রোহানী সাম্য
“য়্যাই মামা, পাঁচশ টাকা ভাংতি হবো?”
প্রশ্নকর্তার এরূপ প্রশ্নে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় রিকশাওয়ালা মামা। একটু বিরক্তির রেশটুকু কপালে রেখেই বলতে শোনা যায় তাকে-
“আগে কইয়া উটবেন না, মামা? সক্কাল সক্কাল রিকশা নিয়া বারাইছি। কন তো এহন ভাংতি ক্যামনে দিমু? বিপদে ফালায় দিলেন দেহি! ”
আকাশ একদম পরিষ্কার। কিছু পাখি মুক্ত আকাশে মুক্তভাবে উড়ছে। তেমন গরম পড়েনি। এই সাতসকালে কোত্থেকে আসবে এত্তগুলা টাকা? দিনের টাকা দিনেই ফুরিয়ে যায় যাদের সংসারে, তাদের সঞ্চয়ের সম্ভাবনা ঢের কমই বটে। দ্রব্যমূল্যের যা ঊর্ধ্বগতি, একজন ধনকুবেরের এককেজি চাল-ডাল কিনতে যত অর্থ ব্যয় করতে হয় , একজন দরিদ্র, ভিখারি, রাস্তার কিংবা ফুটপাতে থাকা মানুষদেরও ওই সমান পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে হয়।
“দেহেন। আশপাশে কোনো দোহানে পাইলেও পাইতে পারেন।” রিকশাওয়ালা বললো।
কিছু কিছু দোকানের ঝাপি খোলা দেখে যাচ্ছে। তিন চারটে দোকানে খোঁজ করেও লাভ হলোনা। তাড়াহুড়োর মধ্যে হাতে নোটটি গুঁজেই হনহন করে হাঁটা শুরু করল ছেলেটি। যেন জোরে জোরে না হাঁটলে ট্রেন মিস করে ফেলবে।
লম্বা, হালকাপাতলা ছেলে। চোখে মোটা কাঁচের চশমা। দূর থেকে দেখে রাগী রাগী অঙ্কটিচারের মতন মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক। গালে আর চিবুকে গোফের রেখাতেই মানানসই লাগছে। গোফ ছাড়া একে মানাতো না। দু-চারটে চুল শুভ্রতার প্রতীক বহন করছে। কপাল বেয়ে কানের পাশ দিয়ে ঘাম ঝরছে। চেক চেক শার্ট পরেছে আজ। খেয়াল করে দেখলো দুটো বোতাম লাগানো হয়নি। তাড়াতাড়ি করে লাগিয়ে ফেললো।
হাতের দিকে তাকিয়ে হাতঘড়িতে চোখ বুলালো সে। সেকেন্ডের কাঁটা নিশ্চুপ, নিস্তেজ, মৃত। কোনো এক অবসরে আনমনে হারিয়ে গেছে ভিন্ন এক জগতে। ছোটবেলা ওর মনে হতো সময়টাকে যদি কোনোভাবে থামিয়ে রাখা যেতো, যদি বন্ধ করা যেতো পাগলাঘড়ির পাগলামি!
একদিন সেই চিন্তায় বিভোর হয়ে পরিকল্পনা করলো বিপুল পরিমাণ চিন্তাভাবনার পরে। নষ্টধরা পুরনো চার দেয়ালের রুমে মাকড়শার জালের পাশে আটকে থাকা দেয়াল ঘড়িটা কীভাবে কাজ করে আজ ও দেখবে। বাড়িতে আজ ওর আব্বু নেই। কেউ ওর হাতে ঘড়িটা দেখবে না। ওর আত্মবিশ্বাস আজকের ঘটনাটি ঘটার সময় কেউ বুঝতে পারবেনা এমন একটা ঘটনা ঘটেছে। হলোও তাই! একটু সময় অন্তর অন্তর সে পাশের রুমে উঁকি দিয়ে দেখছিলো তার মা আসছে কিনা। ও যখনই যে ঘড়ি কারোর হাতে বা বাসায় গিয়ে দেয়ালে দেখত সবসময় খেয়াল করত ঘড়ির ভিতরে ‘QUARTZ’ লেখা। এ বিষয়টি তাকে অনেক চিন্তিত করতো। ও ভাবত সব ঘড়িতেই কেন লেখা থাকবে? সব ঘড়ি তো আর এক কোম্পানির না! বলতোও না কাউকে এই প্রশ্ন। শুনে হয়ত হাসি পাওয়ার কথা। অত্তটুকুন ছোট থাকতে আমি, আপনি, অন্যরা এমন ধারণা পোষণ করতেই পারি। তাইনা?
