নূরে আলম আফ্রিদী
শহরের গলিপথে ভোরের কুয়াশা মিশে ধুলো জমে। পেছনের রাস্তা বাঁক ঘুরে যায় অন্ধকারের কোণে, যেখানে সেসব আলো পৌঁছায় না। আকাশে ধীরে ধীরে সূর্যের হালকা লাল ছায়া ছড়িয়ে পড়ে, কিন্তু ওখানে কারখানার মেঠো গলিতে এখনও ঘুম নেই। কাঁদছে কুকুরেরা—তাদের অজানা বেদনা আর ক্ষুধার একটা মৃদু চিৎকার। গলির দু’পাশে দেহখানি কুয়াশা আর ধুলোয়ের চাদর মুড়িয়ে রাখা দেয়ালগুলো যেন গাঢ় কালো ক্যানভাসের মতো। তাদের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে একটা গুদামঘর, যার দরজা সারাক্ষণ বন্ধ। সবাই বলে—কারখানা। কিন্তু আসলে? সেখানে শুধু গরম গরম ধোঁয়া আর মানুষের হাঁপানি জমে থাকে। বাতাস নেই। জীবনের গন্ধ নেই। শুধু লোহা, পরিশ্রম আর ক্লান্তির একটা অদ্ভুত আভা। সকালে ঘুম ভেঙে একশো কুড়ি জন মানুষ ওই দরজায় ঢুকে পড়ে। সন্ধ্যায় বের হয় নব্বইজন, বাকিরা যেন ধোঁয়ার মতো হারিয়ে যায় গন্ধহীন ওই ঘরে।
মাহবুব। বয়স বাহান্ন নয়, তেতাল্লিশ। তিন ছেলে। এক মেয়ে। স্ত্রী বিছানায়। ঘাড়ে ঝুলে ওষুধের হিসাব। মাহবুব চুল্লির পাশে কাজ করে। হাতুড়ি মারে। লোহার শিট পেটায়। প্রতিদিন। আজ রুবেল প্রথমবার কাজে এসেছে। রুবেল বলল, — “ভাই, এইখানে কয় বছর হইলো?” মাহবুব একবার তাকায়, আবার হাতুড়ি তোলে। বলে না কিছু। রুবেল আবার, — “আপনে কয় বছর ধইরা এই কাম করেন?” মাহবুব এবার বলে, — “এইখানে সময় নাই। এখানে ফুসফুস আছে, হঠাৎ কমে যায়।” রুবেল হেসে ফেলে। — “আমি টেকা জমায়া বাইক কিনুম। হইলে হিরো গ্ল্যামার… না হইলে পালসার।” মাহবুব কিছু বলে না। হাতুড়ির শব্দই তার উত্তর। তিনবার মারে। চুপ করে।
সামিউল হাসান। মালিক। মার্কেটিং বোর্ডে তার নাম সোনালি হরফে লেখা। সে কারখানায় আসে না। দেয়ালে স্ক্রিন আছে। সেখানে মানুষের চলাফেরা দেখা যায়। ঘামের স্প্রিন্ট। দেয়ালের ঘষা। বুটের ফস ফস। সে একদিন এক রিপোর্টারকে বলেছিল, — “আমি শুধু কাজ দেই না, মানুষ বানাই।” রিপোর্টার বলেছিল, — “অসাধারণ দৃষ্টিভঙ্গি।” তারপর ওয়েস্টিনে গিয়ে শুঁটকি রেজালা খেয়েছিল।
চুল্লি ফেটে গিয়েছিল দুপুরে। হঠাৎ শব্দ হয়েছিল। বিস্ফোরণ না। ধপ করে অদ্ভুত আওয়াজ। তিনজন পুড়ল। কেউ চিৎকার করেনি। শুধু একজন মাটিতে গড়িয়ে পড়েছিল। তাকে তুলেছিল মাহবুব। রুবেল পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। হাত-পা কাঁপছিল। মাহবুব জিজ্ঞেস করেছিল, — “ধর, ধইরা রাখ।” রুবেল কিছু না বলে পেছনে সরে দাঁড়িয়েছিল। সেই রাতে মাহবুব তিনজনকে রিকশায় করে হাসপাতালে নেয়। রিকশাওয়ালা জিজ্ঞেস করেছিল, — “রক্ত লাগবো না তো ভাই?” মাহবুব বলেছিল, — “ওরা পুড়ছে। রক্ত নেই। শুধু গন্ধ।” হাসপাতালে নার্স বলেছিল, — “ইনস্যুরেন্স কই?” মাহবুব বলেছিল, — “মানুষ হলে লাগে?” নার্স তাকিয়ে ছিল। আবার বলেছিল, — “প্রমাণ দেন।”
পরদিন সকালে গেটের পাশে সাদা কাগজ ছিল। ছোট হরফে লেখা:
“ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে নিজ দায়িত্বে থাকবেন। কোম্পানি দায় নেবে না।”
রুবেল এসে দাঁড়িয়েছিল। চুপচাপ পড়ছিল। মুখে শব্দ ছিল না। তারপর সে বলেছিল, — “ভাই, বাইক না কিনলেও চলবে।” মাহবুব কিছু বলে না। সামনে তাকিয়ে থাকে। চুল্লির ভিতর থেকে ধোঁয়া উঠছিল।
সামিউল বিদেশিদের আনল। তিনটা মাইক্রোবাসে। পারফিউম, কোল্ড ড্রিংকস, কাগজের ফুল। শ্রমিকদের নতুন মাস্ক দেওয়া হয়। চিপসের প্যাকেটও। একজন বিদেশি বলল, — “ওয়াও। ইয়োর ওয়ার্কার্স আর সো ডিসিপ্লিনড!” সামিউল হাসল। বলে, — “দে আর লাইক ফ্যামিলি।” মাহবুব মাস্ক পরে ছিল। কিছু বলল না। হাতুড়ি নামায়। ধীরে। রুবেল তার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। নিচু গলায় বলল, — “আপনি টিকবেন না ভাই।” মাহবুব বলল না কিছু।
সেই রাতে মাহবুব ফেরে না। তার বিছানা ফাঁকা ছিল। স্ত্রী জিজ্ঞেস করেনি। ছেলেরা টিভি দেখছিল। পরদিন সকালের শিফটে, চুল্লির পাশে একটা হাতুড়ি ছিল। পুরনো। ভাঙা না, চলতেও পারে। চুল্লির দেয়ালে একটু দাগ। ধোঁয়া জমে জমে ছাই হয়ে গেছে। রুবেল বলেছিল, — “ভাই নাই।” একজন বলল, — “মরছে?” রুবেল মাথা নাড়ে না। — “পলায় নাই। এইখানে কই যাবে?” আরেকজন বলে, — “মরলে গন্ধ থাকত।”
তামার দরজার ভেতরে মানুষ ঢোকে। বের হয় হিসাব করে—কার কত বাঁচা বাকি। মাহবুব নাই। তবে কেউ কেউ শোনে—চুল্লির ভিতরে একটা আওয়াজ। শব্দটা হাতুড়ির না। আলোড়নের না। একটা গলা—ধীর। জ্বালায় না। জিজ্ঞেস করে:
“আমিও মানুষ… তোমরা কি দেখো?”