রসুল কসু

0
199

আইনুন নাঈমা

বানীয়া পাড়ার পানের বেপারী রসুল কে সবাই এক নাম চিনে -কিপ্টা রসুল। টাকা পয়সার কমতি নাই। কিন্তু কৃপণতা তার সর্বশরীর ,মন ও মস্তিস্ক জোড়ে। দীর্ঘ আটাশ বছর সংসার করার পরে ও ময়না বিবি রসুলের কিপ্টামি হজম করতে পারে নাই। এখনো সকাল সন্ধ্যা এটা সেটা নিয়ে কুন্দল লেগেই থাকে। কখনো অতিরিক্ত সাবান খরচ নিয়ে ,কখনো রান্নায় অতিরিক্ত লাকড়ি পোড়ানো নিয়ে। বয়সের ভারে পিঠ কুজিয়ে গেলেও সংসারের আনাচে কানাচে তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। চোখ বুলিয়ে নেয় কোথায় কোন জিনিসটি খোয়া গেছে। জিনিস যত দামি হোক না কেনো-পুরান হয়ে গেলে ফেলতে হয় -এই চরম সত্যের ঘোর বিরোধী রসুল। সংসারের ছোট বড় পুরনো ভাঙা চোরা জোড়া দিয়ে বিকলাঙ্গের রূপ দিয়ে কাজ উপযোগী করতে সে উস্তাদ। ময়না বিবি স্বামীর আড়ালে যতই বিলাসিতার চেষ্টা করুক না কেনো -রসুল কিভাবে যেনো টের পেয়ে যায়। সে বাতাসে শ্বাস নিলেও বুঝতে পারে আজ ডালে দু ফোটা তেল বেশি পরে গেছে। ময়নার পায়ের জুতোটা চকচক করছে অতিরিক্ত সাবানের অপচয়ে। ছেলেটা হয়েছে বাবার মতোই। বন্ধু বান্ধব হাতে গোনা। হিসাব করে চলা আর পা ফেলাটা শিখে গেছে পিতার কাছ থেকে। দুটু টাকা পকেট থেকে উদ্ধার করা মুশকিল। মাধ্যমিক পর্যন্ত লেখাপড়া শিখে পিতার ব্যবসায় হাত লাগিয়েছে। আপাত দৃষ্টিতে পিতা পুত্রের চেষ্টায় সংসার তরতর করে এগিয়ে যাচ্ছে মনে হলেও ভালো করে তাকালে বোঝা যায় এখনো এখানে ওখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে তিন কালের ধ্বংসস্তুপ। এভাবে দিন ভালোই কাটছিলো। বিপত্তি বাধলো তখন যখন রসুল বুঝতে পারলো ছেলের বিবাহের বয়স ক্রমেই উত্তীর্ণ হয়ে যাচ্ছে। একদিন মনু ঘটক কে ডেকে ভালো মেয়ের সন্ধান দিতে বললেন। খোঁজ নেওয়া হচ্ছে -কার ঘরে বিবাহ উপযুক্ত মেয়ে আছে। মেয়ে পাওয়া যায়। পছন্দ হয়। কিন্তু যখন জানতে পারে ছেলের পিতা রসুল কসু -তখনই বিয়ে টা ভেঙে যাচ্ছে। এভাবে আশে পাশে পাঁচ পাঁচটা গাঁও তন্ন তন্ন করে খোঁজা হলো ,মেয়ে পাওয়া গেলো -কিন্তু তারা রসুল কসুর ঘরে মেয়ে দিতে নারাজ। ময়না বিবি উঠানে পা ছড়িয়ে তরকারি কাটেন। আর বকতে থাকেন রসুলের উদেশ্যে-এখন বোঝো। কেমনটা লাগে। এতিম ছিলাম বইলা এক চউক্ষা মামা তোমার হাতে তুইল্লা দিছিলো। কারো মাইয়া বেশি হয়নাই যে তোমার ছেলের হাতে তুলে দিবো। লাকড়ি গুইনা গুইনা ভাত রাইন্ধা খাওয়াইবো। জীবনডা শেষ করলাম কৈ এর তেলে কৈ ভাইজা খাওয়াতে খাওয়াইতে। কৈছিলাম সময় থাকতে ভালো হইয়া যাও। অহন বুঝো ঠেলা। অল্প দূরে রসুল সাপের মতো ফুঁসতে থাকে।
থপ করে বসে পড়েন পাঁচ পা ওয়ালা চেয়ারে।
-মাইয়া হইয়া জন্মাইছিস ,মুখে তালা দিয়ে ঘরে পরে থাক ,এত ঠোঁট নড়ে কেন ?মাইয়া পাই কিনা না পাই ,ঐটা আমার বেপার। তোমারে নাক গলাইতে হবেনা ,অর্ধেক লাউ তো ছাল কাটতেই ফালাই দিলা। ভালা কইরা কাটো।
ময়না বিবি এক বার রসুলের দিকে তাকান। চোখে রাগ নাকি অভিমান টা বুঝা যায়না। মুখ নিচু করে তরকারি কাটায় মনোযোগী হন। রসুল আরো কতক্ষন বকে যায়। ময়নার গলার আওয়াজ না পাওয়া যাওয়ায় তার কণ্ঠের ঝাঁঝ ও কমে আস।
পর দিন সকাল সকাল ঘুম থেকে জেগে স্ত্রী কে হুকুম দেন এক চড়া আলু ভাত রাঁধতে। তারপর ঘাট থেকে গোছল সেরে এসে পরিপাটি হতে থাকেন।ময়না বিবি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করে
-এতো সাত সকালে কই যাইবেন ?
রসুল ভেজা চুল আচড়াতে আচড়াতে বললো -আজ অনেক দূরে মেয়ে দেখতে যাবো। দুআ করো ,এবার যেনো সফল হয়ে ফিড়ে আসি।

