আইনুন নাঈমা
১
আবির স্বনাম ধন্য মেডিকেল কলেজ থেকে পাশ করে যখন কর্ম ক্ষেত্রে যোগদান করলেন -তখন এই সাফল্যে গর্ববোধ করার মতো বা পাড়া প্রতিবেশীকে উঁচুস্বরে শুনিয়ে দেওয়ার replica watches for sale জন্য তার পরিবারের কোনো সদস্য এই দেশে ছিলোনা । পিতার চাকরির সুবাদে তার পরিবার পরিজন দেশের বাহিরেই রয়ে গেলেন ।শহর থেকে অল্প দূরে মোঘল আমলের ন্যায় কারুকার্য খচিত বাগান বাড়িতে দ্বিপদী আবির ত্রিপদী ভৃত্য করিম এবং চতুষ্পদী বিড়াল মিনুকে নিয়ে সুখে দিন যাপন করতে থাকলেন । বিকাল পাঁচটায় হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফেরেন । তারপর ফ্রেশ হয়ে ইজি চেয়ার এ হেলান দিয়া আধশোয়া হয়ে পরে থাকেন ।পাশে সিরামিকের মগ থেকে কফির কড়া ঘ্রাণ ,আর জানালার পাশের বাতাবিলেবুর সুবাস এক মধুর পরিবেশ সৃষ্টি করে ।এই শেষ বিকেলে যেমন কৃষ্ণচূড়ার মাথা হতে সূর্যের লালচে আভাটা ক্রমশ মুছে যেতে থাকে -তেমনি মুমূর্ষু রুগীর আর্তচিৎকার ,দালাল ঠেঙ্গানো,ঔষধ কোম্পানির লোকদের উৎপাত -ক্রমশ মুছে যেতে থাকে তার স্মৃতি ভান্ডার হতে ।
কয়েক দিন থেকে জীবন সন্ধিক্ষণে হারিয়ে যাওয়া অস্থিরতা তাকে পেয়ে বসেছে ।ইজি চেয়ারের সামনে হোয়াইট বোর্ডে আটকানো একটি পেন্সিল স্কেচ -কুঁকড়ো চুলের এলোকেশী তরুণী ,টোল পড়া মুখে একরাশ নির্মল হাসি।
এই তার সেই প্রেয়সী -যে জীবনে আসিবার পূর্বেই replica rolex watches হারিয়ে গেছে ।এই তার সেই মোনালিসা -যার এক খন্ড ছবি তার অখণ্ড জীবনের শেষ সম্বল ।সে এসেছিলো নীরবে ;কোনো এক বসন্তের পড়ন্ত বিকেলে চুপিসারে ।কোনো এক বর্ষার ঝাপসা আলোয় সে নীরবে চলে গেছে অগোচরে ।
তখন সে চা বাগানের কোয়ার্টারের প্রসস্থ বেলকনিতে দাঁড়িয়ে হিউম্যান স্ক্যালিপ্টারের চার্ট নিরীক্ষণ করছিলো ।পাশ দিয়ে ছুট্ট পায়ে চলা গলিটি দিয়ে রেডিয়াস আলনার মতো সংঘবদ্ধ হয়ে দু বোন পড়তে যেতো ।সেই এক পলক দেখা -অনুভূতিহীন চক্ষুকোটরে ভালোলাগার এক রুপোলি পর্দা টেনে দিল ।তারপর প্রত্যহ বেলকনিতে দাঁড়িয়ে একদৃষ্টে গলির দিকে তাকিয়ে থাকা ।হয়তো কোনো দিন চোখাচোখিও হয়েছিল ।কিন্তু বলা হয়নি কোনো কথাই । তখনো বসন্তের নব কুড়ি ফুটেনি ;মধুমক্ষিকা ঘুমে আচ্ছন্ন ;পত্রহীন শিমুলতলা শুন্য। আবির ভাবলো বাহিরে এবং ভিতরে বসন্ত আসুক ;নব কুঁড়ি ফুটুক ;তারপর এক দিন ………..
