বিচিত্র কুমার
রাহুল একটি ছোট্ট গ্রামে তার মায়ের সঙ্গে থাকত। মা শীলা দেবী ছিলেন একজন একা সংগ্রামী নারী। স্বামী বহু আগেই চলে গেছেন, রাহুলই তার সব। ছেলেকে নিয়ে তার স্বপ্নের কোনো শেষ ছিল না—সে চায়, রাহুল বড় হয়ে একজন সৎ, শিক্ষিত মানুষ হোক।
কিন্তু রাহুলের ছিল এক ভয়ানক অভ্যাস—আলসেমি। ভোরে ঘুম থেকে উঠতে বললে কাঁথা মুড়ে সে বলত, “আরেকটু ঘুমাই মা।” বই খুলে পড়তে বসলে দশ মিনিটের মাথায় হাই তুলে উঠে যেত। মা বকলে বলত, “কাল থেকে পড়বো ঠিকমতো।” কিন্তু সেই ‘কাল’ কোনোদিন আসত না।
রাহুলের বয়স তখন চোদ্দো। স্কুলে পড়াশোনায় দিন দিন পিছিয়ে পড়ছিল সে। শিক্ষকরা বকতেন, হোমওয়ার্ক জমা দিত না, পরীক্ষায় খারাপ করত, ক্লাসে মনোযোগ না দিয়ে জানালার বাইরে তাকিয়ে থাকত। মা বারবার বুঝাতেন, “এই সময়টা জীবন গড়ার সময়। এখন যদি সময় নষ্ট করিস, পরে কিন্তু কষ্ট ছাড়া কিছুই থাকবে না।”
কিন্তু রাহুলের কানে কিছুই ঢুকত না।
গ্রামে একদিন খবর এলো—একটি বড় সুযোগ এসেছে। একটি প্রতিভা ভিত্তিক স্কলারশিপ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। যারা প্রথম দশে থাকবে, তারা শহরের নামী বোর্ডিং স্কুলে বিনা খরচে পড়াশোনা করার সুযোগ পাবে। স্কুলে পড়ুয়া ছেলেমেয়েদের মধ্যে হইচই পড়ে গেল। সবাই নিজের সন্তানকে প্রস্তুত করতে ব্যস্ত হয়ে উঠল। মা শীলা দেবীর চোখেও স্বপ্ন জ্বলতে শুরু করল। সে ভেবেই নিয়েছে, এবার রাহুল নতুন করে নিজেকে গড়ে তুলবে।
রাহুলের এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল দীপ। দীপের পরিবার সাধারণ হলেও সে ছিল পরিশ্রমী আর সময়নিষ্ঠ। সে এই স্কলারশিপ পাওয়ার জন্য নিয়ম করে সকালবেলা উঠে পড়তে শুরু করল, বিকেলে কোচিং করত, রাতে নিজে নিজে রিভিশন করত।
দীপ রাহুলকে বলল, “চল, তুইও আমার সঙ্গে পড়িস। একসঙ্গে চেষ্টা করলে ভালো হবে।”
রাহুল হেসে বলল, “আরে দোস্ত, এখন তো মাত্র এক মাস আছে। তুই পড়, আমি পরে শুরু করবো। শেষ সপ্তাহে সব গুছিয়ে ফেলবো।”
দীপ মাথা নাড়িয়ে আর কিছু বলল না।
দিনগুলো চলে গেল। দীপ একে একে সব বিষয়ের প্রস্তুতি শেষ করল। অন্যদিকে রাহুল সময় নষ্ট করতে লাগল—একবার খেলায় মেতে উঠত, একবার গল্পের বইয়ে, আবার কখনো ফোনে ভিডিও দেখে সময় কাটাত। তার এই আলসেমির মধ্যে মা বহুবার বলার চেষ্টা করেছেন, রাহুল শোনেনি।
হঠাৎ একদিন তার মনে পড়ল, পরীক্ষা তো আর মাত্র এক সপ্তাহ বাকি! সে বই খুলে পড়তে বসল। কিন্তু কিছুই মাথায় ঢুকছিল না। প্রশ্নগুলোর নাম সে আগে শুনেনি। ভীত হয়ে সে দীপের কাছে ছুটে গেল, বলল, “দোস্ত, তোর নোটস দে তো! প্লিজ একটু পড়িয়ে দে!”
দীপ বলল, “আমি তো অনেক আগেই শুরু করেছিলাম। এখন তো এক সপ্তাহে তুই কীভাবে সব শিখবি?”
রাহুল ঘরে ফিরে পড়তে বসল, কিন্তু হঠাৎ করে এত চাপ নিতে না পেরে মাথা ধরল তার। রাতভর জেগে থেকেও কোনো কিছু গুছিয়ে উঠতে পারল না সে।
শেষমেশ পরীক্ষার দিন এসে গেল। সবার চোখে আতঙ্ক, দীপের চোখে আত্মবিশ্বাস। রাহুল ক্লাসে ঢুকেই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। প্রশ্নগুলো তার কাছে অচেনা। কিছু বুঝে লিখল, বাকিটা ফাঁকা রেখে এলো।
ফলাফল প্রকাশিত হলো এক সপ্তাহ পরে। দীপ দ্বিতীয় স্থান অর্জন করে শহরের স্কুলে যাওয়ার সুযোগ পেল। পুরো গ্রাম তাকে বাহবা দিলো, পাড়ার লোকেরা বলল, “এই ছেলেটার ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল।” শিক্ষকরাও দীপের প্রশংসা করলেন।
আর রাহুল? তার নাম তালিকায় নেই।
সে সেদিন রাতে মায়ের কোলে মুখ গুঁজে কেঁদে ফেলল। বলল, “মা, আমি বুঝতে পেরেছি—এই আলসেমির জন্যই আমি সব হারিয়ে ফেলেছি। এবার থেকে বদলাবো, কথা দিচ্ছি।”
মা চোখ মুছে বললেন, “তুই চাইলে তোর সব কিছুই ফিরে পেতে পারিস। শুরু কর এখনই।”
এরপর থেকেই রাহুল বদলে গেল। আর ঘুমিয়ে সকাল নষ্ট করত না, খেলার সময় কমিয়ে পড়াশোনায় মন দিলো, নিয়ম করে দীপের সঙ্গে মিলেই পড়া শুরু করল। শিক্ষকরাও লক্ষ্য করলেন তার পরিবর্তন।
এক বছরের মধ্যে সে নিজেকে একেবারে নতুন করে গড়ে তুলল।
পরের বছর আবার সেই স্কলারশিপ পরীক্ষা এলো। এবার রাহুল প্রস্তুত ছিল। আত্মবিশ্বাস নিয়ে পরীক্ষা দিলো।
ফলাফল প্রকাশিত হলো—রাহুল চতুর্থ স্থান পেল। এবার সে শহরের স্কুলে পড়তে যাওয়ার সুযোগ পেল। মা চোখ ভিজিয়ে বললেন, “তুই পেরেছিস বাবা!”
গ্রামের লোকেরা বলল, “আলসেমির কারণে যে ছেলে একবার পিছিয়ে পড়েছিল, সে নিজের ইচ্ছাশক্তি আর পরিশ্রমে আবার উঠে দাঁড়িয়েছে।”
রাহুল জানত, তার এই পরিবর্তনের পেছনে একটাই বড় শিক্ষা—আলসেমি শুধু সুযোগ নষ্টই করে না, বরং একজন মানুষের সমস্ত ভবিষ্যৎ অন্ধকারে ঠেলে দিতে পারে। আর ঠিক সময়ে চেষ্টা করলে, পরিবর্তন সব সময় সম্ভব।