ট্রেন থামলো জামালপুরের জংশনে। রসুল ধীর পায়ে নামে। এই স্টেশন তার চেন। কুড়িগ্রাম থেকে আসা পান বরজের পান মহাজনের মাধ্যমে স্টেশনে পৌঁছায়। পাইকারি দরে পান কিনতে তাকে ভোর বেলায় আসতে হয়েছে জামালপুরের স্টেশনে। আকাশ মেঘলা। বৃষ্টি আসবে বলে মনে হচ্ছে। স্টেশনের পাশে কদম গাছের নিচে দাঁড়িয়ে অল্প আলোয় দেখতে থাকে ঘটকের দেয়া ঠিকানা।
গ্রামের নাম :শীতলপুর
কন্যার পিতা :সফুর মিয়া
মাতা :সালেহা বেগম
মোবাইল :০১৯………..
কাছেই বিকট শব্দে বাজ পড়লো। ঝোড়ো হাওয়া বইতে শুরু করেছে। কাঁধের গামছা উড়ে যাচ্ছিলো ;সেটা আটকাতে গিয়ে হাত ফস্কে উড়িয়ে নিয়ে গেলো ঠিকানাটা। শুন্য হাতে আশ্রয় নিতে হলো যাত্রী ছাউনিতে। প্রায় আধা ঘন্টা পর্যন্ত তোফান হলো। তার পর মুষল ধারে বৃষ্টি। বৃষ্টির শেষে সে কি বাড়ি ফিড়ে যাবে? ঠিকানা ছাড়া কার কাছে যাবে? এভাবে সাত পাঁচ ভাবতে থাকে। বৃষ্টি থামতে থামতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেল। বৃষ্টির শেষে ঝলমলে রোদ উঠেছে। পেটে প্রচন্ড ক্ষুধা। কিছু খাওয়া প্রয়োজন। আশে পাশে চোখ বোলাতে দেখতে পান ,একজন হকার খোলা আকাশের নিচে বাতাসা বিক্রি করছে। প্রতি পিচ পাঁচ টাকা। বাসি পত্রিকায় মোড়ানো বাতাসা দেখে জিভে জল এসে যায় রসুলের। খোলা দোকানের পাশেই খাওয়া শেষে পানি খাবার ব্যবস্থা আছে। পাশেই কলসি ভর্তি পানি। সাথে প্লাস্টিকের মগ। রসুল এক মগ পানি নিয়ে তাতে বাতাসা টা চুবিয়ে সাথে সাথেই তুলে ফেললো। পুনরায় বাতাসা টা কাগজে মোড়িয়ে পকেটে রেখে দিয়ে বাতাসা ভেজা পানি টুকু ঢগ ঢগ করে খেয়ে ফেললেন। মগটা রাখার আগেই কেউ একজন ছু মেরে মগটা কেড়ে নিলো। রসুল চোখ তুলে তাকায় -পাতলা ছিপ ছিপে গড়ন। টাক মাথা।
তেল শেম্পু আর সময় থেকে মাসে কত টাকা বাঁচে তাই হিসাব করতে থাকে রসুল। রসুল হা করে দেখতে থাকে -লোকটা কাগজ থেকে একটা বাতাসা বের করলেন ,তার পর সেটা সূর্যের দিকে ধরে ,বাতাসার ছায়াটা পরিষ্কার পানিতে পড়েছে ,লোকটা ধীরে ধীরে মগটা নাড়াতে থাকেন ,তারপর সন্তপর্নে বাতাসা টা পুনরায় পকেটে রেখে দিয়ে বাতাসার ছায়া মেশানো পানি তৃপ্তি সহকারে খেলেন। বিস্ময়ে রসুলের চোখ দুটি চক চক করছে। সোৎসাহে জিজ্ঞাসা করে বসে -আপনার বাড়ি কোথায় ভাই ?
লোকটি একটা মুচকি হাসি দিয়ে বললো -আমার বাড়ি শীতলপুর।
-নাম টা জানতে পারি ?
-আমার নাম সফুর মিয়া
-আপনি রং মিস্ত্রি ?
-আজ্ঞে হুম।
-বেয়াই মশাই আমি রসুল কসু
এই কথা বলে রসুল সফুরকে বুকে জড়িয়ে ধরলো। সফুর ও রসুলের পিঠ চাপড়িয়ে বললো-আপনাকেই আমি খোঁজছিলাম।

