আবদুল্লাহ নুর আহম্মদ
রাতের আকাশে তারা নেই, কিন্তু অন্ধকারটার মধ্যে এক গভীরতা আছে। যেন সে আকাশ কোনো গোপন কথা লুকিয়ে রেখেছে। ঘরের ভেতর বাতি জ্বলছে একটিমাত্র-হলুদ কেরোসিনের আলো। আলোটা যেন ধীরে ধীরে মিশে যাচ্ছে নিঃশব্দ সময়ের সঙ্গে।
হাফিজ সাহেবের বয়স প্রায় আশির কাছাকাছি। শরীরের শক্তি কমে এসেছে, হাঁটুর ব্যথা আর বুকের ভার তাঁকে বিছানায় শুইয়ে দিয়েছে মাসখানেক। তবুও মুখে এক শান্ত দীপ্তি।
এমন শান্ত মুখ খুব কম দেখা যায়-যেখানে মৃত্যু অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে, তবুও ভয় নেই, কেবল এক প্রশান্তি।
তিনি জানলার দিকে তাকিয়ে ছিলেন। জানলাটা খুলে রাখা। প্রতিরাতে যখন ঘুম আসে না, তখন এই জানালার ওপাশে তাকিয়ে থাকেন।
অন্ধকারে কিছুই দেখা যায় না, কিন্তু তাঁর মনে হয়,সেখানে কেউ দাঁড়িয়ে থাকে।
আজও দাঁড়িয়ে আছে।
আজকের রাতটা যেন ভিন্ন রকম।
নাতনি নূর জাহান তাঁর পাশে বসে। নূরের বয়স এখন বিশের কোঠায়, সদ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া শেষ করেছে। ছোটবেলায় মা-বাবাকে হারিয়ে সে দাদুর কাছেই বড় হয়েছে। দাদুই তার অভিভাবক, আশ্রয় আর ভালোবাসার ঘর।
সে দাদুর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।
দাদুর ঠোঁটে এক হালকা হাসি। কিন্তু চোখের দৃষ্টিতে যেন কোনো দীর্ঘ পথের ছায়া।
-দাদু, জানালায় কি দেখছেন?
-অন্ধকার। কিন্তু অন্ধকারও অনেক কথা বলে, মা।
নূর জাহান মৃদু হেসে বলল,
-আপনি মাঝে মাঝেই বলেন জানালার ওপাশে কেউ দাঁড়িয়ে থাকে। ও কি কল্পনা?
-না, মা। কল্পনা নয়। সে তো আমার সঙ্গী… মৃত্যু।
নূরের বুকটা যেন হঠাৎ ধক করে উঠল।
-দাদু, এমন বলেন না। আমি আপনাকে হারাতে চাই না।
হাফিজ সাহেব ধীরে হাত রাখলেন তার হাতের ওপর।
-নূর, আমি তো তোমাকে বরাবরই শিখিয়েছি মৃত্যু কোনো শেষ নয়, এটা এক নতুন শুরুর দরজা। তোমার দাদী যখন চলে গেল, তখনও আমি জানালার পাশে বসে ছিলাম। ওকেও আমি জানালার ওপাশে দেখেছিলাম। তখন বুঝেছিলাম, মৃত্যুর চোখে কোনো হিংস্রতা নেই, আছে গভীর করুণা।
নূর চুপ করে গেল। বাতাসে তখন এক অন্যরকম নীরবতা। ঘড়ির কাঁটা টিক টিক করে চলেছে, যেন সময়ও অপেক্ষায় কোনো বিশেষ মুহূর্তের।
হাফিজ সাহেব আবার বলতে লাগলেন—
- জানো নূর, আমি যখন তরুণ ছিলাম, তখন মৃত্যুকে ভয় পেতাম। ভাবতাম, সব কিছু শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু যখন কুরআনের আয়াত পড়তাম—”কুলু নাফসিন যায়িকাতুল মাওত” তখন বুঝতাম, এটা কোনো শাস্তি নয়, এটা স্রেফ যাত্রা।
আমরা তো অতিথি এই দুনিয়ায়। আর অতিথির একদিন বিদায় নিতে হয়। তবে প্রস্তুত হয়ে নিতে হয়… এক চিরন্তন সফরের জন্য।
নূরের চোখে পানি চলে আসে। দাদু সবসময় এমনই ছিলেন,একটা জীবন্ত কিতাবের মতো, যাঁর প্রতিটি বাক্যে কোনো না কোনো হিকমত লুকিয়ে।
-আপনি কি প্রস্তুত, দাদু?
