ইউনুস মোহাম্মদ
নিশিকান্ত দশ বারো বছর ধরে বান্দুরা আড়তে মাছের ব্যবসা করে।সে একজন বেপারী।মাছ কিনে বাজারে বসে খুচরো বিক্রি করে।প্রতিদিন সকালে একটা খাড়ি আর একটা ডালা নিয়ে মাছের আড়তে আসে।খাড়ি আর ডালা আড়ঁতের পূর্ব দিকে নামিয়ে রেখে ঘুরে,ঘুরে মাছ কিনে।আড়ঁতে খালি জায়গা পাওয়া খুবই মুশকিল।পাইকারদের চাপ অনেক।পূর্ব দিকে যে জায়গাটুকু আছে সেখানে শ,খানেক পাইকার তাদের মাছের খাড়ি আর ডালা নামিয়ে রাখে।এইজন্য সেখানে গাদাগাদি করে রাখতে হয় এইসব খাড়ি আর ডালা।দুই একটা মাছের ককসিটও বসানো থাকে।এঁরা হচ্ছে হকার।মাছ কিনে গ্রামে,গ্রামে হকারি করে।গাদাগাদি করে ঝাঁকা ডালা রাখতে গিয়ে অনেক সময় একে অপরের সাথে ঝগড়া বিচ্ছেদে লিপ্ত হয়।ক্ষেত্র বিশেষে হাতাহাতিও হয়।এখানে যার জোর বেশি ক্ষমতা তারই।কত সময় কতো অন্যায় আর অবিচার ঘটে যায় আড়ঁতে।কেউ প্রতিবাদ করে না।তবে নিশিকান্ত এইসব অন্যায় আর অবিচার ঘটার আগেই এসব সে এড়িয়ে চলে।সে নিজেও চেষ্টা করে তার দ্বারা কেউ যেন অবিচারের শিকার না হয় সেও যেন কারো দ্বারা অবিচারের শিকার না হয়।দশ বারো বছর হলো সে আড়ঁতে আসে।এই পর্যন্ত কেউ তাকে খারাপ বলার সুযোগ পায়নি।পাবে কিভাবে?খারাপ কিছু করলেতো।
নিশিকান্ত আজ এসে তার মাছের খাড়ি আর ডালা পূর্ব প্রান্তে নামিয়ে রাখলো।খাড়ির নীচ দিয়ে পানির ধারা যাচ্ছে।মাছের গন্ধযুক্ত ময়লা পানি।নীচে ঢালাই।পাশের আড়ঁত থেকে মাছের যতো পানি আর ময়লা এই পথ দিয়েই নীচে নেমে যায়।ঢালাইয়ের শেষে লোহার গেট আছে।গেটের বাইরে ময়লার স্তুপ।শত,শত ভাঙা ককসিট আর বিভিন্ন ময়লার স্তুপ জমা হয়ে আছে সেখানে।পাইকাররা এখানে এসে হিসুও করে।গেট খুললেই ভুর,ভুর করে প্রসাবের গন্ধ আসে।নিশিকান্ত ঝাকা ডালা রেখে গেটের বাইরে গিয়ে প্রসাব করে এলো।তারপর আবার তার ঝাকা ডালার কাছে এলো।আজ উপরে জায়গা নেই।সে আসতে,আসতে উপরে জায়গা কোনোদিনই থাকে না।কারণ,তার আসতে দেরি হয়ে যায়।এই সময় অন্য পাইকাররা এসে তাদের খাড়ি আর ডালা উপরে রেখে জায়গা দখল করে ফেলে।
ঠিক সামনে উত্তর দিকে দুলাল দাসের আড়ঁত।দুলাল দাসের ছেলে অকশন ডাকছে।তাকে ঘিরে পাইকারদের ভিড়।ইলিশ মাছের অকশন ডাকছে সে।চারটায় এক কেজি।এই ইলিশের অকশনে দাম উঠেছে নয়শো পঞ্চাশ টাকা কেজি।পাইকারদের মাঝে হতাশা।হায়,হায় এতো দাম অইলে মাছ কিনা বেচুম কেম্নে?
