ব্যাঙরাজা

0
67

গাজী আবু হানিফ

মানুষের যেমন রাজা আছে,তেমনি ব্যাঙদেরও রাজা আছে।রাজা আছে পিপড়ের,হাঁসের, মৌমাছির, সাপের,মাছের,হাতির ও অন্যান্য প্রাণীদের।

এক যে ছিল সুন্দর দেশ।সে দেশের নাম শান্তিপুর।এই দেশে শুধু শান্তি আর শান্তি। সবাই হাসিখুশি থাকে।রাজা- প্রজা ছেলেমেয়ে, নারীপুরুষ, ধনী-গরিব সবাই আনন্দে সুখে শান্তিতে বাস করতে লাগল।মাঠে ধান,গাছে ফুলফল, পুকুরে নদীতে মাছ,গাভীতে দুধ, পথে পথে কত গাড়ি,রিকশা,বাস,ট্র্যাক,রেলগাড়ি। শিশুদের স্কুল, খেলার মাঠ,শিশুপার্ক,আরও কত কি?শহরের রাস্তার মোড়ে মোড়ে ঝর্ণার ফোয়ারা,কত ছবির ভাস্কর্য, সব মিলিয়ে কত অপরূপ এই শান্তিপুর।রাতে চাঁদতারা, দিনে সূর্য ও ফুলের হাসি। মিষ্টি হাওয়ায় ফুলের ঘ্রাণ নাকে এসে লাগে।প্রজাপতি উড়ে বেড়ায় পইপই। পাখিদের কিচিরমিচির, ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে বেড়ায় নীল আকাশে। শিশুরা সে মিষ্টি হাওয়ায় নীল আকাশে রঙিন ঘুড়ি উড়ায়।

শান্তি আর আনন্দ। মানুষেরা এরূপ শান্তি আর সুখে ভুলে গেল দুঃখকষ্টের কথা।শিশুরা ভুলে গেল কান্না।দুঃখকষ্ট কেমন তাদের আর মনে-ই নেই। তবে দুঃখকষ্টের অনেক গল্প শুনেছে তারা,শুনেছে যুদ্ধের কথা, জলোচ্ছ্বাস, সিডর, টর্ণেডো,ঘূর্ণিঝড়,বন্যা,আর রোদে পোড়ে গাছপালা, মাঠের ফসল শুকিয়ে যাওয়ার বাস্তব গল্প।

তারা হাসিখুশি আর মিলেমিশে থাকে।নাচ গান করে।সুন্দর পোশাক পরে।ফুল-ফলের বাগান বানিয়ে দেশটাকে সাজিয়ে রাখে।রাস্তা-ঘাট, ঘরবাড়ি, কত রঙে সাজানো। ছায়া-মায়ায় বিচিত্রতায় সবুজে সবুজে কত না মনোরম এই দেশ। শান্তিপুর মানে শান্তিপুরই।তার এমন রূপ পরিবেশ কে ভুলতে পারে? তাদের দেশে বেড়াতে আসে কত দূর দেশের মানুষ। দেখে অবাক হয়।অতিথি দেরও তারা আদর যত্ন করে,তাদের জীবনের সুখশান্তি দেশের কথা বলে।আরও গল্প করে।

অনেকেই এদেশের এমন রূপ দেখে অবাক হয়।জানতে চায় এর কারণ। তারা বলে আমরা হিংসা ঘৃণা বুঝি না।মিথ্যা কথা বলি না।সর্বদা সত্য কথা বলি।কেউ কারো জিনিস চুরি করি না,কারো সম্পদ আত্মসাৎ করি না।কারো সাথে কেউ ঝগড়া করি না। মা-বাবারাও সন্তানদের মারেন না।শিশুদেরও কেউ মারে না।কটু কথা বলে না।শিশুরাও ঝগড়া করে না।শুধু আদর আর আদর করে।পরস্পরকে পরস্পর ভালোবাসে।

শান্তিপুর মানে একেবারেই শান্তির স্বর্গ।

একদিন এদেশের রাজা মাছ শিকার করতে নদীতে গেল।সাথে তার উজির নাজির পাইক পেয়াদা রয়েছে। নদীর তীর ঝোপঝাড়ে ভরা।গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছে।নদীতে অল্প বেগে স্রোত বইছে।স্রোতে স্রোতে মাছেরা ফুট ফেলছে।প্রচুর মাছ নদী থেকে ছোট খালে উঠছে।সাথে আছে ব্যাঙ,পোকামাকড়,সাপ,আরও কত কি?

