ভূতুড়ে চাঁদনীরাত

0
122

শাকেরা বেগম শিমু


সে ছিলো অনেক আগের কথা! আমি ছিলাম ক্লাস টু তে। তখন বিকালবেলা আমরা সবাই দলবেঁধে গোল্লাছুট ও হায় ঝুমঝুম খেলতাম। কখনো লুকোচুরি বা হা ডু ডু। আর মাঝেমধ্যে সবাই মিলে একসঙ্গে যেতাম মাঠে ঘুড়ি উড়াতে, বা বড়বাড়িতে তেঁতুল কুড়াতে। বড়বাড়িতে ছিলো বিশাল এক তেঁতুলগাছ! লোকেরা বলতো ঐ গাছে নাকি জ্বীনের বাস। কিন্তু আমরা ওসব জ্বীন-ভূত এর গল্পটা নিছক গল্প বলেই উড়িয়ে দিতাম। এর সত্যতা কতটুকু তা যেমন আমাদের কারো জানা ছিলোনা তেমনি তা জানার প্রয়োজনও বোধ করিনি। মনে আছে, সেদিন বুধবার। আমরা একগুচ্ছ ছেলেমেয়ে বড়বাড়িতে যাই তেঁতুল কুড়াতে। সেখানে আমি, মিজান, ছোটভাই, জুবেরসহ আরো কয়েকজন ছিলাম। ফলকুড়াতে আমাদের কী যে মজা হচ্ছিলো তখন যতোটা হয়তো ফল খেতেও হয়না। তখন প্রতিযোগিতা হতো কে বেশি তেঁতুল কুড়াতে পারে। এ নিয়ে বিজয়ীরা গর্ব ও বাহ্বা পুরষ্কারও পেতো। এভাবেই চলতো আমাদের তখনকার সোনালী দিনগুলো।
সেদিন বিকালবেলা আমরা পুরো তেঁতুলবন চষে শেষে আমারই বেশি তেঁতুল কুড়ানো হয়েছে বলে নিজেই নিজের ঢাক পেটাচ্ছিলাম। একপর্যায়ে কাঁচাপাকা আধাপাকা পোকাধরা তেঁতুলগুলো খেয়ে আমরা বাড়ি ফিরে আসি। বাড়িতে এলেও কিন্তু আমার মন থেকে ঐ তেঁতুলকুড়ানোর প্রতিযোগিতার ভাবনাটা গেলোনা তখনো! সেদিন রাতে আমার প্রস্রাবের বেগ পেয়ে ঘুম ভেঙে যায়। আমি তখন বাথরুমে গিয়ে কাজ সেরে আসার সময় ভেন্টিলেটর দিয়ে বাইরের কিছুটা আলো দেখতে পাই। তখন আমার মাথায় গতকালকের তেঁতুল কুড়ানোর কথাটা আসে! ভাবলাম এসময় যদি আমি বড়বাড়ির তেঁতুলতলায় চলে যাই তাহলে তো সবার চেয়ে বেশি’র রেকর্ড টা আমার ভাগেই চলে আসবে! যেই ভাবা সেই কাজ। আমি চলে গেলাম গুটিগুটি পায়ে সেই নিশিতে বড়বাড়ির দিকে! যেতে যেতে মাঝেমধ্যে অবশ্য আমার পুরো শরীর শিউরে উঠছিলো। কেবলই মনে হচ্ছিলো কে যেন আমার পিছু পিছু হেঁটে আসছে। আমি সেটা পাত্তা না দিয়ে যখন তেঁতুলতলায় পৌঁছে যাই তখন আমার আনন্দ দেখে কে!কেননা সেসময় অনেক তেঁতুল পড়েছিলো গাছটির নিচে। আর এখন এখানে মিজান, জুবের, মণিভাই বা রুম্মান কেউই নেই। আমি একাই! মনের খুশিতে আমি লাফাতে লাফাতে তেঁতুল কুড়াতে শুরু করি। আমার পরনে ছিলো হাফপ্যান্ট ও ফ্রক। প্যান্টের দুদিকে ও পিছনে দুটি করে মোট চারটি পকেট ও ফ্রকের সামনের দিকেও একটি পকেট ছিলো। সবগুলোই তেঁতুলফলে ভর্তি হয়ে গেলে আমি আনন্দে নেচে উঠলাম। আজ সবাইকে দেখানো যাবে কে বেশি কুড়িয়েছে! কি মজা!