নিশিকান্ত খাড়ি রেখে অকশেনের কাছে গেল।সে আসলে ইলিশ মাছই বিক্রি করে।কিন্তু এখন কয়েক মাস ধরে ইলিশ মাছের প্রচুর দাম হওয়ায় ইলিশ মাস কিনে না।রুই,চিংড়ি পাবদাসহ অন্যান্য মাছ বিক্রি করে।এগুলো সবই চাষের মাছ।অকশনের কাছে গিয়ে আজও সে হতাশ হলো।দাম গত কয়েকদিন যেমন ছিলো আজও তেমন আছে।তবু পাইকাররা থামছে না।পাল্লাপাল্লি করে ডাকাডাকি করছে।কার উপর দিয়ে কে নিতে পারবে যেন তার একটা প্রতিযোগিতা চলছে।একজন দশ টাকা বেশি বলতেই আরেকজন বিশ টাকা বেশি বলছে।সর্বশেষ যে বেশি বলছে তার নামেই মাছ ভীট পড়ছে।
আলাউদ্দিন নামের একটা ছেলে মাছ নিয়ে এসেছে।দুলাল দাসের ছেলের পাশে দাঁড়িয়ে সে খাতায় ভীট পড়া মাছের দাম আর ওজন খাতায় লিখে নিচ্ছে।প্রতিদিনই সে এটা করে।
পাইকারদের ভেতর প্রচন্ড ভীড়।ধাক্কাধাক্কি হওয়ার মতো অবস্থা।নিশিকান্ত ভীড় ঠেলে বেড়িয়ে এলো।এতো দাম দিয়ে ইলিশ মাছ তার কেনা হবে না।অযথা দাঁড়িয়ে থেকে কী লাভ?ততোক্ষণে তার ডাক পড়েছে।
তার খাড়ির কাছে আকতার,মিরাজ,সাইদুল আর দেলু দাঁড়িয়ে আছে।আকতার প্রচন্ড আক্রোশ নিয়ে রক্ত চক্ষু তুলে তাকে ডাকছে।আর সবাই তার পাশে দাঁড়িয়ে নিশিকান্তর দিকে তাকিয়ে আছে।যেন তারা দেখার অপেক্ষায় আছে শেষটা কী হয়।আকতার খুবই রেগে গেছে।তার চোখ মুখের ভাব দেখেই সেটা বোঝা যাচ্ছে।নিশিকান্তু তাড়াতাড়ি তার খাড়ির কাছে এলো।এসে বললো,কী অইছে ভাই?
আকতার প্রথম কথাটাই শুরু করলো গালি দিয়ে।অই চুদনারপো খাড়ি রাখছা ক্যাঁ এহেনে।এইডা কি তর বাপের জাগা?
আকতার ওরা সবাই নিশিকান্তর বয়সে ছোট।নিশিকান্ত বললো,গালাগালি করোস ক্যাঁ ভাই।তগো সমস্যা অইলে সরাইয়া দেই।
আকতার তবু থামে না।সে আরো চড়ে গিয়ে বললো,তুই এহেনে খাড়ি রাখলি ক্যাঁ।তুই দেহস না তর বাপেরা ডেলি এহেনে আইহা ককসিট রাহে।তার চোখ মুখ তখনও রক্ত গরম।