হঠাৎ মেডিকেল এডমিশনের ডেট ঠিক হয়ে গেলো ।বাধ্য হয়ে ফিরতে হলো ঢাকায়।ওই দিকে নব কুঁড়ি ফুটলো ।ভ্রমরেরা গান গেয়ে বিদায় নিলো। শিমুল তলা শুকনো top replica watches ফুলে ভরে গেলো।আবিরের আর ফেরা হলোনা তার চেনা নীড়ে ।এভাবেই চলে গেলো মেডিকেল এর দুইটি সেমিস্টার ।একদা আষাঢ়ের কালো মেঘে আকাশ আচ্ছন্ন। বৃষ্টির কোনো বিরাম নাই। মনের অজান্তেই চোখ আটকে গেলো বৃষ্টি স্নাত কদম গাছের দিকে। তার পাশেই নতুন পাতায় আচ্ছাদিত শিমুল বৃক্ষ। মনে পড়ে যায় সেই অপরিচিতার কথা…….তারপর হন্ততন্ত হয়ে ছুঁটে গিয়েছিলো বড় মামার চাবাগানের কোয়ার্টারে। তার বেলকনি আগের মতোই নানান ছবি স্কাল্পচারে পূর্ণ। সে অপেক্ষায় থাকে -কবে আসবে তার সেই অপরিচিতা।দেখতে দেখতে পাঁচদিন কেটে যায়। কিন্তু সে আর আসেনা। বাগানের এক স্থানীয় কর্মচারীকে ডেকে জিজ্ঞাসা করে দুই বোনের কথা।তার কাছে জানতে পারে মেয়েটির বিয়ে হয়ে গেছে দু সপ্তাহ আগে। হতাশ হয়ে ফিরে আসে ঢাকায়। অপরিচিতার মুখ যতটুকু মনে আছে তাতেই পেন্সিলের স্কেচে এঁকে নেয় ।লুকিয়ে রাখে বক্সের এক কোণায় ।আর হে ,তার মনে বসন্ত না আসলেও বর্ষা এসেছিলো চোখে।তারপর মনকে এই বলে সান্তনা দিয়েছে সে -ভালোবাসা দূর থেকেই সুন্দর। কাছে গেলে এর পবিত্রতা নষ্ট হয়। সব কথা প্রকাশ করতে নেই। কিছু কথা না হয় অপ্রকাশিতই থাকুক । যে আমার সে একান্তই আমার। আমার ভিতরে যাকে লালন করি সে চিরকাল অবিনশ্বর।সেই মায়া ভরা চোখ কোনোদিন ঝাপসা হবেনা।পড়বেনা কখনো বলিরেখা।যে চিত্রের দিকে হাজার বছর তাকিয়ে থাকলেও ক্লান্তি আসবেনা।মনের একান্ত কুঠুরিতে সে চিরকাল বিরাজ করুক। বাহিরের জগতের সাথে এর সংযোগ ঘটিয়ে কলুষিত না করায় উত্তম।
কিন্তু আজ যাকে সে ক্লাসে দেখেছে সে কে ?সে কি শুধুই মরীচিকার মায়া জাল।আট বছর আগের দেখা সেই মুখ অবয়ব ।সেই কুঁকড়ো চুল ,সেই টোল পড়া মুখের হাসি !পৃথিবীর এত আলো ,এত বাতাস ,এত উত্থান পতন -অথচ এর আবরণে এতটুকু আঁচড় লাগায়নি !নিজের অজান্তে নিজের মনকেই প্রশ্ন করে -একই চেহারার দুইটি প্রতিবিম্ব হয় কি করে ?
