স্টেশনের সেই মেয়েটি

0
180

মো. রবিন ইসলাম

স্টেশনের প্ল্যাটফর্মটি ছিল গরমে ঝলসে ওঠা এক দুপুরের নীরব সাক্ষী। বাতাসে ভেসে আসছিল পুরোনো ট্রেনের ধাতব ঘ্রাণ, দূরে কোথাও বাজছিল পিচঢালা রেললাইনের উপর হুইসেলের হালকা অনুরণন। আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম এক কোণায়, গন্তব্যের অপেক্ষায়; কিন্তু জীবনেরই এক অচেনা গল্প এসে দাঁড়াল আমার সামনে।

একটা মেয়ে—বয়স হবে পনেরো কিংবা ষোলো।
চেহারায় অপার্থিব এক মাধুর্য, যেন কারও কল্পনায় আঁকা এক নিঃশব্দ ছবি। মুখখানা শুকনো হলেও এক ধরনের আলো ছড়িয়ে ছিল তাতে—এক ধরনের অনুচ্চারিত সৌন্দর্য, যাকে ব্যাখ্যা করা যায় না, শুধু অনুভব করা যায়। যেন চুপিচুপি কোন কবি তার জন্য কলম ধরেছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত শেষ লাইনটা লিখতে পারেনি।

তার চোখে ছিল ক্লান্তির ছায়া—অথচ তাতে লুকিয়ে ছিল এক রকম গাম্ভীর্য, এক অস্ফুট যন্ত্রণার সৌন্দর্য, যেটা কেবল দীর্ঘ সহ্য থেকে জন্মায়।

চুলগুলো রুক্ষ ও এলোমেলো, যেন অনেক দিন জলে ভেজেনি। পরনে ছেঁড়া জামা—দারিদ্র্য ও সময়ের করাতচালিত নকশা, যেটা বহুবার টেনে ছিঁড়েছে কাপড়ের সুরক্ষা। জামার ছেঁড়ার ফাঁক গলে যেন উঁকি দিচ্ছিল একটি ভাঙা জীবনের শব্দহীন ভাষা, একটি নিষ্প্রাণ আর্তি।

তার শরীরটা কেমন চাপা গড়নের—ক্ষীণ, শুকনো। কিন্তু তবুও, কাঁচা যৌবনের আবছা রেখা তার চলনে-বলনে অনিচ্ছাসত্ত্বেও ধরা দিচ্ছিল। সে হাঁটছিল ধীরে ধীরে, কিন্তু প্রতিটি পা যেন বলে যাচ্ছিল—“আমি অভ্যস্ত, আমি বুঝে গেছি বাঁচতে হলে হেঁটে যেতেই হয়।”

আমি তাকিয়ে ছিলাম। অপলক, নিঃশব্দ।

মেয়েটি বুঝতে পারল আমি তাকিয়ে আছি। সে হালকা মুচকি হাসল।
না, সে হাসি প্রেমের নয়।
তা করুণা কিংবা অভিমানও নয়।
সে এক অভ্যস্ততার হাসি—যেমনটা একজন প্রতিনিয়ত অবহেলায় বেড়ে ওঠা মানুষ আপন করে নেয়।
যেমনটা কোনো ভিখিরি হাসে রোজকার প্রত্যাখ্যানের পরও।

লিখুন প্রতিধ্বনিতেলিখুন প্রতিধ্বনিতে

তার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন এক বৃদ্ধ। চামড়ার ভাঁজে বয়সের ইতিহাস লেখা, চোখে ম্লানতা—মুখে রোদে পোড়া জীবনের বহু বছরের খরচপত্র। মেয়েটি তার হাত ধরে রেখেছে—মাঝেমধ্যে যেন টেনে পথ দেখিয়ে দিচ্ছে।

আমি তখনও দাঁড়িয়ে।
মনে হচ্ছিল, পুরো স্টেশন নিঃশব্দ হয়ে গেছে। চারপাশের কোলাহল দূরে কোথাও মিলিয়ে গেছে, শুধু ওদের দু’জন—এক বৃদ্ধ, এক কিশোরী—আমার চোখের সামনে জীবন্ত ছবি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

তারা আমার দিকে এগিয়ে এল।

মেয়েটি বলল,
“পাচঁটা টাকা দেন, স্যার।”

তার কণ্ঠ ছিল স্তব্ধ করা শান্ত।
কোনো উত্তেজনা নয়, কোনো আবেগ নয়।
শুধু একটি বাক্য, যেন বহুবার বলা, বহুবার শেখা—
এমন এক বাক্য যা তার কাছে একটি ভাষ্য নয়, বরং জীবনের অনুবাদ।
‘পাচঁটা টাকা’—এই পৃথিবীতে তার সবচেয়ে চেনা প্রার্থনা।

আমি কিছু বললাম না।
চুপ করে তাকিয়ে রইলাম তার মুখের দিকে।
ভাবছিলাম, এমন একটি মেয়ে—যার মুখের রেখায় লুকিয়ে থাকতে পারত কবিতার উপমা, যার চোখে জ্বলতে পারত স্বপ্নের আগুন—সে কিনা আজ আমার সামনে হাত পেতে দাঁড়িয়ে আছে!
তার ঠোঁটের কোণেই তো লুকিয়ে ছিল মুগ্ধতার ঘ্রাণ।
সে কি পারত না কারও হৃদয়ের রানী হতে?