-অনেক আগেই, মা। আমি তো প্রতিদিন অপেক্ষায় থাকি,জানালার ওপাশে দাঁড়িয়ে থাকা অতিথিটার দিকে তাকিয়ে থাকি। ভাবি কবে সে আমার জন্য এগিয়ে আসবে?
ঘরের বাতাস হালকা ঠান্ডা হয়ে আসে। পর্দা দুলে ওঠে। যেন জানালার ওপাশ থেকে কারো নিঃশ্বাস লেগে গেছে এই ঘরে।
হঠাৎ ঘরের ভেতর আজান ভেসে আসে। রাতের শেষ প্রহরের ফজরের আজান। মসজিদের মাইক থেকে ভেসে আসা সেই সুরে একটা কাঁপন ওঠে মনে।
হাফিজ সাহেব বলে ওঠেন,
-শোনো নূর, কী সুন্দর ডাক! এ ডাক শুধু নামাজের নয়, এ ডাক আমাদের স্রষ্টার দিকে ফিরে যাওয়ারও। তুমি জানো, মৃত্যুর ঠিক আগে সবচেয়ে প্রিয় ডাক এটাই মনে হয় আমার কাছে।
তারপর তিনি চুপ করে যান। চোখ বন্ধ করে ফেলেন।
নূর দাদুর কপালে হাত রাখে,নরম, ঠান্ডা, কিন্তু জীবন্ত।
-দাদু, আমি আপনাকে খুব ভালোবাসি। আপনি ছাড়া আমি যে কিছুই না…..
হাফিজ সাহেব আস্তে চোখ মেলে বলেন,
-তুমি আল্লাহর উপর ভরসা রাখো, মা। মানুষ হারায় না, রূপ বদলায়। আমি থাকবো,তোমার দোয়ার মধ্যে, তোমার ভালো কাজের মধ্যে। আর যদি কখনো তুমি একা বোধ করো, এই জানালার কাছে এসে দাঁড়াবে। দেখবে, হয়তো আমিও দাঁড়িয়ে আছি জানালার ওপাশে…
সেই বলে তিনি আবার চোখ বন্ধ করে ফেলেন।
নূর জানে, দাদু ঘুমিয়ে পড়েছেন।
তবে এই ঘুম যেন অন্যরকম,যেন এক অনন্ত বিশ্রামের শুরু।
সেই রাতের পরে, ভোরের আলো যখন জানালার কাঁচে এসে পড়েছে, তখন ঘরের বাতাস আরেকটু হালকা হয়েছিল।
দাদুর দেহ নিথর, কিন্তু মুখে শান্তির ছাপ।
এমন মৃত্যু সবাই পায় না।
বছরখানেক পরে
নূর এখন একজন ইসলামি শিশু-সাহিত্যিক। দাদুর মৃত্যুর পর, তার জীবন অনেক পাল্টে গেছে। সে নিয়মিত দোয়া করে, কুরআন পড়ে, লেখে…
আর প্রতিরাতে একটা অভ্যাস তৈরি হয়ে গেছে তার। সে জানালার পাশে এসে দাঁড়ায়। বাতাসে পর্দা দুলে। আর মনে হয়… জানালার ওপাশে কেউ দাঁড়িয়ে আছে।
সেই অতিথি-যার আগমনে ভয় নেই, কেবল প্রশান্তি।
আর দাদু হয়তো সেখানেই আছেন, জানালার ওপাশে। শান্ত, শীতল, এক আলোয় ভরা ঘরে।