ঘড়ির স্ক্রুগুলো স্ক্রুড্রাইভার দিয়ে যথারীতি খোলা হলো। ভালোই অনুভূতি হচ্ছিলো তার। আবিষ্কারের নেশার ফাঁদে পরে সে ঘড়িতে মনোযোগ দিলো; টিকটিক টাইপের একটা অদ্ভুত শব্দ কানে আসছে। ও ভাবলো ঘড়িতে বোধ হয় টিকটিকি বাসা বেঁধেছে। ডিমও পাড়ার সম্ভাবনা আছে। যেই ভাবা, সেই কাজ। ঘড়ির স্ক্রুগুলো সব খোলার কাজ শেষ। এবার তার বাকি কাজের পালা। একে একে ঘড়ির মেশিনে ভালোকরে চোখ বুলায় সে। সাদা স্বচ্ছ প্লাস্টিকের ভেতর দিয়ে দেখা যাচ্ছে তিনটা গোল গোল কাঁটার মতন জিনিস বৃত্তাকারে ঘুরছে। একটা আরেকটার সাথে ঘষা খেয়ে আরেকটাকে অল্প পরিমাণে প্রভাবিত করছে। তিল তিল করে এগুচ্ছে তারা। ব্যাটারি খুলে দিলো সে। দেখলো ঘড়ি বন্ধ হয়ে গেছে। আবার ব্যাটারি লাগালো। তখন আবার চলতে শুরু করলো ঘড়ি। বাহ! চমৎকার! আনন্দ পেলো সে। বারবার এমন করে খেলতে লাগলো।
ঘড়ির কাঁচ ভেঙ্গে ফেললো। কিছুক্ষণ সেকেন্ডের কাঁটা আটকে ধরে থাকলো। অনেকক্ষণ খেয়াল করলো যে সময় তবুও গড়িয়ে যাচ্ছে নির্ঝরের মতন। সময় কেন ঘড়ির কাঁটা আটকে রাখার পরও গড়িয়ে যাচ্ছে তা নিয়ে সে হতভম্ব হয়ে গেলো। সূর্য তবুও অস্ত যাচ্ছে পশ্চিমাকাশে। দিনের আলো ক্রমান্বয়ে মুছে যাচ্ছে পৃথিবী থেকে। তবুও কিভাবে? সে চিন্তায় পড়ে যায়। সে হঠাৎ করে নিরাশ হয়ে যায়। এত কষ্ট করার পর, এতক্ষণ ধরে অপেক্ষা করার পরও যদি সময় সময়ের মত চলতে থাকে তবে বৃথা এই অপেক্ষা। পন্ডশ্রম হলো। “এই নিয়েছে ওই নিলো যা, কান নিয়েছে চিলে, চিলের পিছে ঘুরছি মরে, আমরা সবাই মিলে।” কবিতাটির কাহিনীর রূপক হয়ে গেলো এই অপচেষ্টা। ধুর ছাই! মুখটা কালো হয়ে গেলো। খারাপ হয়ে যাওয়া মন নিয়ে সে মেশিনের ভিতরের সব কিছু খুলে ফেললো, আলাদা করে ফেললো একটা আরেকটা থেকে। একের পর এক সবগুলো পার্টস বেরিয়ে এলো ওর হাতে। ও এখন জানে ঘড়ির ভিতরে কী কী আছে। ঘড়ির কাঁটা একটা একটা করে তিনটিই তুলে ফেলল, মেশিনের সবকিছুই ভেঙ্গে গুড়াগুড়া করে ফেললো রাগে-ক্ষোভে। ঘড়িটা এখন অনেক খন্ডে খন্ডিত। অনেকগুলো ভাগ হয়েছে। একটু আগেই যে ঘড়ি দেয়ালে চলছিল স্বাভাবিক নিয়মে আর গতিতে, আর এখন সে ঘড়ি অকেজো, আবর্জনা। ওর আম্মু এতক্ষণে কিছুই টের পায়নি। আর ও এদিকে কত বড় একটা কাজ করে বসে আছে। এই ফাঁকে কখন জানি ওর মা রুমে গিয়ে