মিথুন আহমেদ
১.
রিন্তি জানালার পাশে বসে আছে। গ্রীষ্মের তীব্র রোদ কিছুটা কমে এলেও বাতাসে এখনও ক্লান্তি। আকাশের এক কোণে সূর্য অস্ত যাচ্ছে ধীরে ধীরে, যেন দিনের ক্লান্তি নিয়ে সে-ও বিশ্রামে যাচ্ছে।
দীর্ঘ গ্রীষ্মকালীন ছুটি কাটিয়ে শহরে ফিরে আসার আগে এটাই তার গ্রামের শেষ বিকেল। চারদিকে পাকা আমের ঘ্রাণ, কাঁঠালের মিষ্টি সুবাস, আর পাশের পুকুরে ঝাঁপাঝাঁপ করে সাঁতার কাটছে কিছু ছেলে। রিন্তির মনে পড়ে যায়—এই গ্রামের পথেই তো সে হেঁটেছিল প্রথম বারের মতো একা, প্রথম ভালোবাসার চিঠিও পেয়েছিল এই বাড়ির উঠোনেই।
গ্রীষ্ম তার কাছে শুধুই তাপদাহ নয়, বরং স্মৃতির এক উষ্ণ খেলা—যেখানে ছোটবেলার দুরন্তপনা, কৈশোরের প্রেম, আর বর্তমানের এক টুকরো বিষাদ মিশে আছে।
সূর্যটা ঢলে পড়ছে। রিন্তি মনে মনে বলল, “এই গ্রীষ্মটাই হয়তো আমার সবচেয়ে প্রিয় ঋতু—সব হারিয়ে আবার খুঁজে পাওয়ার ঋতু।”
মানুষ বড় অদ্ভুত! জীবন জীবনের মতো চলে, যেমনটি একটা গ্রীষ্মের পরে আসে আরেকটা গ্রীষ্ম। রিন্তির জীবন’কে তাই রিম্তি গ্রীষ্মের সাথেই তুলনা করে। রিন্তি তার পুরো জীবন এক মৌসুমে বেঁধে রেখেছে যেন। সে খিলখিল করে হাসে, হাসতে হাসতে দম একটু ফুরিয়ে আসলে, ভাবে। রিন্তি ভাবে, গ্রীষ্মের তীব্র ভেপসা গরম তাকে যেন দার্শনিক করে তোলে, সয়ে যাওয়া ব্যথার মতোন গরমও তার আর গায়ে লাগে না। কপাল, ঘাড়ের ঘাম ব্লাউজ ভেদ করে দরদর কোরে আপন রাস্তায় চলে।— “জীবন আসলে কোথায়? গতকাল যাকে আপন ভেবে, চোখ ভিজিয়েছি আজ কেন তা অতীত? অতীতই যদি থাকতে হবে তাহলে বর্তমানের মানে কী? পৃথিবী কী তাহলে মায়ার বাষ্পে চলে?, আচ্ছা বাষ্প! আমাদের জীবনইতো এক আশ্চর্য মতোন বাষ্পীয়। ফুলেফেঁপে আসা নদীর পানি যেমন, সূর্যের তাপে বাষ্প হতে থাকে, আমাদের জীবনও তা-ই, নয় কি? পার্থক্য কোথায়? পার্থক্য হলো, প্রকৃতির সে নিয়মে সূর্যের লাভায় পানির বুক পুড়ে আর আমাদের জীবন জ্বলে, আমাদের অতি আপন দুঃখে।”
“রিন্তি, এই রিন্তি, রিন্তিইইই!”