পকেট থেকে বিশ টাকার একটি নোট বের করলাম।
নোটটা তার হাতে দিলাম।

সে কিছু বলল না।
কোনো কৃতজ্ঞতার চিহ্নও ছিল না।
শুধু বৃদ্ধ লোকটির হাত ধরে আবার হাঁটতে শুরু করল।

আমি তাকিয়ে রইলাম।
একটি অদ্ভুত শূন্যতা আমার ভেতর জন্ম নিচ্ছিল।
একটা মৃদু হাওয়া বইল, যেন চুপিচুপি বলল, “এই মেয়েটির গল্প শেষ হয়নি।”

সে একটু এগিয়ে গিয়ে ফিরে তাকাল।
পুনরায় হাঁটল।
আবার তাকাল।

সেই দৃষ্টিতে কি ছিল কৃতজ্ঞতা?
না কি এক অনন্ত প্রশ্ন,
“যদি আমি এমন না হতাম, আপনি কি তখনও এমনভাবে তাকাতেন?”

আমি স্থির দাঁড়িয়ে ভাবছিলাম—
যদি সে ধনী কোনো ঘরে জন্মাত, যদি তার জীবনেও থাকত আলো, বই আর রঙিন জামা—তবে সে আজ এমনভাবে আমার সামনে দাঁড়াত না।
তাকে দেখে হয়তো কেউ কবিতা লিখত, কেউ প্রেমপত্র—কিন্তু কেউই ভিক্ষা চাইত না।
তাকে নিয়ে হয়তো একদিন কেউ বলত,
“তার চোখে ছিল অনন্তের আলো”,
কিন্তু আজ সে শুধুই একজন পথচলার ক্লান্ত সঙ্গী—একজন অস্পষ্ট মুখ।

হাইরে নিয়তি।

ট্রেনের হুইসেল বেজে উঠল।
আমি বাস্তবে ফিরলাম।

সিঁড়ি বেয়ে ট্রেনে উঠতে উঠতে পেছন ফিরে আর একবার দেখতে চাইলাম মেয়েটিকে।
সে তখন অদৃশ্য হয়ে গেছে।
নাকি আমি চাইলেই আর দেখতে পাচ্ছি না?

ট্রেন ছাড়ল।

আমি জানালার কাঁচে ভর দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইলাম।
চোখের সামনে স্টেশনের দৃশ্য একে একে পেছনে সরে যেতে লাগল।
ঠিক যেমনভাবে কিছু স্মৃতি জীবনে ধীরে ধীরে ঝাপসা হয়ে যায়।

আর আমি বুঝলাম— আমরা কেউই কোনোদিন পুরোপুরি তাড়াতে পারি না এমন কিছু মুখ।
যারা আমাদের ছুঁয়ে যায় নিঃশব্দে,
শুধু তাকিয়ে থেকে, কিছু না বলে—
আমাদের ভেতরে রেখে যায় এক শব্দহীন আর্তি।

Previous articleটয়লেট
Next articleগ্রীষ্ম ও গ্লাসটা
প্রতিধ্বনি
প্রতিধ্বনি একটি অনলাইন ম্যাগাজিন। শিল্প,সাহিত্য,রাজনীতি,অর্থনীতি,ইতিহাস ঐতিহ্য সহ নানা বিষয়ে বিভিন্ন প্রজন্ম কী ভাবছে তা এখানে প্রকাশ করা হয়। নবীন প্রবীণ লেখকদের কাছে প্রতিধ্বনি একটি দারুণ প্ল্যাটফর্ম রুপে আবির্ভূত হয়েছে। সব বয়সী লেখক ও পাঠকদের জন্য নানা ভাবে প্রতিধ্বনি প্রতিনিয়ত কাজ করে চলেছে। অনেক প্রতিভাবান লেখক আড়ালেই থেকে যায় তাদের লেখা প্রকাশের প্ল্যাটফর্মের অভাবে। আমরা সেই সব প্রতিভাবান লেখকদের লেখা সবার সামনে তুলে ধরতে চাই। আমরা চাই ন্যায়সঙ্গত প্রতিটি বিষয় দ্বিধাহীনচিত্ত্বে তুলে ধরতে। আপনিও যদি একজন সাহসী কলম সৈনিক হয়ে থাকেন তবে আপনাকে স্বাগতম। প্রতিধ্বনিতে যুক্ত হয়ে আওয়াজ তুলুন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here