সময় দেখতে গিয়ে দেখলো দেয়াল ফাঁকা। যে দেয়ালে তাকালে প্রথমে ঘড়িটা চোখে পড়তো, সেই দেয়াল আজ হঠাৎ ফাঁকা কেনো? প্রশ্ন আসে ওর মায়ের মনে। কী ব্যাপার? ভাবলেন হয়ত নিচে পড়ে গেছে। নিচে তাকিয়ে দেখলেন, তবুও নেই। কী হলো দেয়াল ঘড়িটার? এত বছর ধরে পুরনো অভ্যাসের ঘড়িটা আজ হট করে উধাও কীভাবে হয়ে গেলো তা চিন্তার কথা। রহস্যময় লাগছে উনার কাছে। কোনো জিন-টিন নিলোনা তো নাকি? ওরাও আবার সময়মতো কাজ-বাজ করে নাকি? ওদেরও কি অফিসে, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে দেরি করে গেলে কোনো জবাবদিহির শিকার হতে হয়? ওরা কি সময়ের প্রতি সচেতন? আগে কখনো ভেবে দেখা হয়নি এমন করে। নাকি তার হেলুসিনেশন হচ্ছে? তিনি কি স্বপ্ন দেখছেন? সবকিছু কি তার বিভ্রম? উলটাপালটা দেখছেন নাতো?
এক ঘড়ির কথা বলতে গিয়ে আরেক ঘড়ির কাহিনী শোনা হয়ে গেলো। কাহিনীটা ছিল ও যখন ওয়ান-টুতে পড়ত। যাই হোক। আবার আগের জায়গায় ফেরত যাই। রিকশা থেকে নামার পর সময় দেখা হয়নি। সেকেন্ডের কাঁটা যেহেতু থেমে গেছে, তাই ঠিক কটা বাজে বলা মুশকিল। হাতঘড়িতে এগারোটা বাজতে ছয় মিনিট বাকি আছে। ভুল সময়। এখন দেখতে হবে মোবাইল ফোনে কয়টা বাজে? সাতটা চার বাজে। ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ওর বাবা। অবস্থা খুব একটা সুবিধার না।
বাসের ধাক্কায় মাথাতে আঘাত লেগে রাস্তায় পড়ে গিয়েছিলেন তিনি। রাস্তার লোকজন ধরাধরি করে মাথায় পানি ঢালা শুরু করে। তবুও অচেতন হয়ে থাকেন তিনি। দু-তিনজন লোক তাকে রিকশা করে হাসপাতালে ভর্তি করায়। উনার সাদা পাঞ্জাবির পকেটে থাকা ফোনের ডায়াল্ড লিস্টে প্রথমে উনার ছেলে জাহিদের নাম্বার। জাহিদের নাম্বারে কল দেয়া হলো। তাকে একজন লোক কলে জিজ্ঞেস করলো-
“আসসালামু আলাইকুম, ভাই। আপনার নাম কি জাহিদ?”
“ওয়ালাইকুম সালাম। হ্যাঁ, আমি জাহিদ। কিন্তু আমার বাবার ফোন আপনার কাছে কেনো?”
“ও আচ্ছা, ভদ্রলোক আপনার বাবা তাহলে। উনি চরপাড়ার রাস্তায় বাসের সাথে ধাক্কা খেয়ে মাথায় গুরুতর আঘাত পেয়েছেন। উনাকে মেডিকেল কলেজ হসপিটালে এনেছি।”
“আল্লাহ! কী বলতাছেন এইগুলা? তাই তো বলি যে মানুষটা আমাকে দিনের মধ্যে এত্তবার কল দেয় সেই মানুষটা এখনো কল দিলোনা। আপনাদের আমি কী বলে যে ধন্যবাদ জানাবো!”
