মায়ের ঋণ:এক অনন্ত ভালোবাসার প্রতিচিত্র

0
180

ঊকাবা বিন রাফ’স (রূপক)

কখনো ভেবে দেখেছেন, আমরা এই পৃথিবীতে কীভাবে এলাম? আমাদের অস্তিত্বের সূচনা কোথায়?
সেই সূচনা হয় মায়ের গর্ভে, যেখানে আমরা দশ মাস দশ দিন শুয়ে থাকি, আমাদের শরীর গঠিত হয়, আমাদের হৃদস্পন্দন ধীরে ধীরে শক্তিশালী হয়। এই সময়টাতে একজন মা প্রতিদিন এক ধরণের মৃত্যুযন্ত্রণা সহ্য করেন—তার শরীরের প্রতিটি অঙ্গ পরিবর্তিত হয়, তার রক্তপ্রবাহের ধরণ বদলায়, তার হাড়-মাংসের গঠন পর্যন্ত নতুনরূপ ধারণ করে।

মা যদি চান, তবে তিনি এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে পারেন। কিন্তু তিনি তা করেন না। কেন? কারণ, তাঁর ভালোবাসা নিঃস্বার্থ।

একজন মা যখন সন্তান জন্ম দেন, তখন তিনি জীবনের সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হন।
প্রসবকালীন ব্যথা একজন মানুষের শরীরে একসাথে ২০টি হাড় ভাঙার ব্যথার সমান!
এই সময়ে মৃত্যুর ভয়, অসহ্য যন্ত্রণা ও রক্তক্ষরণের আতঙ্ক থাকে, কিন্তু মা সব ভুলে যান যখন তার সন্তান প্রথমবার কাঁদে।

প্রথমবার যখন মা তাঁর নবজাতককে কোলে নেন, তখন তিনি কোনো কষ্টের কথা মনে রাখেন না। সন্তান তার চোখের দিকে তাকালে, সেই দৃষ্টিতেই তাঁর সমস্ত ব্যথা, সমস্ত কষ্ট লাঘব হয়ে যায়।

এটাই মাতৃত্বের প্রথম পর্ব। কিন্তু এই ত্যাগ এখানেই শেষ হয় না।

জন্মের পর সন্তানের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ স্থান হচ্ছে মায়ের কোল।
সন্তান অসহায়, সে চলতে পারে না, কথা বলতে পারে না, খেতে পারে না—তাকে সব কিছুই মা করে দেন।

একটি শিশু দৈনিক ১৫-২০ বার কান্না করে।
প্রতিটি কান্নার পেছনে কোনো না কোনো কারণ থাকে—ক্ষুধা, ব্যথা, ভয়, ক্লান্তি।
কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো, এই প্রতিটি কান্নার অর্থ মা ঠিক বুঝতে পারেন!
তিনি বুঝতে পারেন, সন্তান এখন ক্ষুধার্ত, এখন ওর জ্বর এসেছে, এখন ও ভয় পেয়েছে।

এই পর্যায়ে মা একজন ডাক্তার, একজন দার্শনিক, একজন সাইকোলজিস্ট, একজন নার্স, একজন শিক্ষক—সব কিছুর সমন্বয়!

তিনি সারারাত জেগে সন্তানের মাথায় হাত বুলিয়ে দেন।
তিনি নিজে অভুক্ত থাকেন, কিন্তু সন্তানকে খাইয়ে দেন।
তিনি নিজের ঘুম বিসর্জন দেন, যেন সন্তান নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারে।

কিন্তু এই ভালোবাসার মূল্য আমরা দিই তো?