একদা সে এসেছিলো সূচনা হীন ভাবে ;অনুসূচনার এক বিশাল পাহাড় বুকে চাপিয়ে সে সরে গেছে দূরে ।তারপর বাকি আট বছর ব্যথার পাহাড় চাপা বুকে পথ হাঁটিবার কালে কত না কোল রমণী ইশারায় ডেকে গেছে। তাকিয়ে দেখার অবসর জুটে নাই ।আজ যে পেন্সিলের সামনে দাঁড়িয়ে আছে সে একত্রিশ বছরের যুবক আর যাকে তাকিয়ে দেখছে সে আঠারো বছর বয়সী তরুণী ।এই দ্বিবিধ সমীকরণ জোটের সমাধান অতটা সহজ হলোনা ।পশ্চিমে তখনো সূর্য অস্ত যায়নি।সিঁদুর লেপা আকাশের প্রান্ত ঘেঁষে নীড়ে ফিরছে ক্লান্ত পাখির ঝাঁক ।হঠাৎ আবিরের মোবাইলটা বেজে উঠে ।সেই কণ্ঠ ।কিন্তু ভয় মিশ্রিত ।আবির চমকে উঠে- “জ্যোতি”
জ্যোতির আত্মীয় মৃত্যু পথযাত্রী ।অবিলম্বে তাকে হাসপাতালের এমার্জেন্সি তে যেতে হবে ।অনিচ্ছা সত্ত্বেও তার অবচেতন মন তার অবসন্ন শরীলটাকে সেই চির পরিচিত জায়গায় নিয়ে যায় ।তবে আসন্ন সন্ধ্যায় সকালের মতো কোনো হড্ডগোল নেই ।নেই অপেক্ষমান সেবাপ্রার্থীর দীর্ঘ লাইন ।এখন হাসপাতালের অপরিষ্কার বাড়ান্দাটি সন্ধ্যার মিটমিটে আলোয় খাঁ খাঁ করছে ।অদূরে চিন্তা মগ্ন এক পুরুষ এক নাগাড়ে সিগারেট টেনে চলছে ।বিষাক্ত বাতাসকে আরো বিষাক্ত করে তুলছে ।আবির হন হন করে সিস্টারদের পাশ কাটিয়ে এমার্জেন্সি তে পৌঁছায় ।জগতে এমন ঘটনা ঘটে বলে তার জানা নাই !এযে তার সেই আট বছর পূর্বে হারিয়ে যাওয়া অপরিচিতা ।জ্যোতির বড় বোনের নাম সেঁজুতি ।বয়সের পার্থক্য ব্যতীত আর কোনো অমিল নেই ।আবির কাছে গিয়ে বললো -তুমি !
সেঁজুতির আরক্ত মুখে অস্পষ্ট হাসির রেখা ।সিস্টার এসে রিপোর্ট দিয়ে গেলো ।আবির রিপোর্টে চোখ বোলায় -বেবি ক্রস পসিশনে ,ব্লাড প্রেসারে এবনরমাল।রক্ত লাগবে ।সব মিলিয়ে রুগীকে বাঁচানো দায় ।
আবির বললো -প্রসূতির গার্ডিয়ান কে ডাকো ।
কিছুক্ষন পর অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকা মধ্যবয়স্ক ধূমপায়ী পুরুষটি তার সামনে এসে হাজির হলো ।মাথায় কদম ছাট চুল ।মোটা দুই ঠোটের সাথে বেমানান গোঁফ।শার্টের উপরের দুটো বোতাম খোলা ।বুকের লোম গুলো সজারুর কাটার মতো ।গলায় স্বর্ণের চেইন চকচক করছে ।ভ্রর উপরে মোটা কাটা দাগ ।
-আপনার পরিচয়?
-আজ্ঞে ,আমি সেঁজুতির হাজব্যান্ড ।
-ওহ আচ্ছা ,অঙ্গীকার নামায় সাক্ষর করুন ।
লোকটির হাতের কলম থর থর করে কাঁপছে ।বেমানান করে বড় বড় অক্ষরে লিখে দিলো জ-ব্বা-র ।কলম ধরার ধরণ দেখে মনে হলো জব্বারের সচরাচর কলম ধরার অভ্যাস নেই ।জব্বারের পিছনে আরেকজন ভীতত্রস্ত পুরুষ ।
-আর আপনি ?
