প্রবক্তা সাধু
রিয়া জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। বাইরে ঝড়ের পূর্বাভাস—আকাশ ধূসর, পাখিরা হঠাৎ করেই গাছ ছেড়ে উড়ে যাচ্ছে। তার মনে পড়ে যাচ্ছে তিন বছর আগের সেই দিনটার কথা। গ্রীষ্মের রুক্ষ দুপুর, হঠাতই আকাশ কালো মেঘে ঢেকে গিয়েছিল। কালবৈশাখীর এমন আগমন রিয়া আগে বহুবার দেখেছে, কিন্তু সেদিনটা ছিল ভিন্ন।
তন্ময়ের সঙ্গে দেখা করার কথা ছিল ছাদের ওপরে। আগের সপ্তাহে রিয়া ওকে বলেছিল, “তুমি যদি সত্যিই কিছু বলতে চাও, বলো এই গ্রীষ্মে, কালবৈশাখী আসার আগেই। কারণ ঝড়ের পর আর কিছু থাকে না—শুধু ভাঙা ছায়া আর কাদায় মাখা পথ” ছাড়া।
তন্ময় হেসে বলেছিল, “তবে ঝড়ের মাঝেই বলব, যেন মনে থাকে চিরকাল।”
সেদিন ঝড় এসেছিল ঠিকই, তবে যে আকস্মিকতা নিয়ে তা নেমে এসেছিল, তা কেউ কল্পনাও করেনি। ছাদের পুরনো টিনের চাল হঠাৎ ভেঙে পড়েছিল। তন্ময় ঠিক রিয়ার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল তখন। একটি মুহূর্ত, মাত্র একটি শ্বাসের সময়, আর তারপর—শব্দ, ধুলো, হাহাকার।
রিয়া চোখ মেলে তাকিয়েছিল, কিন্তু সেই দৃষ্টিতে ছিল কেবল ভয়ের জমাটবাঁধা স্তব্ধতা। তন্ময়ের শরীর নিস্তেজ, রক্তমাখা, আর মুখে জমে থাকা কথা—যা সে আর কোনোদিন বলতে পারবে না।
তিন বছর কেটে গেছে।
তন্ময়ের পরিবার এ শহর ছেড়ে চলে গেছে। বন্ধুরা নতুন জীবনে ব্যস্ত। কিন্তু রিয়া রয়ে গেছে এখানেই—একই বাড়িতে, একই জানালায়। কালবৈশাখী এলে সে একরাশ ব্যাকুলতা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। এই বুঝি হাওয়ার সাথে মিশে ভেসে আসবে এক চেনা কণ্ঠ—“রিয়া…”
প্রতিবারই ঝড় আসে, গাছ উপড়ে যায়, আলো নিভে যায়, তারপর আবার শহর আলোয় ভরে ওঠে। কিন্তু রিয়ার ভেতরের আকাশ আর কোনোদিনই আলোকিত হয় না। তন্ময় যে থেমে গেছে ঝড়ের ঠিক আগেই।
বাইরে হঠাৎ এক গর্জন। রিয়ার চুল উড়তে থাকে জানালার পাশে। সে চোখ বন্ধ করে। মনে মনে ভাবে—হয়তো এবার সে ডাক শুনবে। হয়তো তন্ময় আবার ফিরবে। হয়তো…
কিন্তু বাস্তব বড় নীরস। বাতাস শুধু পাতা ওড়ায়, স্মৃতি নয়।