একটা সময় আসে, যখন সেই সন্তান মায়ের হাত ধরে হাঁটা শেখে, কথা বলা শেখে, স্কুলে যায়।
এই সময় মা তাঁকে সংসার ও সমাজের পাঠ শেখান।

কিন্তু এই বয়স বাড়ার সাথে সাথে সন্তানের জীবনেও পরিবর্তন আসে।
এক সময় যে শিশু “মা মা” বলে সারাদিন চিৎকার করত, সেই সন্তান ধীরে ধীরে মাকে অবহেলা করতে শেখে।

প্রথম অবহেলা হয় কিশোর বয়সে।
এই সময় সন্তান ভাবে, “মা তো বোঝে না, মা তো পুরনো যুগের মানুষ, মা শুধু বকাবকি করে!”

এরপর সেই সন্তান যখন তার নিজস্ব জীবন গড়তে শুরু করে, তখন সে মায়ের কথা শুনতে চায় না।
সে ভাবে, “মা তো গ্রামে থাকে, মা তো অশিক্ষিত, মা তো শুধু পুরনো চিন্তা করে!”

এই অবহেলা ধীরে ধীরে নিঃসঙ্গতার দিকে ঠেলে দেয় মাকে।

যে মা একদিন সন্তানের জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন, সেই মা-ই একদিন সন্তানের কাছে বোঝা হয়ে যান!

কত সন্তান আজ তাদের মাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দিয়েছে!
কত মা আজ অভুক্ত থেকে দিন কাটান!
কত মা আজ একলা একটি ঘরের কোণে চুপচাপ কাঁদেন, কারণ তাদের সন্তানের সময় নেই!

এটাই কি মানুষের পরিণতি?
এটাই কি সন্তানের কর্তব্য?

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একবার লিখেছিলেন—

“মা তোমার কোলে এসে প্রথম দেখেছিলাম আলো,
এখন তোমার কোলেই ফিরে যেতে চাই।”

রবীন্দ্রনাথ জানতেন, মায়ের ভালোবাসা শেষ হয় না, মায়ের ভালোবাসা কখনো বদলায় না।
তিনি বলেছিলেন—

“জগতে যদি কিছু চিরন্তন থাকে, তবে তা হলো মায়ের স্নেহ।”

আমরা কী দিতে পারি আমাদের মায়ের জন্য?

আমরা কি পারি না একটু সময় দিতে?
আমরা কি পারি না তাঁর চোখের জল মুছতে?
আমরা কি পারি না তাঁর মুখে হাসি ফোটাতে?

মায়ের ঋণ শোধ করা যায় না।
কিন্তু আমরা তাঁকে ভালোবাসা দিয়ে তাঁর হৃদয়কে শান্তি দিতে পারি।

“মায়ের দোয়া পাথরকে সোনা বানিয়ে দেয়, আর মায়ের অভিশাপ সফল মানুষকেও পথের ফকির বানিয়ে দেয়!”

তাই, যদি সুখী হতে চাও, তবে মায়ের হাসির জন্য জীবন দাও।

মায়েরা জন্ম দেন। শুধু জন্ম দেন না, তারা একটি জীবনের ভিত গড়ে তোলেন। সেই ভিত এতটাই শক্ত যে, তার উপর দাঁড়িয়ে পৃথিবী জয় করা যায়। কিন্তু সন্তান যখন পৃথিবী জয় করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে, তখন ভুলে যায় সেই ভিত্তি, ভুলে যায় সেই মায়ের নিঃশর্ত ভালোবাসা।

মা কখনো অভিযোগ করেন না, তিনি কেবল অপেক্ষা করেন। সন্তানের প্রতীক্ষায় দরজার দিকে তাকিয়ে থাকেন। সময় গড়ায়, দিন পেরিয়ে যায়, বছর ফুরিয়ে আসে, কিন্তু সেই প্রতীক্ষার শেষ হয় না।

মায়ের ঋণ কি আসলেই শোধ করা যায়?

