ওমর ফারুক
একদিন বিকেল। গ্রামের আকাশে নরম রঙের মেঘ, বাতাসে এক ধরনের বিষণ্ণতা। স্কুল শেষে নাদিম হাঁটছিল একা, মাথায় ঘুরছিল ক্লাসে আজ শিক্ষকের বলা কথাগুলো—
“কেউ কেউ আছেন, যারা মৃত্যুর পরেও হারিয়ে যান না। তারা থাকেন আমাদের মাঝেই—অদৃশ্য, অথচ জীবন্ত।”
নাদিম ভাবছিল—এরা কারা? মানুষ মারা গেলে তো কবরে যায়। তাহলে তারা কীভাবে বেঁচে থাকে?
সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে দাদুর পাশে বসে সে জিজ্ঞেস করল,
“দাদু, কেউ মারা গেলে কীভাবে বেঁচে থাকতে পারে?”
দাদু একটু চুপ করে থাকলেন। তারপর ধীরে ধীরে উঠে গেলেন ঘরের কোণায়। একটা পুরোনো কাঠের বাক্স খুললেন। ভেতরে ছিল কয়েকটি হলুদ হয়ে যাওয়া চিঠি, একটি ছেঁড়া পতাকা, কিছু ব্যাজ আর ছোট্ট একটা নোটবুক।
দাদু মৃদু হেসে বললেন,
“এই জিনিসগুলোর মালিকদের কেউ চিনে না। কোনো বইয়ে নেই তাদের নাম। কিন্তু তারা এমন কিছু করে গেছে, যা মানুষ কখনো ভুলতে পারে না।”
নাদিম বলল, “কী করেছে তারা?”
দাদু চোখ বন্ধ করে বললেন,
“তারা নিজেদের জীবন দিয়ে দিয়েছে, যেন অন্যরা হাসতে পারে, স্কুলে যেতে পারে, ঘুমাতে পারে নিশ্চিন্তে। তারা নিজের জন্য বাঁচেনি, দেশের জন্য বেঁচেছে। মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছে, কিন্তু দেশের মাথা নিচু হতে দেয়নি। তাই তো বলি—তারা অমর।”
নাদিম চুপ করে শুনছিল। তার মনে হচ্ছিল, যেন সেই মানুষগুলো এখনো ঘরের কোণায় দাঁড়িয়ে আছে—নীরবে, গর্ব নিয়ে।
দাদু বললেন,
“তাদের কোনো কবর চেনা নেই, কোনো মূর্তি নেই। তবুও তারা আছে—তোমার সাহসে, তোমার ন্যায়ের পথে হাঁটার সাহসিকতায়। যখন তুমি ভয় না পেয়ে সত্য বলবে, জানবে—তারা তোমার পাশে আছে।”
রাতের আকাশে তখন একটা তারা জ্বলজ্বল করছিল। নাদিম জানে না তার নাম। তবুও তার মনে হচ্ছিল, সেই তারা-ই একজন অমর।
সেদিন রাতে সে নিজের ডায়েরিতে লিখে রাখল:
“মৃত্যুর পরেও যাদের নাম ইতিহাসে—
তারাই তো অমর।
তারাই তো জীবিত।
তারাই তো দেশের বীরপুরুষ।
যারা নিজের কোমল প্রাণ বিসর্জন দিয়েছে দেশের টানে,
তারা চিরজীবী—মানুষের হৃদয়ের ভেতর।
সময় বদলায়, মানুষ বদলায়,
কিন্তু অমররা থেকে যায়… নিঃশব্দ, কিন্তু অমোঘ হয়ে।”
