জোলেখা আক্তার জিনিয়া
নয়না, হাওরের ধূলোমাখা ছোট শহর ‘মইদারগঞ্জ’-এর মেয়ে। বিশ্ববিদ্যালয় শেষ করার পর যখন সবাই বিশ্রামের অজানা দিনগুলো কাটাচ্ছিল, তখনও নয়নার মন একেবারেই শূন্য ছিল না। শহরের কোলাহলে হারিয়ে যাওয়া জীবনের গণ্ডি পেরিয়ে সে পিছু হটতে চেয়েছিল পুরনো স্মৃতির কাছে, তাদের পৈতৃক গ্রামের দাদুর বাড়িতে। বাবা-মায়ের সঙ্গে নয়, একাই চলে এসেছিল সে — অপরিচিত সেই নিভৃতে হারানোর ইচ্ছা নিয়েই।
বাড়িটি পাকা কাঠ আর পুরনো ইটের তৈরি, বহু দশকের আবেগ জমে থাকা। কিন্তু ভেতরে যেন করুণ বিষন্নতা আর নীরবতা চাপ হয়ে লেগে আছে। দেয়ালে ছড়িয়ে ছিটিয়ে শ্যাওলা আর মেঝেতে কেঁচোর গুহা—বাড়ির হৃদয় যেন নিঃসঙ্গ আর বিষণ্ন। নয়নার দৃষ্টি পড়ে একাকী ছোট একটি ঘরে — একটি খুপরি ঘর, জানালা নেই, শুধু এক অদ্ভুত আয়না কোণায় স্থির।
এই আয়না সাধারণ নয়। তার ফ্রেমে জোড়া লতা-পাতার ধাতব নকশা, আর মাঝখানে ক্ষীণ এক রহস্যময় চিহ্ন — একচোখের মতো, যা যেন গভীর কোনো গোপন রহস্য জাগিয়ে তোলে। নয়না প্রথমে ভাবল হয়ত পুরনো কোনো অলঙ্কার, অথবা প্রজাপতির আঁকা ছায়ার মতো নিদর্শন। কিন্তু রাতের অন্ধকারে, যখন আলো নীরবে দৌড়ায়, তখন সেই চিহ্ন যেন নিজেই আলো ছড়ায়।
রাতগুলো নয়নার জন্য শুরু হলো সেই দিন থেকে, যখন তার ঘুম ভেঙে গেল এক অব্যক্ত শব্দে—ঠক ঠক ঠক। আয়নার কাঁচের মধ্যে কেউ যেন আঙুল ঠুকছে, কিন্তু ঘর নিঃশব্দ। নয়না ঘুম ভাঙলেও আবার ঘুমাতে পারত না; কাচের ফিঙকি পড়ার শব্দ থামত না—কোথা থেকে আসে তা কেউ বুঝে উঠতে পারত না।
পরদিন নয়না বাজার থেকে আনল ঘন কাপড়, আয়নাটি ঢাকতে। যতই সে কাপড় ঢাকত, সকালে সেটা উল্টো খুলে পাওয়া যেত। যেন কাপড় নিজেই দূরে সরে যায়, বা আয়না কাপড়টাকে প্রত্যাখ্যান করে।
একদিন ভিডিও কল করল এক বন্ধুর সঙ্গে, আর আয়নার সামনে সেই জাদুকরী ঘরটা দেখাল। বন্ধুটি হেসে বলল, “তুই তো আয়নার সামনে দাঁড়িয়েছিস, কিন্তু আয়নাতে তো কেউ নেই!”
নয়নার বুক ধড়ধড় করতে লাগল। নিজেকে আয়নার কাঁচে দেখে সে অনুভব করল, যেন তার দৃষ্টি নিজের দিকে নয়, বরং কোনো অদৃশ্য কারো চোখে আটকা পড়ে আছে, যা নিজেকে গিলে ফেলার মতো।
পরদিন দুপুরে নয়না ঘরের বাইরে বাগানে বসে নোট নিচ্ছিল। হঠাৎ এলেন রুকাইয়া খালা—সাদা শাড়ি, হাতে তুঁতপাতার ঝুড়ি, বয়স পঁচাত্তর, চোখে অনির্বচনীয় গভীরতা।
“তুই দাদু সাহেবের নাতনি, নয়না?” তাঁর কণ্ঠে এক অদ্ভুত গা ছমছম করা সুর।
“আপনি আমাকে চিনলেন কিভাবে?” নয়না অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল।
“তোর চোখ দেখে বুঝেছি, তোর রক্তে আয়নার আলো ছড়ায়,” রুকাইয়া বলল, গলায় এক ধরণের রহস্য আর ভয়ের সুর।
সে জানাল, “এই ঘরটায় আগে কেউ থাকত না। রাজবাড়ির তান্ত্রিক রঘু এখানে বাস করত। সে আয়নার মধ্যে মানুষকে নিজের অতীত, ভবিষ্যৎ নয়, বরং অদৃশ্য ভয় দেখাত।”
নয়না কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করল, “এই আয়নাটা কী?”