হঠাৎ রাজার চোখ পড়ল একটি ঝোপের পানে।বাতির মতো মিটিমিটি করে ঝোপের ভেতরটা আলোকিত হয়ে আছে।রাজা কৌতুহল ভরে সে আলোর কাছে এগিয়ে গেল।দেখে একটি ‘মানিক’ পড়ে আছে।যাকে বলে সাত রাজার ধন। রাজা মানিকটি কুড়ায়ে নিল।এ মানিকটি ছিল ব্যাঙ রাজার।ব্যাঙ রাজা পোকামাকড় খেয়ে এসে মানিকটি না পেয়ে খুব হতাশায় পড়ল।অশান্তিতে তার কিছুই ভাল লাগছে না।

লিখুন প্রতিধ্বনিতেলিখুন প্রতিধ্বনিতে

ব্যাঙ রাজার এমন অবস্থায় অন্যান্য ব্যাঙগুলোও মনমরা হয়ে গেল।তাদের মাঝে কানা ঘুষা চল্ল।মানিক খোয়া গেছে। কারোর কোনো কিছুই ভাল লাগছে না।এদেশেতো কিছু চুরি হয় না।হারানো গেলেও পাওয়া যায়। তাহলে এমনটি হল কেন? কে এই ‘মানিক’ চুরি করেছে। কেউ কি দেখেছে?

ব্যাঙ রাজার মানিক হারানোর খবর সবার কাছে পৌঁছে গেল।কীটপতঙ্গ, সাপ,টিকটিকি, আরশোলা, মৌমাছি, ফড়িং, মশা-মাছি সবার রাজ্যে এ খবর ছড়িয়ে পড়ল।সবাই শোণে অবাক। খুব দুঃখ প্রকাশ করল।এদেশেতো চুরি হয় না।তাহলে নিল কে? হারানো মানিক ব্যাঙগুলো হন্যে হয়ে খোঁজল।তারা পুলিশের মত চিরুনি তল্লাশি দিল।না, কোথাও খোঁজে পাওয়া গেল না।কারো কাছে পাওয়া গেল না কোনো খবরও।সকলের মুখ মলিন হয়ে গেল।কেউ ডাকাডাকি করছে না।

একটি লাউয়াডুগি সাপ ব্যাঙদের সভায় গেল।সে বল্ল,আমি দেখেছি এ মানিক কে নিয়েছে? ব্যাঙগুলো গ্যাঙ গ্যাঙ করে লাফিয়ে উঠল।তাহলে বল কে নিয়েছে? হ্যা, বলতে পারি,তবে তোমরা কথা দাও বৃষ্টির জন্য ডাকাডাকি, গ্যাঙ গ্যাঙ,ম্যা-অ,ম্যা-অ করবে না।এত বৃষ্টি আর ভাল লাগে না।শুধু বৃষ্টি আর বৃষ্টি। সব ভিজে গেছে। কিছসু ভাল লাগে না।

হ্যা,কথা দিলাম।সমস্বরে বলে উঠল সবাই।
তাহলে শোণ,এ কাজ শান্তিপুরের রাজা করেছে। রাজা মাছ শিকার করতে এসে এটি নিয়ে যায়।
–বল কি?
— হ্যা,আমি ঠিকই বলছি।আমি তখন হিজল গাছের ডালে পেচিয়ে ছিলাম।

ব্যাঙগুলো চুপ হয়ে গেল।রাজার কাছ থেকে এটি উদ্ধার করাও সম্ভব নয়।কে যাবে রাজাপ্রাসাদে?
ব্যাঙেরাতো এ দিকে নিরুপায়। ডাকতেও পারে না।একেবারে চুপচাপ। কোন সাড়া শব্দ নেই। বৃষ্টিও বন্ধ হয়ে গেছে। পুরো শান্তিপুর নিরব।কোন ব্যাঙের রা শব্দ নেই।
কড়া রোদ। দিন,সপ্তাহ, মাস পার হল।বৃষ্টি নেই। রোদের তেজ আরও বাড়তে লাগল। মানুষ, পশুপাখি,গাছপালা, ফুল ফসল,কীটপতঙ্গ সবাই বৃষ্টির জন্য হাহাকার শুরু করল।শান্তিপুরে অশান্তির হাঁক পড়ে গেল।মাঠঘাট ফেটে চৌচির। গাছপালাও শুকিয়ে গেছে। পুকুর, খাল বিল, নদীতেও জল নেই। ধূলোবালিতে দেশটা একাকার হয়ে গেছে। একটু বাতাস ছুটলেই দেশটা ধুলোবালির সাগরে ডোবে যায়।

চারদিকে দেখা দিল মরা আর খরা।দেখা দিল অভাব।লোকজন স্নান করার ও পান করার জল পাচ্ছে না।হায়রে!এ কি হল এদেশে? এত শান্তির দেশে এ অশান্তি কেন এল?