“সমস্যা নাই। আপনি আসেন। আমরা অপেক্ষা করছি আপনি আসার আগ পর্যন্ত। আপনি আসলে তবেই বের হবো।”
এই বলেই কল কেটে দিলো অজ্ঞাত ব্যক্তি। তড়িঘড়ি করে ঝড়ের গতিতে হাক্কানির মোড় থেকে জাহিদ হসপিটালে রওনা দেয়।
লোকটির কন্ঠ শুনে বেশি বয়সের যে ভাবটা এসেছিল, তেমন একটা বেশি বয়স না লোকটার। বয়স হবেই হয়ত চৌত্রিশ-পঁয়ত্রিশের কাছাকাছি। চুলগুলো ছোট ছোট করে কাটা। দাড়ি-গোফও সামান্য বড়।
ডাক্তারেরা জাহিদের বাবাকে দেখে, পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বলেন-
“দেখেন ভাই, রোগীর অবস্থা ডেঞ্জারাস। এখানে থেকে কী হবে, বলা যাচ্ছেনা। বুঝেনই তো, অবস্থা আরও খারাপ হলে বোগীর জীবন নিয়ে টানাটানি বেঁধে যাবে। তাই বলছি ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যান। আমি রেফারড ঢাকা মেডিকেল লিখে দিয়েছি কাগজপত্রে।”
ডাক্তার সাহেব কথাগুলো একনাগাড়ে বলে গেলেন। জাহিদ খেয়াল করলো কথা বলার সময় ডাক্তারের চখের পলক পড়েনি একবারের জন্যেও। কথা শেষ হতে না হতেই চোখের পাতা বন্ধ হয়ে গেলো ডাক্তারের।
সাদা অ্যাপ্রন পরা। মুখে মাস্ক। গলায় স্টেথোস্কোপ। ডাক্তারী জীবন ব্যাপক কষ্টের জীবন। বেচারা এতক্ষণ ধরে রোগী দেখছিলেন। পাঁচ মিনিটের জন্যে একটু খেতে গিয়েছিলেন। সেই থেকেই শুরু হয়ে গেলো লোকজনের আহাজারি।
“ডাক্তার এতো দেরি করে ক্যান? ডাক্তার গেলো কই? ডাক্তার খালি যায়গা ক্যান? ভাই, ডাক্তার কই গেছে? ডাক্তার কি চইলা গেছে হাসপাতাল থেকে? রোগী দেহা শেষ না কইরাই ডাক্তার গেলোগা? এইডা কেমন ডাক্তার? রোগী দেহা বাদ দিয়া ডাক্তার কই যায় খালি?”
এই টাইপের অনেক কথাবার্তা বলতে শোনা গেলো লোকজনদের।
সারাদিন মানুষ্কে স্বাস্থ্যসেবা দিয়েও শুনতে হয় একরাশ অভিযোগের কথামালা। লোকটার ক্ষুধা লেগেছে শান্তিমতো তো একটু খেতে দিবে নাকি? সারাদিন বসে থাকলেও নাম নেই।
ওরা তাড়াতাড়ি করে এখান থেকে চলে যেতে বলছিলো। একটা এ্যাম্বুলেন্স ডাকা হলো। চাদর বিছিয়ে জাহিদের আব্বুকে শুইয়ে দেয়া হলো। মুখে অক্সিজেন মাস্ক। মাথায় ব্যান্ডেজ পেঁচানো। চোখ বন্ধ। ভদ্রলোকের স্ত্রী-কন্যা দুজন ভদ্রলোকের পাশে, ছেলে আর ছোটভাই ড্রাইভারের পাশে বসলো। এ্যাম্বুলেন্স চলছে ঝোড়ো হাওয়ার গতিতে। এ্যাম্বুলেন্সের উপরের বাতি ক্রমান্বয়ে লাল আলো দিচ্ছে। পুলিশের গাড়ি আর এ্যাম্বুলেন্সের মধ্যে কথায় যেনো মিল! পথ পেরিয়ে, সব ছাড়িয়ে এ্যাম্বুলেন্স যাচ্ছে মাইমেন্সিং ট্যু ঢাকা। এখন পর্যন্ত বলা হলো ঢাকায় পৌঁছানোর কথা।
গল্পটা শুরু হয়েছিলো ঢাকায় অবস্থান করা অবস্থায়। তো ওর ক্ষুধা লেগেছে। মাথা ব্যথা করছে হাল্কা হাল্কা। জাহিদ কেবিন রুমে ঢুকলো। ক্যান্টিন থেকে একটা কেক কিনলো। ভিতরে গিয়ে দেখলো ওর মা কাকে জানি কল দিয়ে বলছে,
“দুআ কইরেন জাহিদের আব্বুর জন্যে।”
বলেই দেখলেন জাহিদ এসেছে। জাহিদকে দেখার পর কল কেটে ফোন রেখে দিলেন তিনি। সে বুঝতে পারছিলোনা কেনো তার মা সে আসাতে কল কেটে দিলো?