লিখুন প্রতিধ্বনিতেলিখুন প্রতিধ্বনিতে

Previous articleদুঃখ 
Next articleশূন্যতার ঋতু
প্রতিধ্বনি
প্রতিধ্বনি একটি অনলাইন ম্যাগাজিন। শিল্প,সাহিত্য,রাজনীতি,অর্থনীতি,ইতিহাস ঐতিহ্য সহ নানা বিষয়ে বিভিন্ন প্রজন্ম কী ভাবছে তা এখানে প্রকাশ করা হয়। নবীন প্রবীণ লেখকদের কাছে প্রতিধ্বনি একটি দারুণ প্ল্যাটফর্ম রুপে আবির্ভূত হয়েছে। সব বয়সী লেখক ও পাঠকদের জন্য নানা ভাবে প্রতিধ্বনি প্রতিনিয়ত কাজ করে চলেছে। অনেক প্রতিভাবান লেখক আড়ালেই থেকে যায় তাদের লেখা প্রকাশের প্ল্যাটফর্মের অভাবে। আমরা সেই সব প্রতিভাবান লেখকদের লেখা সবার সামনে তুলে ধরতে চাই। আমরা চাই ন্যায়সঙ্গত প্রতিটি বিষয় দ্বিধাহীনচিত্ত্বে তুলে ধরতে। আপনিও যদি একজন সাহসী কলম সৈনিক হয়ে থাকেন তবে আপনাকে স্বাগতম। প্রতিধ্বনিতে যুক্ত হয়ে আওয়াজ তুলুন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here