এস. এম. মারদিন রহমান
আবির জন্মেছিল ঢাকার উপকণ্ঠে এক ছোট গ্রামে, এক দরিদ্র কিন্তু পরহেজগার পরিবারে। তার বাবা ছিলেন একজন সৎ ও পরিশ্রমী মানুষ। রোজ সকালে ফজরের আজান শোনার পরই ঘুম থেকে উঠতেন, মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়তেন, তারপর হাটে গিয়ে সবজি বিক্রি করতেন। তিনি কখনো অন্যায় রোজগার করেননি, কখনো কারও হক নষ্ট করেননি। তার জীবনের মূলমন্ত্র ছিল: “সৎ পথে থাকলে আল্লাহ কখনো বিপদে ফেলেন না।”
আবিরের মা-ও ছিলেন তেমনি একজন মহীয়সী নারী। তিনি পর্দাশীল, দয়ালু এবং খুবই আল্লাহভীরু ছিলেন। কষ্টের সংসার হলেও কখনো অভাব নিয়ে অভিযোগ করতেন না। প্রতিদিন সকালে ছেলেকে পড়তে বসাতেন, দুপুরে হালকা খাওয়া দিয়ে বাবার জন্য খাবার রাঁধতেন, সন্ধ্যায় কুরআনের শিক্ষা দিতেন। ছোট্ট দুই রুমের ঘরে তাদের সংসার—কিন্তু ভালোবাসা, আন্তরিকতা, এবং পরস্পরের প্রতি বিশ্বাসে কোনো ঘাটতি ছিল না।
আবির পড়ত স্থানীয় মাদরাসায়। ক্লাসে সে ছিল শান্ত, চুপচাপ। কখনো উচ্চস্বরে কথা বলত না, কারো সাথে ঝগড়া করত না। কিন্তু একনিষ্ঠতা ছিল অতুলনীয়। শিক্ষকরা বলতেন, “আবির বড় হয়ে মানুষ হবে, ইনশাআল্লাহ।” তার বন্ধুরা যখন ক্লাস ফাঁকি দিত, সে তখন মসজিদের পাশে বসে বই পড়ত।
একদিন মাদরাসা থেকে ফেরার পথে আবির এক শিশুকে দেখল—সে রঙিন নতুন জামা পরে খেলছে। জামাটা দেখে আবিরের মন খারাপ হয়ে গেল। সে ভাবল, “আহ, আমারও যদি এমন একটা জামা থাকত!”
সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে বাবাকে বলল, “আব্বু, আমার জন্মদিনে একটা ভালো জামা লাগবে। আমি অনেকদিন ধরে চাইছি।”
বাবা একটু দম নিয়ে বললেন, “বাবা, টাকার অবস্থা খুব খারাপ। এই মাসে বাজারের দেনা পরিশোধ করতে হবে। তবে তুমি আল্লাহর কাছে চাইতে পারো। উনি যেটা ভালো মনে করবেন, দেবেন।”
আবির প্রশ্ন করল, “আল্লাহ সত্যিই শুনেন?”
বাবা হেসে বললেন, “হ্যাঁ বাবা, আল্লাহ সব শোনেন। আমাদের চোখে অদৃশ্য হলেও, তিনি সব দেখেন। তিনি আমাদের মনের কথাও জানেন। তুমি নামাজের পর দোয়া করো। ইনশাআল্লাহ, তিনি তোমাকে দেবেন।”
সেই রাতেই আবির মাগরিবের নামাজ পড়ে হাতে তুলে দোয়া করল:
“হে আল্লাহ, আমি একটা নতুন জামা চাই। আমি খুব খুশি হবো।”
এরপর প্রতিদিন সে নিয়মিত নামাজ পড়ত এবং দোয়া করত। মা হাসিমুখে দেখতেন, বাবা আশীর্বাদ করতেন।
জন্মদিন এল, কিন্তু নতুন জামা এলো না। আবির চুপচাপ বসে ছিল। সে জানত আল্লাহ শুনেছেন, কিন্তু হয়তো এখনো দেননি। বাবা পাশে বসে বললেন, “হয়তো এখন দেননি, কিন্তু একদিন নিশ্চয়ই দেবেন। সবর করো, দোয়া করো, চেষ্টা করো।”
এই ছোট্ট ঘটনার পর থেকেই আবিরের মনে বিশ্বাস জন্মাল—আল্লাহ একদিন নিশ্চয়ই দেবেন। সেই বিশ্বাস ছিল শক্তিশালী, অপার, হৃদয়ের গভীরে গাঁথা।
আবির পড়াশোনায় আরও মনোযোগী হয়ে উঠল। ক্লাসে প্রথম হতে লাগল। পরীক্ষায় একবার গণিত বিষয়ে ৯৯ পায়। বন্ধুরা বলল, “সামনের ছেলের খাতাটা দেখে ১ মার্ক নিলে তো ১০০ হতো!”