“কই গেছিলি, বাবা?”
“আমার এক ফ্রেন্ড এসে বাবাকে দেখতে আস্তে চেয়েছিলো। বেচারা আটকে আছে ট্রাফিক জ্যামে। আমি তো ভেবেছিলাম এসেই গেছে। পরে ও কল দিয়ে বললো ওর নাকি খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ পড়ে গেছে। ভার্সিটিতে কি জানি কারণে ডেকেছে ওকে। তাই সরাসরি ওখানেই চলে যাচ্ছে। পরে এসে আব্বুকে দেখে যাবে বলে দিলো।”
“কে? হুজাইফা’র কথা বলছিস নাকি?”
“হ্যাঁ, মা। মাথা ব্যথা করছে অনেক।”
“রাত্রে ঘুম হয়নাই ভালোমতো। ঘুমিয়ে নিস। আমি আরো তোকে খুঁজতেছিলাম। ফোনটা সাইলেন্ট করে রাখছিলি, তাইনা? খুব জরুরী অবস্থায় কল দিলেও তো পেতাম না তোকে। ফোনটা চালু রাখিস।”
“ও মা, তোমার ওষুধ এনেছি, আনতে বলেছিনা না? একপাতা ছিলোনা আটটা ছিলো, আটটাই এনে পরলাম।”
“আচ্ছা, ঠিক আছে।”
“আব্বু কেমন আছে এখন?”
“ঠিক জানিনা। তবে উনারা বললেন যে সিরিয়াস ইঞ্জুরি। সময় লাগবে।”
সন্ধ্যে পনে পাঁচটা। মাগরিবের নামাজ শেষে লোকজন বাসায় যাচ্ছে। জাহিদ বারান্দায় মাথা দেয়ালে রেখে হেলান দিয়ে শুয়ে আছে। আকাশে মেঘের ঘনঘটা। কালো হয়ে আসছে। চাঁদ চলে গেলো মেঘমালাদের আড়ালে। নক্ষত্রদেরও ভালোমতো খালিচোখে দেখা যাচ্ছেনা। হালকা হালকা মেঘের গর্জনধ্বনি কানে আসছে আর হুট করেই বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। রাস্তার লোকজন দ্রুত হাঁটছে। বৃষ্টির ফোঁটা শরীরে লাগার আগেই পৌঁছুতে হবে নিজের বাড়িতে।
“হাতে নেই ছাতা
ভিঁজবে এই মাথা
আকাশেতে মেঘ
উপর চেয়ে দেখ
হঠাৎ পড়বে বাজ
শেষ করিস সব কাজ
চমকাচ্ছে বিজলি
বিপদ আজ বুঝলি?
আকাশ দেখ অন্ধ
বাঁধবে এক দ্বন্দ্ব
লাগবে জ্বর ঠাণ্ডা
কিনবি না মণ্ডা?
ওই বৃষ্টি আসছে ধীরে
বাসায় যাবিনা কিরে?