আকতার,মিরাজ ওরাও পাইকার।ওরাও প্রতিদিন আড়তে এসে এখানে তাদের ককসিট রাখে।ওরা ইলিশ মাছ কিনে।তারপর যতোক্ষণ আড়তে থাকে ততোক্ষণ একটা দুইটা করে কাস্টমারের কাছে মাছ খুচরোয় বিক্রি করে।ওদের বাড়ি সাদাপুর নামক গ্রামে।সাদাপুর বান্দুরা আড়ত থেকে খুব বেশি দূরে নয়।গাড়িতে গেলে পনেরো মিনিট লাগে।বাড়ি নিকটে বলে আড়ঁতে দাপট আছে ওদের।প্রয়োজনে কিংবা অপ্রয়োজনে সেই দাপট দেখাও ওরা।মাঝে মধ্যেই এখানে খাড়ি রাখা নিয়ে বেপারিদের সাথে খারাপ ব্যবহার করে ওরা।ক্ষমতা দেখায়।এখানে ককসিট রাখার সুবিধা হচ্ছে কিছু মাছ খুচরায় বিক্রি করা যায়।তাই অন্য কারো খাড়ি বা ককসিট রাখা ওরা সহ্য করতে পারে না।কিন্তু এই আড়ঁতের কোনো জায়গাতো কোনো পাইকারের নামে দলিল করা না যে সেখানে অন্য কেউ ঝাকা ডালা রাখতে পারবে না।আইনত আড়ঁতে সব পাইকারের সমান অধিকার।কিন্তু সেটা মানে কে?জোর যার মুল্লুক তার অবস্থা চলে আড়ঁতে।আকতার ওরা সবার সাথেই এমন খারাপ ব্যবহার করে।কয়েকদিন আগে এক পাইকার আকতারের একটু বরফ ধরায় তাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছিলো।পাইকারটি হিন্দু।নাম মধু।সে ছিটকে গিয়ে প্রায় পাকা ওয়ালের সাথে বারি খেয়ে যাচ্ছিলো।পরে সে দূরে গিয়ে ওদের নামে অভিশাপ দিলো নিরাকারে।এখানে এমন ঘটনা অহরহ ঘটে।বিচার নেই।
আকতার বাপ তুলে কথা বলায় নিশিকান্ত বললো,বাপ মা তুইলা বকা দেন ক্যাঁ?বাপ মায় কি করছে?অন্যায় করলে আমি করছি আমারে কন।
আবার কথা কস।মারুম কিন্তু।সরা খাড়ি এহেনগনে।বলেই আকতার তার খাড়ি ছুঁড়ে ফেলে দিলো।
নিশিকান্ত এবার রেগে গেল।তবে সেটা প্রকাশ করলো না।সে শুধু বললো,এতো জোর জুলুম করিস না।ঘাটটা কি তগো একার?
এই কথা বলতেই আকতার এগিয়ে এসে একটা গালি দিয়ে বললো,ঐ কি কইলি।ঘাট আমাগো না তয় তগোনি?বলতে,বলতে নিশিকান্তর শরীরে হাত তুললো সে।প্রথম ঘুষি দেয়ার পর দ্বিতীয় ঘুষি দিতে যাবে তখন কয়েকজন পাইকার আকতারকে ধরে থামালো।
আকতার পুনরায় একটা গালি দিলো।বান্দির বাচ্চা সর এহেনগনে।নাইলে কিন্তু তরে আবারো মারুম।
একজন পাইকারের গলায় পৈতার মালা।সেও মাছের বেপারী।সে হয়তো নিশিকান্তর কিছু হয়ে থাকবে।সে আকতারকে অনুরোধ করে থামতে বললো।আর নিশিকান্তকে ধমকের স্বরে বললো,এহেনে আইনা খাড়ি রাহুন লাগবো ক্যাঁ?আর জাগা চোহে দেহ না?
