হুমায়রা আতিয়া
শীতের কুয়াশায় ঢাকা একটা ছোট গ্রাম, যেখানে রাত নামলেই সবাই দরজা-জানালা বন্ধ করে ঘরে ঢুকে পড়ে। গ্রামের শেষে একটা পুরনো বটগাছ, তার নিচে একটা ভাঙা কুয়ো। লোকে বলে, ওই কুয়োর কাছে রাতে কান্নার শব্দ ভেসে আসে। কিন্তু সুহানি এসব গল্পে কান দেয়নি। সে এসেছে গ্রামে তার মায়ের শেষ স্মৃতি খুঁজতে।
সুহানির মা মালতী, পাঁচ বছর আগে হঠাৎ উধাও হয়ে গিয়েছিলেন। কেউ জানে না কী হয়েছিল। পুলিশ খুঁজতে খুঁজতে হাল ছেড়ে দিয়েছিল। সুহানির বুকের মধ্যে একটা জ্বালা, মায়ের হাসি, তার গল্প বলার কণ্ঠ, তার আদরের ছোঁয়া—সব যেন তাকে ডাকছে। সে গ্রামের পুরনো বাড়িতে এসেছে, যেখানে তার শৈশব কেটেছিল।
প্রথম রাত। সুহানি মায়ের পুরনো ডায়েরি হাতে নিয়ে বসেছে। পাতায় পাতায় মায়ের হাতের লেখা, তার ভালোবাসা, আর কিছু অদ্ভুত কথা— “কুয়োটা আমাকে ডাকে। আমি আর পালাতে পারি না।” সুহানির চোখ ভিজে এল। হঠাৎ, জানালার বাইরে একটা শব্দ—মৃদু, কান্নার মতো। সে উঠে গেল। কুয়াশার মধ্যে বটগাছের ছায়া দাঁড়িয়ে, আর কুয়োর কাছ থেকে যেন কেউ ফিসফিস করছে, “সুহানি… এখানে আয়।”
দ্বিতীয় রাত। সুহানি আর থাকতে পারল না। মায়ের একটা পুরনো শাল গায়ে জড়িয়ে সে কুয়োর দিকে এগিয়ে গেল। তার হাতে একটা লণ্ঠন, কিন্তু আলো যেন কুয়াশা ভেদ করতে পারছে না। কুয়োর কাছে পৌঁছতেই সে থমকে গেল। পাথরের ধারে একটা ছোট্ট কাপড়ের টুকরো—মায়ের শাড়ির টুকরো, যেটা সে শেষবার পরেছিলেন। সুহানির বুকটা হু হু করে উঠল। “মা, তুমি কোথায়?” তার কণ্ঠ ভেঙে গেল।
হঠাৎ, কুয়োর ভেতর থেকে একটা কণ্ঠ ভেসে এল, “আমি এখানে, মা।” সুহানি ঝুঁকে দেখল। অন্ধকার কুয়োর জলে তার প্রতিবিম্ব নেই। তার বদলে মায়ের মুখ, ফ্যাকাসে, তাকে দেখছে। “তুই এসেছিস, সুহানি। এখন আমরা একসঙ্গে থাকব।” সুহানির চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ল। সে কুয়োর দিকে এগোল, যেন মায়ের ডাক তাকে টানছে।
তারপর একটা ঠান্ডা হাত তার কবজি ধরল। সুহানি ঘুরে দেখল—কেউ নেই। কিন্তু তার পায়ের কাছে ভিজে পায়ের ছাপ, যেন কেউ তার পাশ দিয়ে হেঁটে গেছে। লণ্ঠনটা নিভে গেল। অন্ধকারে সুহানি শুনল, “আমি তোকে ছাড়ব না, মা।” কণ্ঠটা মায়ের, কিন্তু তাতে ভালোবাসার বদলে একটা অদ্ভুত ক্ষুধা।

সকালে গ্রামের লোকজন কুয়োর কাছে সুহানির লণ্ঠন আর শাল পড়ে থাকতে দেখল। কিন্তু সুহানি আর ফিরল না। কুয়োর কাছে রাতে এখন দুটো কণ্ঠ কাঁদে—একটা মায়ের, আরেকটা তার মেয়ের। গ্রামের লোক বলে, তারা একসঙ্গে আছে, কিন্তু সেই একসঙ্গে থাকায় ভালোবাসা নেই, শুধু একটা অন্ধকার টান।