলো।দোকানপাটেও আলোচনা সমালোচনার উঠে ঝড়।
মাহফুজা বেগম বাচ্চাটির নাম রাখে রফিক। তাকে আদর স্নেহে লালনপালন করতে লাগলো।আল্লাহর কি মর্জি, বছর তিনেক পর মাহফুজা বেগম গর্ভবতী হয়ে গেলো।জন্মালো একটি ছেলে।এভাবে দু বছর অন্তর অন্তর আরও দুটি ছেলে জন্মালো।মেয়ে নেই। পালিত ছেলে নিয়ে মোট চার সন্তানের বাবা হলো মনা মিয়া ডাক্তার।
ছেলেগুলো বড় হতে লাগলো।লেখাপড়া করাচ্ছে। বড় ছেলেটিকে ফাইভ পর্যন্ত পড়ায়ে পারিবারিক কাজে লাগিয়ে দিলো।ভাবছে পালিত ছেলে,এত পড়ায়ে কি লাভ? বাকী তিন ছেলেকে করলো উচ্চ শিক্ষিত।
বড় ছেলেটির বয়স আটারো পার হতেই পাসপোর্ট বানিয়ে মালয়েশিয়ায় পাঠিয়ে দিলো।বিদেশের টাকা আসলো আর নিজের ফার্মেসী ও কৃষি, পুকুরে মাছ চাষ,সব মিলিয়ে ভালোই দিনকাল চলছে।
কিন্তু ছোট ছেলেটি প্রতিবন্ধী হয়ে গেলো।কথা বলতে পারে না।তেমন কোনো কাজকর্মও করতে পারে না।
এক সময় দেখা গেলো নিজের রক্তের ছেলে দু’জন চাকরি ও ব্যবসায় ঢুকে গেলো,আর নিজের পছন্দ মত বিয়ে শাদী করলো।প্রবাসের পালিত ছেলেটিও দেশে চলে এলো,তাকেও বিয়েশাদি করালো।কিন্তু কি হবে? নিজের পুত্রগণ মা-বাবার প্রতি তেমন কোনো খেয়াল রাখে না,টাকাপয়সাও তেমন পাঠায় না।
নানা চিন্তা ভাবনায় ডাক্তার সাহেব অসুস্থ হয়ে পড়েন।
বড় ছেলেটিকে পৃথক করে দেন, আর সামান্য একটু বাড়ির জায়গা দেন,বিল্ডিং ও যাবতীয় সম্পদ তার তিন ছেলের মাঝে বন্টন করে দেয়।
রফিক হায়! হায়! বলে,আপসোস করতে লাগলো। নিজের কাছেও তেমন টাকা পয়সা রাখেনি।দিয়েছে একটি ছোট পুরনো দু’চালা টিনের ঘর।ঘরে কোনো আসবাবপত্রও নেই। নেই বাসনকোসন আর ডেগ ডেগচি । সব নতুন করে কিনতে হয়েছে। মনের মাঝে চাপা কষ্ট। পালক ছেলে।বের করে দিলে কি করবে? মনের কষ্ট মনে রেখে আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইলো।যেহেতু জন্ম থেকেই মা-বাপ হারা,তার ভাগ্য তো এমনিতেই মন্দ।
এ বিচার দেখে লোকজন নানা সমালোচনা করছে।বল্ল,এটা বিবেকহীন কাজ হলো।যার টাকায় বাকী ছেলেদের পড়ালেখা করালো, বাড়িতে বিল্ডিং করলো,তারেই এখন বঞ্চিত করলো।আল্লাহ সইবে না।এভাবে বঞ্চিত করা ঠিক হয়নি।এই ছেলেকে পাওয়ার পরই আল্লাহ আরও তিন ছেলে দিয়েছে। আর্থিক পরিবর্তন হয়েছে।
এক সময় মনা মিয়া ডাক্তার অসুস্থ হয়ে পড়ে।কোমরের তীব্র ব্যথা।ঔষধ খেলে থেমে থাকে। না খেলে বেড়ে যায়। এক সময় চলে যায় বড় ডাক্তারের কাছে।পরীক্ষা নীরিক্ষা করে ধরা পড়ে হাড়ের ক্ষয়।
এভাবে কয়েকমাস পার হতেই অসুখ আরও বাড়তে থাকলো।কোমরের হাড় ক্ষয় বলে কথা।হাটতে পারে না।দীর্ঘক্ষণ এক স্থানে বসে থাকাও নিষেধ। বেশির ভাগ সময় শুয়ে-বসে কাটায়।
ফার্মেসী ছেড়ে দিল।দোকানে এসে ডাক্তারি করা আর সম্ভব নয়।