তখন দেখতে পেলাম একটি ছোট্ট ছেলে পা দুটো স্থির রেখেই বাতাসে ভেসে আমার দিকে এগিয়ে আসছে! ছেলেটি আমার কাছে এসে বললো- ‘এই মেয়ে তুই কি বাঘকে ভয় পাস’? আমি অহংকারের সাথে বলে উঠি -না! এই বলে পায়ের কাছ থেকে আরেকটি তেঁতুল কুড়িয়ে উঠতেই দেখি ছেলেটি বেমালুম হাওয়া হয়ে গেছে! কিন্তু এতো তাড়াতাড়ি ও এখান থেকে গেলো কোথায়! এইটুকু সময়ের মধ্যে খোলামেলা জায়গায় কেউ চোখের আড়াল হবে! এতো বিশ্বাসযোগ্য নয়! তবে আমি এ নিয়ে আর মাথা না ঘামিয়ে তেঁতুল কুড়াতে মন দিই। গাছের নিচে দাঁড়িয়ে লম্বা তেঁতুল গাছের মগডালের দিকে তাকাতেই দেখি একটি বিশালদেহী বাঘ গাছের মগডাল বেয়ে নেমে আমার দিকেই হেঁটে আসছে! কিন্তু আমি বুঝতে পারলাম না এখানে বাঘটি এলো কোথা থেকে? আর বাঘটি খাড়া গাছের উল্টোদিকেই বা হেঁটে আসছে কিভাবে! ডোরাকাটা সেই বাঘটি দেখে আমি অনেকটা ঘাবড়ে যাই। তাড়াতাড়ি সেখান থেকে অন্য জায়গায় গিয়ে আবার তেঁতুল কুড়াতে লেগে যাই। সেখান থেকে আবার গাছটির দিকে ভয়ে ভয়ে তাকাতেই দেখি বাঘটি আর সেখানে নেই!!! ততক্ষণে আমার তেঁতুল কুড়ানোও প্রায় শেষ। ফ্রক ও প্যান্টের সবগুলো পকেটই কানায় কানায় ভরে গেছে। তাই ভাবলাম এখন বাড়ি চলে যাই নচেৎ বড়বাড়ির লোকেরা এতক্ষণে জেগে গেছে হয়তো। আর জেগে বাইরে এলেই তো দেখে ফেলবে আমাকে! তখন যদি আব্বুর কাছে নালিশ করে তবে আব্বু কি আমাকে আর আস্ত রাখবে! বলে রাখা ভালো এলাকায় আমার আব্বুর যতেষ্ঠ নাম-যশ ছিলো। আব্বু শুনলে আমার পিঠে আস্ত কাঠের চেল্লা ভাঙবে! এই ভেবে যেই না আমি বাড়ির দিকে পা বাড়িয়েছি তখনই হঠাৎ আমার কানে ভেসে এলো মুয়াজ্জিনের সুমধুর কণ্ঠের আযান! আমি চমকে উঠে ভাবি এসময়ে আবার কেউ আযান দেয় নাকি? এতক্ষণে তো প্রায় ভোরের আলো ফুটে উঠলো বলে! হঠাৎ কোন অদৃশ্য শক্তি আমার মুখটা উপরের দিকে তুলে ধরলো। আমি দেখতে পেলাম আকাশের ফুটফুটে রূপালী চাঁদটাকে! তার থেকে ঝরে পড়ছিলো স্নিগ্ধ চাঁদনী! তার মানে ভেন্টিলেটরে আমি যে আলো দেখেছিলাম সেটা ছিলো এই চাঁদের আলো! ইন্নালিল্লাহ! আর আমি সেটাকেই ভোরের আলো ভেবে এই মধ্যরাতে এক কিলোমিটার দূরে এখানে একাই চলে এসেছি!

লিখুন প্রতিধ্বনিতেলিখুন প্রতিধ্বনিতে

একথা ভাবতেই আমার আপাদমস্তক কাটা দিয়ে উঠলো! গাঁয়ের মধ্যে কাঁপুনি শুরু হয়ে গেলো! এই নির্জন ভূতুরে পরিবেশে ভয়ে আমার সারা শরীর ছমছম করে উঠলো! তখনই বুঝলাম যে মুয়াজ্জিন এর দেয়া সেই আযানটিই ছিলো আসলে ফযরের প্রথম আযান। আর আমার জানা ছিলোনা যে সেদিনের ঐ রাতটি ছিলো একটি “চাঁদনীরাত”!!!

Previous articleদহন বেলা
Next articleরহস্যে ঘেরা ডোর টু হেল: নরকের দরজা
প্রতিধ্বনি
প্রতিধ্বনি একটি অনলাইন ম্যাগাজিন। শিল্প,সাহিত্য,রাজনীতি,অর্থনীতি,ইতিহাস ঐতিহ্য সহ নানা বিষয়ে বিভিন্ন প্রজন্ম কী ভাবছে তা এখানে প্রকাশ করা হয়। নবীন প্রবীণ লেখকদের কাছে প্রতিধ্বনি একটি দারুণ প্ল্যাটফর্ম রুপে আবির্ভূত হয়েছে। সব বয়সী লেখক ও পাঠকদের জন্য নানা ভাবে প্রতিধ্বনি প্রতিনিয়ত কাজ করে চলেছে। অনেক প্রতিভাবান লেখক আড়ালেই থেকে যায় তাদের লেখা প্রকাশের প্ল্যাটফর্মের অভাবে। আমরা সেই সব প্রতিভাবান লেখকদের লেখা সবার সামনে তুলে ধরতে চাই। আমরা চাই ন্যায়সঙ্গত প্রতিটি বিষয় দ্বিধাহীনচিত্ত্বে তুলে ধরতে। আপনিও যদি একজন সাহসী কলম সৈনিক হয়ে থাকেন তবে আপনাকে স্বাগতম। প্রতিধ্বনিতে যুক্ত হয়ে আওয়াজ তুলুন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here