মা মানে আলো, মা মানে আশ্রয়। সন্তানকে বুকে চেপে ধরে তিনি বলেন—”ভয় পেয়ো না, আমি আছি।” কিন্তু সেই সন্তান একদিন মা-কে রেখে এগিয়ে যায়। তখন মা চুপ করে থাকেন। হয়তো তিনি জানেন, সন্তান একদিন ফিরে আসবে।

কিন্তু সব সন্তান কি ফিরে আসে?

সন্তানের জীবনের প্রথম পাঠ শুরু হয় মায়ের কোলে। প্রথম বুলি মায়ের মুখ থেকে শেখে, প্রথম হাঁটা মায়ের হাত ধরে। অথচ, সেই সন্তান একদিন বলে—”মা, তুমি কিছু বোঝো না!”

মা বোঝেন না?

রাতের পর রাত জেগে মা সন্তানের কপালে হাত বুলিয়ে দেন। সেই স্পর্শে থাকে অদৃশ্য এক আশীর্বাদ। মায়েরা ডাক্তার নন, কিন্তু তাদের হাতের ছোঁয়ায় ব্যথা কমে যায়। মায়েরা বিজ্ঞানী নন, কিন্তু সন্তানের হৃদয়ের সব কথা বুঝতে পারেন। মায়েরা দার্শনিক নন, কিন্তু তারা জানেন কীভাবে সন্তানকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে হয়।

তবুও মায়ের কথা আমরা শুনি না।

একদিন সেই মা-ই একলা হয়ে যান। বৃদ্ধ বয়সে সন্তানের মুখ চেয়ে থাকেন, কিন্তু সন্তান ব্যস্ত থাকে নিজের জীবন নিয়ে। মা অপেক্ষা করেন, দরজার দিকে তাকিয়ে থাকেন, কিন্তু কেউ ফিরে আসে না।

তখন কি সন্তান বোঝে মায়ের ভালোবাসার মূল্য?

যে মা একসময় নিজের খাবার সন্তানের মুখে তুলে দিতেন, সেই মা একদিন সন্তানের কাছে বোঝা হয়ে যান।

কিন্তু মা কি সত্যিই বোঝা?

মায়ের অভিশাপ পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ংকর অভিশাপ। মায়ের চোখের জল পৃথিবীর সবচেয়ে ভারী জল। কেউ যদি সত্যিকারের সুখী হতে চায়, তবে তার একটাই পথ—”মাকে ভালোবাসো।”

মায়ের ঋণ কোনোদিন শোধ করা যায় না।

লিখুন প্রতিধ্বনিতেলিখুন প্রতিধ্বনিতে

Previous articleকবিতার এক পাতা || ২১/০৩/২০২৫
Next articleশুক্রবার
প্রতিধ্বনি
প্রতিধ্বনি একটি অনলাইন ম্যাগাজিন। শিল্প,সাহিত্য,রাজনীতি,অর্থনীতি,ইতিহাস ঐতিহ্য সহ নানা বিষয়ে বিভিন্ন প্রজন্ম কী ভাবছে তা এখানে প্রকাশ করা হয়। নবীন প্রবীণ লেখকদের কাছে প্রতিধ্বনি একটি দারুণ প্ল্যাটফর্ম রুপে আবির্ভূত হয়েছে। সব বয়সী লেখক ও পাঠকদের জন্য নানা ভাবে প্রতিধ্বনি প্রতিনিয়ত কাজ করে চলেছে। অনেক প্রতিভাবান লেখক আড়ালেই থেকে যায় তাদের লেখা প্রকাশের প্ল্যাটফর্মের অভাবে। আমরা সেই সব প্রতিভাবান লেখকদের লেখা সবার সামনে তুলে ধরতে চাই। আমরা চাই ন্যায়সঙ্গত প্রতিটি বিষয় দ্বিধাহীনচিত্ত্বে তুলে ধরতে। আপনিও যদি একজন সাহসী কলম সৈনিক হয়ে থাকেন তবে আপনাকে স্বাগতম। প্রতিধ্বনিতে যুক্ত হয়ে আওয়াজ তুলুন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here