তাড়াতাড়ি বাসায় যা
গিয়ে তুই খিঁঁচুড়ি খা।”
বসে বসে কবিতাটি লিখে ফেলাই ভালো কাজ হলো। কবিতা ভাবতে ভাবতে তার চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। কানে ভেসে আসছে নবজাতকের আর্তনাদ। পৃথিবীর আলো দেখে প্রথম কান্না। নিচতলা বা উপরতলা থেকে আসছে। কোত্থেকে আসছে জানার প্রয়োজন মনে হচ্ছেনা তার। ওর মনে পড়লো ওর মায়ের মুখে শোনা কিছু কথা।
যেদিন জাহিদের জন্ম সেদিন ছিলো ঘোর বর্ষা। আকাশের বুক থেকে ঝরছে বারিধারা। মেঘমিলনও ছিল সেদিন। বিজলিমেয়েদের অবাধ প্রবাহটা সেদিন বোধ হয় একটু বেশিই ছিলো। জাহিদের ছোট ছোট দুইটা চোখ। পাতা বন্ধ। ভ্রু নেই। মাথাতে শুধু মাঝখানে চুল নেই, বাকি সব জায়গাতেই চুল আছে। ছোট ছোট হাত, ছোট ছোট পা। মুখে দাঁত নেই, শুধুই মাড়ি। লালচে ঠোঁট। ছোট হৃদপিণ্ডের হাল্কা করে স্পন্দন, ছোট নাক দিয়ে ছোট নিশ্বাস।
নার্স জাহিদের বাবাকে বললো- “আপনি পুত্রসন্তানের বাবা হয়েছেন।“
ওর আব্বু যখন ওকে কোলে নেয় তখন দুচোখ বুঁঁজে ঘুমের রাজ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছিলো। প্রথম পিচ্চিকে কোলে নেয়া, প্রথম স্পর্শ করা। নবজাতক পুত্রকে কোলে নিয়ে উনি আযান দেন। আনন্দে আত্মহারা হয়ে কেঁদে ফেলেছিলেন। তার ছেলেকে ঘাড়ে নিয়েই ঘুরবেন, মাথায় নিয়েই ঘুরবেন না কোলে নিয়ে ঘুরবেন ঠিক করতে পারছিলেন না। প্রথমবারের মতন পুত্রসন্তানের বাবা। ছোটবেলা একটা জিনিস সবার ক্ষেত্রেই অবশ্যই দেখতে পাওয়া যায়, তা হচ্ছে খাওয়া আর ঘুম, ঘুম আর খাওয়া। এভাবেই কেটে যায় তাদের সহজ সরল স্বাভাবিক জীবন। দুই-তিন দিন পর হসপিটাল থেকে রিলিজ দেয়া হয় জাহিদের মাকে। নাম রাখে জাহিদের বাবা। জাহিদ মোস্তফা। তার বাবার নামের সাথে মিল রেখে। তারপর গ্রামের বাড়িতে চলে যায় ওরা সবাই। ওর মা সারাদিনই ওকে কোলে নিয়ে থাকে, বাবাও একটুখানি পর পর ছেলেকে কাতুকুতু দেয়। ও একটু পর পর শব্দ করে উঠে। ছেলের জন্যে কিনে আনেন ছোট ছোট কাপড়, ফতুয়া, গেঞ্জি,পায়জামা, জুতো। ছেলেকে ছোট কাপড়ে দেখে মনেই হয়না মাত্র কিছুদিন আগে জন্মানো ছেলে। মনে হয় এক-দেড় বছরের বাচ্চা। গাল ধরে টানাটানি, ঘাড়ে নিয়ে ঘুরে বেড়ানো তো চলেই। পিচ্চি হাসেও মুচকি মুচকি দাঁতবিহীন মাড়ি বের করে। মুখ দিয়ে পানি পরে অনবরত। নাক দিয়েও বাকি থাকেনা। ঠাণ্ডা লেগেছে। দীর্ঘ নয় মাসেরও বেশি সময় নিরাপদ জায়গায় যুদ্ধ করে এখন রণক্ষেত্র ত্যাগ করেছে, ঠাণ্ডা লাগার কথাই। রণক্ষেত্রে ঠাণ্ডা লাগা তো দূরের কথা তিল পরিমাণ রোগও ধারের কাছে ঘেঁষতে পারেনি। রণক্ষেত্র থেকে সরতে না সরতেই বাচ্চার আসুখ ঘাড়ে এসে ভর করলো। আস্তে করে বাচ্চা হাঁচি দেয়, শব্দ তেমন একটা হয়না বলা চলে। বিছানাই তার সঙ্গী। কত রকম ভঙ্গিই না করতে জানে, যেনো সব কিছুই বুঝে!