শেষ ডাকটায় রিন্তি চমকে উঠে, তার দর্শন চিন্তার বাঁধ পড়ে। চোখ তুলে জানালার দিকে একটু তাকায়, এক ঝাপটা বাতাস এসে তার মুখে লেপে যায়, বুকটা ঝলমলিয়ে উঠে। আর তার সাথে সাথেই ছ্যাঁত কোরে উঠে একদম বুকের মাঝ বরাবর।
অতি পরিচিত পরিবেশ আজ তাকে উপহার দিচ্ছে প্রকৃতি। চোখ ঝাপসা হয়ে ওঠে রিন্তির। জানালার কবাটে মাথা ঠেকিয়ে বসে পড়ে ধপাস করে। এলিয়ে আসে শরীর। কয়েক বৎসরের জমানো পাঁচশ কেজি ওজনের মায়া তাকে চারিদিক থেকে নাইলনের দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলে যেন। সে জোর খাটাচ্ছে, উঠে দাড়াতে, উঠে দাড়াতে পারলেই যেন এক দৌড় দিবে, একদম একশো কিলোমিটার বেগে, কোথাও থামবে না, কেউ থামাতে পারবে না, সে উঠবে, তাকে উঠতেই হবে..।
“মামমা, মামমা, ও মামা মামমাহ।”
রিন্তি হুড়মুড়িয়ে উঠে, একদম নিস্তেজ হয়ে যায় যেন। শান্ত হওয়ার চেষ্টা করে, আলগোছে নিজেকে সামলে নিয়ে, বাচ্চাকে ডাকে, “আব্বু, ও বাবা, আসো?” বাচ্চাটা যেন কতকিছুই বুঝে, জ্ঞানীর মতোন প্রশ্ন করে বসে, “কী হয়েতে তোমাল মামমা?” রিন্তি বাচ্চাকে কোলে তুলে নেয়, কপালে গালে দুটো চুমু খায়। দরজার বাইরে এসে মায়ের পানে চেয়ে বলে, “ডাকলে মা?”
২.
২০১৭ সাল। সোমবার। গ্রীষ্মের মাঝামাঝি। ক্লাস এইটের একটি কিশোর। সরিষার তেল চুপেচুপে মাথা, বাম পাশে সিঁথি কাটা। শ্যাম গায়ের রঙ। লাল ঠোঁট। কথা বললে যেন তার পাশ দিয়ে বয়ে চলা বাতাসও টের পায় না। চোখ টিপটিপ করে মাথা নিচু করে হাটে। প্রতিটি কদমে যেন তার লজ্জা রেখে যায় চলন্ত রাস্তায়। একটি মধ্যম ধারালো কাস্তে হাতে কিশোর চলছে। গন্তব্য ঘাস সংগ্রহ। বাড়ির ছাগলের জন্য সবুজ ঘাস সংগ্রহ করতে হবে।
একটি ভুট্টা ক্ষেতের পাশে আসে কিশোর’টি। আশেপাশে তাকিয়ে দেখে। ভুট্টা ক্ষেতের পাশেই একটা জাংলা দেখতে পায়, তাতে ঝুলছে কচি কচি ধুন্দল। কোথা থেকে যেন ঝিঙে ফুলের গন্ধ আসে নাকে, চট করে কিশোরটির মনে পড়ে যায় কবি নজরুলের কবিতাটি। মনে মনে আওড়াতে থাকে। হঠাৎ — ধপাসসস..। চমকে উঠে যুবক। ফস করে একটি মেয়ে উঠে দাড়িয়ে এক ঝোপা লিচু ধরে কিশোরটির মুখের সামনে। বলে, “এই রক্তিম, এই নে খা।”
রক্তিম লজ্জা পায়। লজ্জায় লাল হয়ে উল্টো ঘুরে হাটা ধরে। গন্তব্য অজানা। শুধু জানে, যেতে হবে বহুদূর, ততোদূর যতদূর গেলে রিন্তির গায়ের উতলা করা গন্ধ পাওয়া যাবে না। রক্তিম দৌড়ায়। শা শা করা বাতাসের মধ্যে ও শুধু আবছা শুনতে পায় কেউ তাকে কেন্দ্র করে বোধহয় বলছে, “এই রক্তিম, এই দাড়া, শোন, এই গাধা, ভীতু, গন্ড, এই ভক্তিম।” রিন্তি হি হি করে বাতাসের সাথে দোল খেয়ে হেসে উঠে, এই হাসির ভিন্ন মানে আছে। যে হাসি হেসে, হাসির লোকটি নিজেই সুখ পায়, সেই হাসির মানে থাকে, গভীর মানে। রক্তিম কী তা জানে? কখনো অনুমান করতে পারে? কি জানি, বোধহয় পারে, বোধহয় পারে না।
৩.