নিশিকান্ত মার খেয়ে অসহায়ের মতো সরে গেল।খাড়ি আর ডালা তুলে এনে ওদের থেকে কিছুটা দূরে পাকার ওপর রাখলো সে।তার মুখটা দুঃখে আর কষ্টে কালো হয়ে আছে।এটা তার সাথে নির্ঘাত অন্যায় করা হয়েছে।জুলুম করা হয়েছে।তার ঝাকা ডালা আগে রেখেও রাখতে পারলো না ওল্টো আরো মার খেতে হলো।এই যন্ত্রণায় তার ভেতরটা ভেঙেচুরে যাচ্ছে।
নিশিকান্ত সেখানে দাঁড়িয়ে আকতারকে বললো,আমারে হুদাহুদি অন্যায়ভাবে মারলি।আমি কিছু কইবার পারলাম না।কিন্তু এই বিচার আল্লায় একদিন করবো।
আকতার তখন মিরাজ দেলু আর সাইদুলের সাথে হাসিঠাট্রায় ব্যস্ত।তখন তাদের মাঝে অন্য কোনো বিষয় নিয়ে কথা হচ্ছে।এই বিষয়টি তাদের মাথায় নেই আর।হাসিঠাট্টার ভেতর নিশিকান্তর কথা ওরা কানেই তুললো।কিন্তু শুনেছে ঠিকই।শুধু গুরুত্ব দিলো না।যেমন হাসিঠাট্টা করছিল সবাই একজায়গায় দাঁড়িয়ে তেমন হাসিঠাট্টা করতে লাগলো।
পাইকাররা দুই একজন নিশিকান্তর দিকে সহানুভূতির সৃষ্টিতে তাকালো।তারা সবাই দেখেছে নিশিকান্তর সাথে কী ঘটেছে।কিন্তু তাদের কিছু করার নেই।আর কার দায় পড়েছে পরের ঝামেলা নিজের মাথায় তুলে নেবার।নিশিকান্ত সেদিন মাছ না কিনে তার ঝাকার কাছে দাঁড়িয়ে রইলো।তার মনটা খারাপ হয়ে গেছে।মাছ কিনতে মনে চাইছে না।দুলাল দাসের আড়ঁত খালি হয়ে গেছে।অল্প মাছ এসেছিলো।আধাঘন্টার মধ্যেই সব মাছ শেষ।দুলাল দাসের ছেলে ঘরের ভেতর পাকার ওপর ক্যাশের কাছে বসেছে।তার হাতে খাতা।জ্ঞাঞ্জামের সময় সে তাকিয়ে ছিলো।কিন্তু কিছু বলে নাই।
অন্যান্য ঘরে রুই মাছ বিক্রি হচ্ছে।রুই মাছ আছে আড়ঁতে অনেক।পাবদা মাছও আছে।নিশিকান্ত চাইলেই রুই মাছ আর পাবদা মাছ কিনতে পারে।কিন্তু নিশিকান্ত তার ঝাঁকার নিকট থেকে সরে গেল না।যেমন দাঁড়িয়ে ছিলো তেমনি ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো।যেন সে পাথরের মূর্তি হয়ে গেছে।তার পরিচিত এক পাইকার বললো,মাছ কিনবা না?খাড়াইয়া রইছাও ক্যাঁ?
নিশিকান্ত জবাব দিলো না।ঘাটভরা পাইকারের সামনে সে অপমান হলো,সকলের সামনে তাকে বেইজ্জতি করলো এই কষ্টে নিশিকান্ত বোবা হয়ে গেছে।আশেপাশে পাইকারদের কর্মব্যস্ততা।কেউ মাছ কিনে এনে খাড়ির ভেতরে রাখছে।কেউ প্লাস্টিকের বস্তা হাতে নিয়ে মাছ কিনতে যাচ্ছে।শুধু নিশিকান্তরই আজ কোনো ব্যস্ততা নেই।নিশিকান্তর দিকে কেউ ফিরেও তাকাচ্ছে না।এক সময় আড়ঁত ভেঙে গেল।নিশিকান্ত মাছ কিনলো না।নিশিকান্ত যেমন খালি খাড়ি নিয়ে আড়ঁতে এসেছিলো তেমনি খালি খাড়ি নিয়েই বাড়ি ফিরে গেল।পরদিন শোনা গেল নিশিকান্ত বাড়িতে গিয়ে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেছে।আড়ঁতে সবাই শুনলো সেই কথা।কিন্তু কেউ জানলো না নিশিকান্ত কেন মারা গেল। থানায় অপমৃত্যুর মামলা হয়েছে।কিন্তু এটাতো অপমৃত্যু নয়।তাকে মেন্টালি আঘাত করে হত্যা করা হয়েছে।আড়ঁতভরা মানুষের সামনে কিল ঘুষি খাওয়ার মতো অপমান নিশিকান্ত মানতে পারে নাই।তাই বাড়ি এসে সে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করে।