স্ত্রীও তাকে নিয়ে বেশ ছোটাছুটি করছে।আবার প্রতিবন্ধী ছেলেটি।অসুখ আর কমতির দিকে নেই। দিনে দিনে খারাপের দিকে যাচ্ছে।
হাড় ক্ষয় হতে হতে ক্যান্সারে রূপ নিল।শরীর ফুঁলে গেলো।লোকেরা বলাবলি করতে লাগলো এ অভিশাপ। আল্লাহ তার অবিচারের শাস্তি দিচ্ছে।পালিত ছেলেটার প্রতি জুলুম করা হয়েছে। জুলুমের ভর আল্লাহ সয় না,ইত্যাদি। নানা জনের নানা কথা।
এদিকে চিকিৎসায় অনেক টাকা ব্যয় হচ্ছে।ছেলেরা পিছিয়ে পড়লো।ঠিকমতো চিকিৎসা খরচ চালাতো না।রফিক দিনমজুরি করে সংসার চালায়।তারপরেও যা পারে বাবার চিকিৎসার জন্য যৎসামান্য দেয়।
আরও বছর খানেক এভাবে গড়াগড়ি করে এক সময় মৃত্যু কোলে ঢলে পড়লো মনা মিয়া ডাক্তার।আর রফিক শেষের দিনগুলোতে বেশ দেখাশুনা করতো।কাফনের কাপড়ও কিনে আনলো সে।শহরের দুই ছেলেকে ফোন দেওয়া হলো।ওরা বাড়িতে এসে দাফন কাজ সম্পন্ন করা হলো।
রফিক দিনমজুরি করে যা পায়, তা দিয়ে পরিবার চলে চলে না।এভাবে কেটে যায় পাঁচ ছয় মাস।এ ছাড়া হতাশা আর দুশ্চিন্তায় দুনিয়াকে বড় পর মনে হয় তার।কিছু ভালো লাগে না।সবকিছু আন্ধার লাগে।রাত হলে ঘুম আসে না।অর্ধেক রাতের পর ঘুম ভাঙলে বাইরে বসে বিড়ি টানে।আর আকাশের দিকে ফেলফেল করে তাকিয়ে থাকে।আর বলে, কি সুন্দর চাঁদ! কি সুন্দর চাঁন্দের আলো,তয় মানুষের জীবন এমন সুন্দর হয় না কেনো? নিজের মনে হাজার প্রশ্ন,হাজার কষ্ট বুকে জমাট বেধে আছে।মা ও আগের মত খোঁজ খবর নেয় না।কাছে ডাকে না।পরের ছেলে কি আপন হয়,হয় না।হইলেতো এমন হইতো না।
এক সাগর দু: খ লইয়া পাগলের মত ফুঁতফুঁত বিড়ি টানে।স্ত্রী রাহেলা টের পায়।চোখ খোলে লাইট জ্বালায় দেখে স্বামী ঘরে নাই। দরজার পানে তাকিয়ে দেখে দরজা খোলা। তাই বাইরে বের হয়।দেখে রাস্তার পাশে বসে কে যেন বিড়ি টানছে।চাঁন্দের ফকফকা আলো।ঘরে আসতে ডাক দেয়।বলে: বিড়িটা শেষ করে আসি।কাছে আসতেই রাহেলা বলে:
চিন্তা কইরেন না,আল্লাহর কাছে সম্পদের অভাব নাই। তিনি পাহাড়কে দরিয়া আর দরিয়াকে পাহাড় করতে পারেন।চিন্তা করলে শরীর খারাপ হয়ে যাবে, মন ভেঙে যাবে।যা হবার হইছে।এখন থেকে কাজে লাইগা পড়েন।প্রয়োজনে আবার বিদেশ চইলে যাবেন।এই একটু জায়গা দিয়ে কি হবে? তা বিক্রি করে দিবেন।আমি বাপের বাড়িতে রাছেল আর মণিকে নিয়ে পড়ে থাকবো।
কয়েক মাস যাওয়ার পর রফিক তার বাড়ির অংশটুকু ভাইদের কাছে বিক্রি করে দেয়।সেই টাকা দিয়ে চলে যায় সৌদিতে। আর বউকে শ্বশুর বাড়ি রেখে যায়।আল্লাহর কি মর্জি,তার অবস্থা আয় রোজগার দ্বিগুণ হতে লাগলো।কাজ করে শপিংমলে। কয়েক বছর যেতেই আবার শ্বশুর বাড়ির নিকট বাড়ির জায়গা কিনলো আর বিল্ডিংও করলো।ছেলেমেয়েকে ভালো স্কুলে পড়াশোনা করাতে লাগলো। এক যুগ পার হয়ে গেলো।এখন শহরেও জায়গা কিনেছে। কিনেছে ধানিজমি।তার আর অভাব রইল না।
অপর ভাইদের চেয়ে সম্পদ দ্বিগুণ বেড়ে গেলো।