সেবার বার্ষিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও ক্রিয়া প্রতিযোগিতার রিহার্সাল চলছে স্কুলে। জমজমাট। পুরো স্কুল যেন জীবন্ত। প্রতিটি মুখে উৎসবের হাসি। দেখতে দেখতে দুইটি বছর পেরিয়ে গেলো। এবার রিন্তি দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী। সে এখনও খিলখিল করে হাসে, তবে এখন অকারণে কম হাসে। কারো জন্য জমিয়ে রাখে হয়তো তার এই হাসি। কারণ, কেউ একজন একবার বলেছিলো, রিন্তির এই হাসি না কি তার খুবই পছন্দ। সেই থেকে রিন্তি হাসে, মন খুলেই হাসে, তবে সেই কেউ একজনের উপস্থিতিতেই। তার আপন মানুষকে সে এতটুকু কম উজার করে দিতে রাজি না।
রক্তিম এখন ম্যাচিউর। প্রেম জেগেছে মনে। লাজুকতা কাটেনি তবে এখন আর দৌড়ায় না। দৌড়ে বাঁচতে চায় না। তারই প্রমাণ দিতে একদিন সে, সাইকেল নিয়ে রাস্তা দিয়ে যেতে যেতেই রিন্তি’কে বলেছিলো, “কাল এক ঘন্টা আগে আসিস স্কুলে।”
সেদিনের কথা মনে হলে আজও রিন্তি ডুকরে কেঁদে উঠে। মন চায় তার, ঐ দিনটিতেই যদি আটকে দিতে পারতো পুরো বিশ্ব। ঐ দিনটাতেই আটকে থাক দুনিয়া। আর না আগাক। কী দরকার? নাহ, পৃথিবীর থমকে থাকার দরকার নাই, আমাকে থমকিয়ে দিক। রিন্তি ভাবে, ১৯ সাল বার বার ফিরে আসুক, আমি কষ্ট করে খুঁজে নিবো সে দিনটি, আমার দিনটি। একান্তই আমার প্রিয় দিনটি।
১১ নভেম্বর ২০১৯। বৃহস্পতিবার। সকাল ৯টা। গ্রীষ্মের তীব্র ভেপসা গরম। পাশেই একটা কলাবাগান। তার পাশে মেহগনির ছায়াঘন সারি সারি গাছ, বাতাসে দুলছে তারা। রোদের মধ্যে এক পশলা সুখ দিচ্ছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। রিন্তি বসে আছে একটা বারান্দায়। একা। একটা কালো ডায়েরি হাতে।
অদূরে দেখা যায়, আবছা এক যুবক, হাতে লাল একটা কিছু— এগিয়ে আসছে ধীরে। এইতো কাছে চলে এসেছে প্রায়, আসে আবার থামে। পায়ে যেন শত জড়তা। শেষে পায়ের সাথে জিদ করেই যেন এসে রিন্তির থেকে ঠিক দুই হাত দূরত্ব নিয়ে বসে। চোখ ঘাসের দিকে রেখেই রক্তিম, ডান হাত রিন্তির দিকে বাড়িয়ে দিলো, রিন্তি প্রেমাতুর অধর কিঞ্চিৎ বাকিয়ে, লাজুক নয়নে তার হাত পানে হাত বাড়ালো, গোলাপটি নিলো। দুজনই সরমে মাটি প্রিয় হয়ে উঠলো। এরপর..
রক্তিম আলগোছে তার বুক পকেট থেকে বাদামের ঠোসা বের করলো, তাদের দূরত্বের মাঝ বরাবর রাখলো, সে নিজেই একটা তুলে নিয়ে খাওয়া শুরু করলো।
পুরো ৪৫ মিনিট ওরা বসে রইলো, শব্দহীন। পাঠকগণের কী মনে হয়, তারা একটা কথাও বলেনি? আচ্ছা, শব্দহীন থাকা মানে কী বার্তা বিহীন থাকা? উহু, সেদিন তারা, নিঃশব্দে যত কথা বলেছিলো, সারাজীবনে বোধহয় দুজনের কেউ এতদিনও এত কথা বলেনি। রক্তিম, সেই ফুল হাতে রিন্তি’কে যে তার ভালোবাসার কথা বলেছিলো, রিন্তি তা শুনেছিলো, খুব জোরেই বোধহয়। তা না হলে সে ওভাবে চোখে হাত বুলিয়ে রইলো কেনো?