শান্তিপুরের রাজাতো অবাক। এ কি কান্ড! কোন পাপের অভিশাপ? এ অবস্থা কেন?
রাজা ওঝা,বৈদ্য,জ্যোতিষী,বিজ্ঞানী,কবি-,সাহিত্যিক সবাইকে ডাকল। এর কারণ জানার জন্য। কেন বৃষ্টি বন্ধ হয়ে গেল?ব্যাঙদের না ডাকার কারণ কি?সবাইতো হতবাক।কেউ এর কারণ খোঁজে বের করতে পারল না।

লাউয়াডুগি সাপটি তখন একটি গাছের ডালে চুপ করে বসে এসব কথা শুণছিল।সে হঠাৎ হিসহিস করে বলে উঠল, তা আমি জানি।
সবাই গাছের দিকে তাকাল।বল্ল,তাহলে বল,কি করে হল?
তবে কথা দাও,আমাকে মারবে না।হ্যা,কথা দিলাম।তোমরা মানুষ, তোমাদের বিশ্বাস করতে পারছি না।তিনবার সত্যি করে বল,
হ্যা,তিনবার সত্যি করে বল্লাম,মারব না।

–তবে শোন, বলছি।সব ওই রাজামশাইয়ের জন্য হয়েছে। রাজা মশাই ব্যাঙ রাজার মানিক নিয়ে এসেছে। তাই ব্যাঙেরা ডাকা বন্ধ করে দিয়েছে। তাই এ দূরাবস্থার সৃস্টি হয়েছে।
রাজাতো অবাক।তাই নাকি।হ্যা,ঠিকইতো।আমিতো ব্যাঙরাজার মানিক নিয়ে এসেছি।
সত্যি বলছ,লাউয়াডুগি।তোমাকে অনেক ধন্যবাদ।
আমি যে কি ভুল করেছি?কেন লোভ করতে গেলাম? কেন আমার প্রজার মানিক এনেছি? আমরা আর অবাঁধে তোমাদেরকে মারব না।

ব্যাঙ রাজাকে খবর দাও,লাউয়াডুগি। আমি তার মানিক ফিরিয়ে দিচ্ছি। রাজা দলবল নিয়ে নদীর তীরে গেল।ব্যাঙ রাজার মানিক ফিরিয়ে দিল।ব্যাঙগুলো আবার আনন্দে গ্যাঙ গ্যাঙ ডেকে উঠল।আর ডাকা মাত্রই হঠাৎ আকাশ কালো করে ঝরঝর বৃষ্টি পড়তে লাগল।
সবাই আনন্দে ভিজে ভিজে বাড়িতে ফিরল।
শান্তিপুরে ফিরে এল শান্তি।
সবাই আবার আগের মত হাসিখুশিতে সুখে শান্তিতে দিন কাটাতে লাগল।

Previous articleকবিতার এক পাতা || ০২/০৫/২০২৫
Next articleবোনপো
প্রতিধ্বনি
প্রতিধ্বনি একটি অনলাইন ম্যাগাজিন। শিল্প,সাহিত্য,রাজনীতি,অর্থনীতি,ইতিহাস ঐতিহ্য সহ নানা বিষয়ে বিভিন্ন প্রজন্ম কী ভাবছে তা এখানে প্রকাশ করা হয়। নবীন প্রবীণ লেখকদের কাছে প্রতিধ্বনি একটি দারুণ প্ল্যাটফর্ম রুপে আবির্ভূত হয়েছে। সব বয়সী লেখক ও পাঠকদের জন্য নানা ভাবে প্রতিধ্বনি প্রতিনিয়ত কাজ করে চলেছে। অনেক প্রতিভাবান লেখক আড়ালেই থেকে যায় তাদের লেখা প্রকাশের প্ল্যাটফর্মের অভাবে। আমরা সেই সব প্রতিভাবান লেখকদের লেখা সবার সামনে তুলে ধরতে চাই। আমরা চাই ন্যায়সঙ্গত প্রতিটি বিষয় দ্বিধাহীনচিত্ত্বে তুলে ধরতে। আপনিও যদি একজন সাহসী কলম সৈনিক হয়ে থাকেন তবে আপনাকে স্বাগতম। প্রতিধ্বনিতে যুক্ত হয়ে আওয়াজ তুলুন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here