সেঁজুতি আমার মেয়ে । ওহ আচ্ছা ।
সেঁজুতিয়ে অপারেশন থিয়েটারে ঢোকানো হলো ।প্রায় ত্রিশ মিনিট পর সেঁজুতির একটি ফুটফুটে পুত্র সন্তানের জন্ম দিলো ।
২
মানুষ এমন পাষণ্ড হতে পারে ?আবির যতবার সেঁজুতির বেকবোনে ইঞ্জেকশন পুশ করতে গিয়ে মোটা ক্ষতের কালচে দাগ গুলোর দিকে তাকায় ততো বারই শিউড়ে উঠে ।এই ক্ষত চিহ্ন যে সযত্নে এঁকেছে সে কতটা নিচ ,কতটা পাষণ্ড !অবলা নারীকে আঘাতের মাধ্যমেই কি একজন পুরুষের পুরুষত্ব প্রকাশিত হয় ? কখনোই না ।অন্তত আবির এই কথা ভাবতে পারে না ।
সেঁজুতির জ্ঞান ফিরেনি ।লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়েছে ।বাঁচার সম্ভাবনা ক্ষীণ।
জব্বারের চোখে মুখে সে কি খুশি ।বংশের প্রদীপ জ্বালাতে তাকে কম কাঠখড় পুড়াতে হয়নাই স্ত্রীর চিন্তা যেনো তার মাথাতেই আসছেনা ।সারারাত মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে
সকালের মৃদু আলো ফোটার সাথে সাথেই সেঁজুতির শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করলো ।জানালা গলে আসা ভোরের আলো টুকু যেনো তাকে শেষ আর্শীবাদ দিচ্ছে ।তার অর্ধ মুদিত চোখ কাকে খুঁজছে তা বলা কঠিন ।জ্যোতি আর তার পিতা শোকে অর্ধ পাগল ।
আবির সেঁজুতির বাবাকে তার কক্ষে ডেকে বললো -এই নিন আমার উকিল বন্ধুর ঠিকানা ।আমার কথা বললেই মামলার ব্যবস্থা করে দিবে ।দেরি করবেন না ,এক্ষুনি যান ।
কন্যা শোকগ্রস্থ পিতা কাতর কণ্ঠে বললেন -বাবা ওরা পশুর জাত ।মানুষ না ওরা ।আমার এক মেয়েকে মেরে ফেলেছে ,এখন কিছু করলে আরেক মেয়েকে বাঁচতে দিবেনা ।
আবির দৃঢ় কণ্ঠে বললো -ভয় পাবেন নাহ চাচা ।আমি পাশে আছি ।জ্যোতি বলেছে তার কাছে সেঁজুতির ডাইরি আছে ।আর কয়েকটি সিসিটিভি ফুটেজ ।আর এর চেয়ে বড় প্রমান আপনার মেয়ের শরীর ।মামলায় আমরাই জিতবো ।চিন্তা করবেন না ।অপরাধী এতো সহজেই পার পেয়ে যাবে -তা হতে দেয়া যাবেনা ।থাক আপনাকে যেতে হবেনা ।আমি নিজেই যাচ্ছি ।
৩
সকাল হয়েছে ।বাতাবি ফুলের সুবাস আসছে বাগান থেকে ।দুদিনের ধকলের ক্লান্তি এখনো লেপ্টে আছে চোখে মুখে ।করিম চা দিয়ে গেছে অনেক্ষণ আগেই ।কিন্তু আবিরের বিছানা ছেড়ে উঠতে মন চাচ্ছেনা ।আরেকটু বিছানায় গড়াগড়ি দিলে ভালো হতো ।বাহিরে হর্ণের শব্দে আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসলো -এতো সকালে আবার কে এলো ?
করিম তিন পা দিয়ে হন্ততন্ত হয়ে দৌড়ায় আসে ।
-স্যার পুলিশ আইছে ,উঠেন উঠেন ।
সদর থেকে দারোগা এসেছেন ।সাথে এক হালি পুলিশ ।
-স্যার আপনাকে গ্রেফতারের অনুমতি আছে ।চাইলে পড়ে দেখতে পারেন ।
আবিরের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে ।কিছু একটা বলতে যাবে ,তার আগেই দেখতে পায় জ্যোতি আর তার পিতা আসছে ।তাদের কপালে চিন্তার স্পষ্ট ভাঁজ ।
-স্যার ,সর্বনাশ হয়ে গেছে ।কাল রাতে বাড়িতে আগুন লেগেছে ।সব পুড়ে ছাই।কোনো রকমে প্রাণ নিয়ে বেঁচে ফিরছি ।
আবিরের চোখ দুটি থেকে যেনো আগুনের লাভা বের হচ্ছে । অসহায়াত্বের ছাপ স্পষ্ট ।হঠাৎ তার চোখ আটকে যায় সোফার উপর পড়ে থাকা পত্রিকাতে – সেখানে বড় করে তার ছবি দেয়া আর নীচে শিরোনাম-ভুল চিকিৎসায় প্রাণ গেলো প্রসূতির ।আর তার নিচেই তার উকিল বন্ধু মুহিবের রক্ত মাখা শরীর -দুর্বৃত্তের হাতে প্রাণ গেলো এক তরুণ উকিলের ।