বুক পকেট থেকে বাড়িয়ে দেওয়া বাদাম খেতে খেতে রিন্তি শুনেছিলো, রক্তিমের যত্নের বিবিধ সংজ্ঞা। যা মনে পড়লে আজও রিন্তির হিংসে হয়! হারানোর শোকে। রিন্তির পাওয়া সেই পয়তাল্লিশ মিনিট বা জমানো এক ঘন্টা আমাদের একশো বছর হয়েও পূরণ হবে? প্রিয় সুখ অলক্ষ্য হলে দুঃখ হয়ে জমতে জমতে আরো অতি আপন আলয় হয়ে ওঠে তা। কারণ, সুখের স্মৃতিই যখন দুঃখের হয়ে, সয়ে যায়, তখন কার সাধ্য তাকে টেক্কা দেয় ভালোবাসায়?
৪.
সকাল হয়ে গেছে। ৯টায় ট্রেন। রিন্তি বাচ্চা কোলে নিয়ে, পিছনে মা ব্যাগ হাতে। রিন্তির চোখ ভিজে আসে। এই উঠোনের শেষ প্রান্তে আসলেই কেন যেন এমন হয়। প্রতিবারই। কেনো?
রিন্তির হঠাৎ স্মৃতিচারণ হয়। বিয়ের দুইদিন পূর্ব। রাত সারে নয়টা। জানালার পাশে বসে ছিলো রিন্তি, আনমনে। গড়গড়িয়ে পানি পড়ছে তার দুই নদী বেয়ে। হঠাৎ.. ঠকঠক!
চমকে ওঠে সে। চোখ তুলে দেখে, রক্তিম। বাহির হয়ে, বাড়ির পেছনের উঠনে আসে দুজন। রক্তিমের মলিন মুখ। সেই আগের ভঙ্গিকেই মাথা মাটি পানে রেখে একটি চিঠি বাড়িয়ে দিলো সে।
রিন্তি হাত বাড়ালো। কিন্তু এবার আর লজ্জা পেলো না, যা পেলো তার বর্ণনা লিখে বুঝানোর ক্ষমতা লেখকের নেই। ভুক্তভোগী পাঠকমাত্রই বুঝে যাবার কথা। রিন্তি নিলো চিঠিটি—
প্রথম চিঠি,
শেষ চিঠি।
রক্তিম যেতে পা বাড়ালো, এক কদম গিয়ে আবার ঘুরে, আড়ষ্ট কণ্ঠে বললো, “নিজের অনেক যত্ন নিবা রিন্তি, মন খারাপ কোরো না, বাস্তবতার ওপর মন খারাপ করে কোনো ফায়দা আছে বলো? বাবা মা, সমাজের সুখের চেয়ে আর কোন সুখ বড়? তুমি অনেক ভালো থাকবা রিন্তি, বাস্তবতার কসম, তুমি সুখী হবা।”
রিন্তি আজও শব্দহীন। সে একমনে চেয়ে আছে দিগন্তে, অনন্ত অসীম কোনো বাঁধা হীন কালোতে। তার মনের মধ্যে শুধু একটা কথাই বারবার বলতে থাকলো, “বাস্তবতার কসম আমি ভালো থাকবো।”
উঠোনের বাহিরে পা রাখলো রিন্তি। তার মনে হলো, পৃথিবী ধ্বংস হয়ে গেছে, মানুষ নেই, গাছপালা নেই, আলো নেই, বাতাস নেই, পশু নেই-পাখি নেই— কেউ কোথাও নেই।
সে একা, একদম একা।
এই উঠোনের বাহিরে তার দুনিয়া নির্জন।