ওর মা’র সাথে যখন বিয়ে হয় তখন বাড়ি থেকে বের করে দেয় ওর দাদা-দাদি। কষ্ট পেয়ে শ্বশুরবাড়ি থেকে অশ্রুসজল নয়নে বেরিয়ে আসে ওর মা। উনার বাবার বাড়িতে থাকতেন থাকে, আগে যেভাবে থাকতেন। তখন মহিলার বড়ভাইয়ের বউসহ ওই বাড়িতেই ছিলো। জাহিদের একটা বোন আছে। ওর থেকে বয়সে বড়। একদিন যখন সে তার মামির কাছে হরলিক্স দেখে খাওয়ার জন্যে বায়না ধরে, তখন তার মা দেখে এই ঘটনা। ওর মামি হরলিক্স দেয়না তাকে, লুকিয়ে রাখে। ওর মা ওকে ধরে মার দেয় যখন সে বেশি বায়না ধরছিলো তার মামির কাছ থেকে জুনিয়র হরলিক্সের ডিব্বা দেখে। এর পর জাহিদের বোন ভয় পেয়ে যায় ওর মাকে কাছে আসতে দেখলেই। ওর মায়ের থেকে দূরে থাকতে সে বাড়ির গলির পাশে লুকিয়ে থাকতো, যাতে তার মা না দেখে, ও ভাবে যদি ওর মা আবার ওকে মার দেয় তাই। জাহিদের বোন জাহিদকে দাদা বলে ডাকতো। নিজে দুধ না খেয়ে তাকে দিতে বলতো।
ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে সবাই। জাহিদ ওর বাবার হাত ধরে শুক্রবারে জুম্মার নামাজ পড়তে যায়। ছোট পাঞ্জাবি, ছোট টুপি। মসজিদে গিয়ে বাবার কোলে বসে থাকে। নামাজ পড়ার সময় বাবাকে বিরক্ত করা, নামাজের সময় ঘাড়ে উঠা, বাবার দেখাদেখি অনুকরণ করে নামাজ পড়া ইত্যাদি তো চলতোই। বাবার সাথে খেলার সময় ফুটবল শট দিতো আর বাবা পড়ে যাওয়ার ভান করত, জাহিদ দেখে হাসতো। বাবাকে ঘোড়া বানিয়ে ঘাড়ে উঠে ঘুরে বেড়াতো সমস্ত রাজ্য জুড়ে। খেলনা হাঁস-মুরগি, মাছ দিয়ে খেলতে থাকে সে। খেলনা গাড়ি কিনে অনেকগুলো। খেলনার দোকানে গেলে মাথা খারাপ হয়ে যায় ওর। যেটাই দেখে ওইটাই কিনতে ইচ্ছে করে ওর। বাড়ির উঠোনে গড়াগড়ি খায় র মাটি হাতে নিয়ে মুখে দেয়। ওর হাত থেকে ওর খেলনা নিয়ে নিলে কান্না করে দেয়। কোলে নিয়ে ঘুরে বেড়ালে মুচকি হাসে। যাকে চিনেনা তার কোলেও যায়। একবার হয়েছে কি একদিন এক ভিখারী এসেছে ভিক্ষা চাইতে। জাহিদ লোকটাকে দেখে হাসে আর লোকটার কোলে যাওয়ার জন্য চিল্লাচিল্লি শুরু করে দেয়। গোসল করার সময় বালতির পানি দিয়ে খেলে। ওর আব্বু অনেকগুলো বই কিনে দেয় ওকে। একদিন বইয়ে এক লোক কে পাঞ্জাবি পরা অবস্থায় দেখেছিলো। অর আম্মুকে জিজ্ঞেস করেছিলো, “আম্মু, এইতা কি?” আম্মু সেদিন বলেছিলো এইটা হুজুর। পরে একদিন ওরা সবাই মিলে এক জায়গায় ঘুরতে যাচ্ছিলো। রাস্তায় এক ছেলেকে দেখলো হুবহু ওইরকম পাঞ্জাবি পরা অবস্থায়। দেখে ওর আব্বুকে দেখাচ্ছে আর বলছে, “বাবা হুজুই, বাবা হুজুই।“