আবির শান্তভাবে বলল, “ভাই, এক মার্কের জন্য অন্যায় করতে পারি না। আল্লাহ দেখছেন। আমি যা পেয়েছি, সেটাই আমার প্রাপ্য।”
এই উত্তর বন্ধুরা ভুলতে পারল না। কেউ মাথা নিচু করে ফিরে গেল, কেউ আবার মনে মনে ঠিক করল—আমি আবিরের মতো হবো।
আবির বড় হতে লাগল। কলেজে ভর্তি হলো। তখন সংসারের অভাব আরও বেড়ে গেল। বাবার শরীর খারাপ হতে লাগল, চিকিৎসা খরচ বেড়ে গেল। আবির টিউশন শুরু করল, দিনে দুইটা টিউশন, রাতে পড়াশোনা। মাঝে মাঝে না খেয়ে থাকত, কিন্তু তবুও নামাজ ছাড়ত না, দোয়া করতে ভুলত না।
মসজিদের ইমাম সাহেব একদিন বললেন, “আবির, তোমার মতো ধৈর্যশীল মানুষ খুব কম দেখি। আল্লাহ ধৈর্যশীলদের ভালোবাসেন।”
আবির মনে মনে বলল, “হে আল্লাহ, আমি ধৈর্য হারাব না। তুমি যেটা ভালো মনে করো, সেটাই করো।”
গ্রাজুয়েশন শেষে চাকরির জন্য চেষ্টা শুরু করল। একের পর এক আবেদন করল, কিন্তু কোনো জায়গা থেকে ডাক আসছিল না। কেউ বলল, “ঘুষ দাও”, কেউ বলল, “লোক লাগাও।” কিন্তু আবির বলল, “আমি সৎভাবে চেষ্টা করব, বাকিটা আল্লাহর হাতে।”
অবশেষে একদিন সে একটি গার্মেন্টসে ছোট একটি পদে চাকরি পেল। বেতন কম, কিন্তু সে খুশি ছিল। বাবা-মাকে নিয়ে বসে বলল, “আল্লাহ আমাকে রিজিক দিয়েছেন। আমি শুকরিয়া আদায় করি।”
চাকরিতে সে ছিল নিয়মিত, পরিশ্রমী, সৎ। অন্যরা যখন ফাঁকি দিত, সে তখন দায়িত্ব পালন করত। ধীরে ধীরে বসের নজরে পড়ে গেল। একদিন বস ডেকে বললেন, “আবির, তুমি বিশ্বস্ত। আমি তোমাকে প্রমোশন দিতে চাই।”
আবির চোখ বন্ধ করে বলল, “আলহামদুলিল্লাহ!”
কয়েক বছরের মধ্যে সে ম্যানেজার হয়ে গেল। তারপর একদিন বস বললেন, “আমি অবসর নিতে চাই। তুমি ব্যবসাটা: চালাও।”
বসের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে গার্মেন্টস কিনে নিল আবির। শুরু হলো নতুন অধ্যায়—একজন শ্রমিক থেকে উদ্যোক্তা। ব্যবসার প্রতিটি সিদ্ধান্তে সে আল্লাহর ওপর ভরসা রাখত। কোনোদিন অসৎ পথ বেছে নেয়নি, কারো হক নষ্ট করেনি। তার একটিই নীতি: “ রিজিকের মালিক আল্লাহ, মানুষ তো কেবল তাঁর পাঠানো রাস্তা। ”
বছর দশকের মধ্যে আবিরের গার্মেন্টস বড় ফ্যাক্টরিতে পরিণত হলো। বিদেশে রপ্তানি শুরু করল। হাজারো মানুষ তার ফ্যাক্টরিতে কাজ পেতে লাগল। তিনি নিজেই শ্রমিকদের মাঝে ঘুরে বেড়াতেন, তাদের খোঁজ-খবর নিতেন।
একদিন তার চাচাতো ভাই এসে জিজ্ঞেস করল, “ভাইয়া, তুমি কিভাবে এত বড় হলে?”
আবির ভাইটিকে কোলে নিয়ে বলল, “শোনো, ছোটবেলায় আমি একটা জামা চেয়েছিলাম। তখন পাইনি। কিন্তু আমি দোয়া করতাম, চেষ্টা করতাম, নামাজ পড়তাম। আজ আল্লাহ আমাকে শুধু জামা নয়, হাজার মানুষের রিজিক দিয়েছেন।”
ছোট ভাই বলল, “আল্লাহ এভাবে দেন?”
আবির মুচকি হেসে বলল, “হ্যাঁ, আমরা অনেক কিছু চাই, কিন্তু উনি আমাদের প্রয়োজন বুঝে দেন। আমাদের কাজ হলো চেষ্টা, দোয়া আর সবর করা।”
সেই বছর রমজানে আবির তার ফ্যাক্টরির সকল কর্মচারী ও শ্রমিকদের নিয়ে এক বিশাল ইফতারের আয়োজন করল। সেদিন সে বলল:
“ভাই ও বোনেরা, আজ আমি যা কিছু, সবই আল্লাহর দেওয়া। আমি ছোটবেলায় নতুন জামা পাইনি, কিন্তু আল্লাহ আজ আমাকে এমন অবস্থানে এনেছেন, যেখানে আমি হাজার মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারি। আমি বলি, কখনো হতাশ হবে না। নামাজ পড়ো, দোয়া করো, সৎ থাকো। আল্লাহ কখনো আমাদের ছেড়ে দেন না।”
শ্রমিকেরা চোখের জল নিয়ে বলল, “আমিন।”
আবিরের চোখে আনন্দের অশ্রু ঝরল। সে মনে মনে বলল,
“হে আল্লাহ! তুমি আমার দোয়া শুনেছো। তুমি সত্যিই সব জানো, সব পারো। আমি তোমার শুকরিয়া আদায় করি।”