“এই আয়নার কাঁচে মানুষ নিজেকে দেখে না, নিজের ভীতিগুলো দেখে — হারানো, না পাওয়া, দুঃখ, লোভ — সব। আর যদি কেউ বলবে, ‘এসো’ — তখন ভিতরের সবকিছু বাইরে আসে, আর বাইরে থাকা ওই মানুষের জায়গায় চলে যায়। আর কোনো প্রত্যাবর্তন নেই।”
নয়নার মনে একটা শীতল ঢেউ বয়ে গেল। “কিন্তু… ও যদি আমার মতো হয়?”
“সেইটাই তো ভয়,” রুকাইয়া খালা চোখ মেলেই বলল, “নিজের মতো যার মুখ, সে নিজের থেকেও বেশি নিজের।”
রাতগুলো নয়নার আর স্বাভাবিক হলো না। নিয়মিত কাপড় দিয়ে আয়নাকে ঢাকলেও মাঝরাতে ঘুম ভেঙে দেখত কাপড়টা পড়ে গেছে, যেন নিজেই আনমনে গেছে নিচে। রাতের অন্ধকারে আয়নার ফ্রেম থেকে অদ্ভুত আলোর ছিটে বের হতে থাকে, আর নয়নার কানে বাজতে থাকে বেদনাদায়ক এক কণ্ঠস্বর।
ডায়েরিতে সে লিখতে শুরু করল, তবে একসময় তার লেখা বদলে যেতে লাগল। নিজের অভিজ্ঞতা নয়, অজানা কেউ লেখা শুরু করল। একদিন পড়ল—
“আমি তোকে স্বপ্নে দেখেছিলাম। এখন তুই আমার দেহে, আমি তোর কাছ থেকে যাব না।”
অন্য দিন পড়ল—
“আমার নাম নয়না নয়। তুই আমাকে সে নামে ডেকেছিস, কিন্তু আমি বহু আগেই মরে গেছি। এখন তুই আমার জায়গায়।”
নয়না আয়নার প্রতিবিম্বে তাকিয়ে চমকে গেল। চক্ষু দুটো আলাদা, যেন ভেতর থেকে কেউ তাকিয়ে আছে। সেই রাতে আয়নার ভেতরকার অপরিচিত প্রতিবিম্ব কথা বলল না, শুধু ঠোঁট নড়ে আর কণ্ঠস্বর বাজল নয়নার মাথায়—
“তুই ক্লান্ত, আমি বুঝি। তোকে দেখে আমার দুঃখ হয়। আমায় আসতে দে, আমি তোর হয়ে থাকব। তুই আয় বিশ্রামে।”
নয়না আতঙ্কে চোখ বন্ধ করল, কিন্তু কণ্ঠস্বর থামল না।
দিন পেরিয়ে রাত এলো, নয়না খাবার খেতে ভুলে গেল, ঘুমালেও ঘুমাতে পারল না।
একদিন সে নিজেকে আয়নার দিকে এগিয়ে যেতে দেখল, পায়ের নিচে কেউ ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে তাকে। কাঠের মেঝেতে নখের আঁচড় পড়ছে। নয়না দাঁড়াল আয়নার সামনে, কাঁপা গলায় বলল, “তুই কে?”
আয়নার ভেতর থেকে প্রতিবিম্বের ঠোঁট নড়ল,
“তুই।”
নয়না নিজের অস্তিত্বের জন্য লড়াই করল, “আমি আমি, আমি সে নই!”
তবুও আয়না নীরব, শুধু হাসি ছড়াল তার মুখে।
রাতের ৩:০৩ টায় বাতি নিভে গেল, ঘরের বাতাস ভারী হয়ে গেল। নয়নার মাথা ঝিমিয়ে পড়ল।
শেষ কথা যা সে বলল, “এসো।”
সকালে নয়না আর নেই। হাসিখুশি, চটপটে, সংসারের কাজে ব্যস্ত কেউ।
কিন্তু মা যখন চা দিতে গিয়েই আয়নায় নয়নার চোখে চোখ পড়ল, এক মুহূর্তের জন্য সে পিছিয়ে গেল। নয়না যেন চিরকাল এমন নিষ্পলক চোখে তাকাত না।
দুপুরে নয়না বাগানে খেলছে, এক প্রতিবেশী বলল,
“দাদু সাহেবের নাতনি, মেয়েটা একটু আলাদা। চোখে যেন ভয়।”
একদিন এক কিশোরী নয়নাকে দেখে বলল,
“আপা, আপনার ছায়া কোথায়? পায়ের নিচে ছায়া পড়ে না কেন?”
নয়না হাসল, “ছায়া লাগে কার? আমি তো সত্যিই আছি।”
বছর খানেক পরে নয়না হঠাৎ নিখোঁজ। কেউ খোঁজ পায় না।
কিন্তু ঘরের সেই আয়নাটি পড়ে থাকে এক কোণে, ধুলো জমে, অদৃশ্য কারো জন্য অপেক্ষা করে।
নতুন বাসিন্দারা যখন আসে, তাদের ছোট মেয়ে বলে,
“মা, আয়নায় একটা আপু আটকে আছে। ও কাঁদে না, শুধু চায় আমি ওর সঙ্গে কথা বলি।”
“ঘরের আয়নাটা পড়ে থাকে ধুলোয় ঢাকা, এক ‘আমি’-র অপেক্ষায়—
যে জানেই না সে আদৌ কখন আয়নার সামনে দাঁড়াবে,
কিংবা, দাঁড়িয়ে গেছে বহু আগেই।”