বাবা ছেলের কথা না বুঝতে পেরে আশেপাশে দেখে, পরে জাহিদের আম্মু বলে আসল ঘটনা। দুজন মিলে কি হাসাহাসি! ধীরে ধীরে ছেলে বড় হতে থাকে। স্কুলে ভরতি করিয়ে দেয়া হয়। ওর মা ভেবেছিলো স্কুলে গিয়ে ও চুপচাপ থাকবেনা, কান্না করবে, ছটফট করবে। কিন্তু না। ও ক্লাসে একদম ভদ্র ছেলের মতন চুপচাপ ছিল প্রথম দিন। ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হয় স্কুলে যেতে। প্লে থেকে নার্সারি এভাবেই কাটে। ওয়ান থেকে প্রতিদিন স্কুলের বাড়ির কাজ করতে দেখে যায় তাকে। ক্লাসের পড়া ক্লাসে পড়ে রাখে। এভাবে ওয়ান টু থ্রি ফোর। ফাইভে উঠে একদিন ভাবে সে কবে যে বড় হবে। বড় হলেই ভালো। সবাই বড়দেরকে মূল্যায়ন করে। বড় হলেই বুঝি জীবনের স্বার্থকতা। বড় হতে চায় শুধু সে। ফাইভ সিক্স সেভেন এইট করতে করতে নাইন-টেনে উঠে পড়ে। সময়ের এতো গতি! এতো তাড়াতাড়ি চলে যায়! একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণিও কিভাবে জানি পার হয়ে যায় হুট করেই। পরে অনার্স এভাবেই শেষ হতে থাকে শিক্ষাজীবন। বুঝাও যায়না এতগুলা বছর কিভাবে কেটে গেলো। যখন প্লেতে পড়ত ভাবতো কবে নার্সারিতে উঠবে, নারসারিতে থাকতে কবে ওয়ানে উঠবে, ওয়ানে থাকতে কবে যে টুতে, এভাবেই। পড়া শেষে কবে যে চাকরি করবে এই নিয়ে ভাবতো সে। আগে বালকটির দিন কাটতো আকাশের নিচে ঘাসে মাথা রেখে মেঘ দেখা, সুতাকাটা ঘুড়ির পিছন দৌঁড়িয়ে, পুকুরে লাফ দিয়ে সাতার কেটে, খোলা মাঠে বল নিয়ে কাড়াকাড়ি দিয়ে, রূপকথার গল্প, ঠাকুমার ঝুলি, ভূতের গল্প শুনে, রুমের জানালায় মাথা রেখে পূর্ণিমার চাঁদ আর তারকার আলোকরশ্মি দেখা। সেই ছেলের দিন কাটে দুশ্চিন্তায়, মন খারাপে, কষ্টে, অব্যক্ত অনুভূতি অব্যক্ত রেখেই নগরের রাস্তায় পাগলের মতন ঘুরে ঘুরে। এতক্ষণ বন্ধ চোখে এসব ভাবলো সে।
ওর হঠাৎ মনে হলো বাইরে থেকে আসার পর বাবাকে দেখেনি। বাবার কাছে যায় সে। বাসা শুয়ে আছে। বাবাকে দেখে মায়া লাগছে তার। কেনো জানি তার চোখ থেকে পানি ওর বাবার হাতে পরলো। ও মনে মনে ভাবলো, আগে কত বড় হতে চাইতাম শুধু, এখন তো অনেক বড়ই হলাম। কই আগের মতন লাগেনা তো! এখন শুধু ইচ্ছে করে শৈশবটা যদি আবার ফিরে পেতাম! আগেই সুন্দর ছিলো!